‘আমি সারাটা জীবনই প্রস্তুত ছিলাম’

সদ্যই অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন ভারতের সাবেক উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান পার্থিব প্যাটেল। সকল ধরণের পেশাদার ক্রিকেট থেকে নিজের বিদায়ের ঘোষণা করেছেন।

২০০২ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যাত্রা শুরু হয় রঞ্জি ট্রফিতে অভিষেকের পূর্বেই। এই আঠারো বছরের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে নানান গল্পে জমেছে। অসাধারণ কিছু ফিরে আসার গল্প রয়েছে তার ক্যারিয়ারে। খর্বশক্তির গুজরাট দলকে ঘরোয়া লিগের পাওয়ার হাউজে রূপান্তর করার রূপকারও বলা হয় তাঁকে। এই আঠারো বছরের পেশাদার ক্রিকেটের সফরে নানান চড়াই-উতরাই এবংভালোবাসার গল্প শুনিয়েছেন তিনি ইএসপিএন ক্রিকইনফোকে —

আপনার অবসরের ঘোষণা; এটা কি দুই বছর দেরিতে আসলো, নাকি দুই বছর আগে ?

আমি মনে করি এটাই সঠিক সময়। গত প্রায় বছরখানেক ধরেই আমি মনস্থির করে রেখেছিলাম। আমি মৌসুম গণনা করে এগুচ্ছিলাম। আমার মনে হয়েছে এটাই সম্ভবত সঠিক সময়। ১৮ বছর প্রথম শ্রেণির ও ভারতের ক্রিকেটের সাথে সংযুক্ত থাকার পর বিদায় বলার এটাই সঠিক সময়। আমি আমার ক্যারিয়ার নিয়ে সন্তুষ্ট। খেলোয়াড় ও অধিনায়ক হিসেবে তেমনকিছুই অর্জন করা বাকি রাখিনি। আমরা প্রায় সবকিছুই জয় করেছি। তিনবার আইপিএলের শিরোপা জয়ী দলের অংশ হতে পেরেছি। গুজরাটের ক্রিকেট কাঠামোও দারুণ অবস্থানে রয়েছে বলে আমি মনে করি।

জাতীয় দলের হয়ে সেরা স্মৃতি কোনটি ?

আমার জন্য হেডিংলি (২০০২) ও এডিলেড (২০০৩) টেস্ট জয় সেরা স্মৃতি হয়ে থাকবে। পাশাপাশি পাকিস্তানের বিপক্ষে ২০০৪ সালের সিরিজ জয়, যেখানে আমি পারফর্ম করে দলের জয়ে অবদান রেখেছিলাম। রাওয়ালপিন্ডিতে সেবার আমি প্রথমবার ওপেনিং করেছিলাম—এগুলোই আমার জন্য সেরা স্মৃতি। এছাড়াও আমি এখনও ভুলিনি সৌরভ গাঙ্গুলির কাছ থেকে প্রথম টেস্ট ক্যাপ পাওয়ার কথা নটিংহ্যামে। দাদার কাছ থেকে পাওয়া অভিষেক টেস্ট ক্যাপ এখনও আমার সংরক্ষণে রয়েছে। আমার নামে সেখানে ভুল ভাবে লেখা হয়েছিলো – ‘পার্তিব’।

অভিষেকের সময়, আপনার কি মনে হয়েছে আপনি প্রস্তত ছিলেন ১৭ বছর বয়সে টেস্ট ক্যাপ নেওয়ার জন্য ?

আমার কোনো প্রত্যাশা ছিলোনা। তাই কখনোই চাপ অনুভব করিনি। কয়েক বছর জাতীয় দলে খেললে তবে তরুণ কেউ চাপ অনুভব করতে শুরু করে; প্রত্যাশার চাপ তৈরি হয় বলে। নিজের প্রত্যাশার সাথে বেঁচে থাকাও বড় ব্যাপার। হ্যাঁ, আমি এখনও মনে করি আমি তৈরি ছিলাম, যখন আমাকে টেস্টে অভিষেক করানো হয়। কারণ দক্ষিণ আফ্রিকা ও শ্রীলঙ্কা সফরে আমি ভালো করেছিলাম ভারত-এ দলের হয়ে। বোর্ডার-গাভাস্কার বৃত্তি প্রোগ্রামের আওতায় ছিলাম আমি অস্ট্রেলিয়ায়। আমার জন্য সবচেয়ে বড় কঠিন সময় ছিলো, যখন আমি নতুন শুরুর চেষ্টা চালাচ্ছিলাম। আপনি যখন জানেন, আপনাকে ভালো করে যেতে হবে বছরের পর বছর। আর অপেক্ষা করতে হবে সুযোগ তৈরি হওয়ার। আমার জন্য বিরাট প্রতিবন্ধকতা ছিলো এটা।

এই ১৮ বছরে, কোনো মূহুর্ত কি ছিলো যা কিনা হাল ছেড়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট?

২০০৮-০৯ নিউজিল্যান্ড সফরের পূর্বে আমি রঞ্জি ট্রফিতে ৭ ম্যাচে ৮০০ এর অধিক রান করেছিলাম। কিন্তু দলে আমার জায়গা হয়নি। দুলীপ ট্রফিতে আমার সেঞ্চুরিও ছিলো। কিপিংও বেশ ভালো করছিলাম। তারপরেও দলে না থাকা আমার জন্য হতাশাজনক ছিলো। সেই মূহুর্তে আমার মনে হয়েছে, সম্ভবত আমি আর দলে ফিরতে পারবো না। সেই সময়টায় আমার মাথায় অস্বাভাবিক কিছুই ঘুরপাক খাচ্ছিলো। ধন্যবাদ জানাই আমার পরিবার ও জেসিএ (গুজরাট ক্রিকেট এসোসিয়েশন) কে। তাদের সমর্থন আমার বিশ্বাস ফিরিয়ে এনেছিলো, মানসিক অবস্থা শক্ত করতে সহায়তা করেছিলো।

ধোনির সাথে একই প্রজন্মে লড়াই করতে হওয়ার হতাশা তো নিশ্চয় আছে। সে বিষয়ে কিছু বলুন।

খেলোয়াড় হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা খুব জরুরী। কোথায় আপনি জরুরী সেটা মেনে নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। যখন ধোনি অধিনায়ক হিসেবে খেলছিলো, তখনও আমি খেলা চালিয়ে গিয়েছি। একটাই কারণ আমি খেলাটাকে ভালোবাসতাম। ফরম্যাট কখনোই বড় ব্যাপার ছিলোনা আমার জন্য। ক্লাব ক্রিকেট, জেলাভিত্তিক লিগ, রাজ্য ক্রিকেট, আইপিএল কিংবা জাতীয় দল। আমার কিছু লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা ছিলো এবং আমি ক্রিকেট দিয়ে এগুলো অর্জন করতে চেয়েছি। আমার পূর্ণ নজর চলে যায় গুজরাটের তরুণদের সমন্বয়ে দল তৈরির কাজে। কারণ ওখানে খুব বেশীসংখ্যক ক্রিকেটারের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের অভিজ্ঞতা ছিলো না যেটা আমার ছিলো। তারপর, সবকিছু আপন-আপনিই হয়ে থাকলো। একবার আপনি যখন দল কে প্রাধান্য দেবেন, ব্যক্তিগত সাফল্য কে নয়, সবার কাছে এরচেয়ে বেশীকিছু গুরুত্বও পাবেনা।

তরুণরা বেড়ে উঠছে এবং আইপিএলে খেলার স্বপ্ন নিয়ে। তাদের প্রতি আপনার কি বার্তা থাকবে ?

ঘরোয়া লিগ আমাদের অনেক কিছুই শেখায়। দর্শকশূণ্য মাঠে খেলা, ট্রেনে এবং বাসে ভ্রমণ আমাদের শিক্ষা দেয় দলের সদস্যদের গুরুত্ব। নানান ধাঁচের উইকেটে খেলা—কানপুরের লো উইকেট কিংবা ওয়াংখেড়ের বাউন্সি উইকেট আপনাকে অনবরত শেখায়। যদি আপনি ঘরোয়া লিগ ও রঞ্জি ট্রফিকে গুরুত্বসহকারে দেখেন তাহলে আইপিএল সহ বাকি সব এর অংশ হয়ে দাঁড়াবে। আপনি রঞ্জিতে ভালো করলেই আইপিএলে ভালো করতে পারবেন। পদিক্কল, রায়দু কিংবা আমি যখন আইপিএলে ভালো করেছি, ঘরোয়া লিগই মূলত এই ভিত গড়ে দিয়েছিলো। ঘরোয়া ক্রিকেট বিভিন্ন বিষয়ে পারদর্শি করে তুলে। ক্রিকেটার হিসেবে নানান চড়াই-উতরাই থাকলেও, আপনি সামলে নিতে পারবেন তখন। এটাই অনেক বড় শিক্ষণীয় অভিজ্ঞতা।

একটা সময় উইকেটরক্ষকরা ব্যাটিং দিয়ে দলে সুযোগ পেতো এবং ছিটকে যেতো কিপিংয়ের জন্য। এটা কি অন্যায় আপনার দৃষ্টিতে?

বর্তমান সময়ের দিকে তাকালে, ঋদ্ধিমান সাহা পুরোদমে একজন উইকেটকিপার। আমি আগেও বলেছি, হ্যাঁ, একজন কিপারের অবদান রাখা জরুরী ব্যাট হাতে। কিন্তু টেস্টে আপনার প্রথমেই উচিত লক্ষ্য রাখা কে ভালো কিপার এবং তারপর কে ব্যাট হাতে অবদান রাখতে পারবে। ফরম্যাট অনুযায়ী এটা পরিবর্তন হওয়া উচিত। ২০০২ সালে এটা ভিন্ন ছিলো। সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে উইকেটকিপার কে গ্লাভস ও ব্যাট উভয়দিকেই সমান পারদর্শি হতে হয়।

যতবার প্রত্যাবর্তনের কথা ভেবেছেন, সময় ব্যয় করে গুজরাট কে প্রাধান্য দিয়েছেন। ঘরোয়া ক্রিকেটের পাওয়ার হাউজ তৈরি করার চেষ্টা করেছেন। সেই জার্নিটা যদি শেয়ার করতেন….

প্রতি মৌসুমেই আমি রান পাচ্ছিলাম, কিন্তু ব্যক্তিগত সাফল্য তখন-ই আলোচনায় আসে যখন আপনার দল শিরোপা জেতে। একচোখা বলতে পারেন, কিন্তু তরুণ ক্রিকেটারদের এটাই সামনের দিকে চালিত করেছে যাতে গুজরাট শিরোপা জিততে পারে। ধারণা এমন ছিলো, যদি আমার নৈপুণ্য নজরে আনতে চাই তাহলে আমার দল কে শিরোপা জেতাতে হবে। আমার বড় পরিকল্পনা ছিলো, খেলোয়াড় নির্বাচনের ক্ষেত্রে। টূর্ণামেন্টে যারা নিয়মিত সেঞ্চুরী ও পাঁচ উইকেট আদায় করবে তারাই সুযোগ পাবে। শুধু এক সেঞ্চুরি বা পাঁচ উইকেটের এক বোলিং ফিগারে সুযোগ পাওয়া মানে বারবার এই পারফর্ম করার চেতনা বন্ধ হয়ে যাওয়া। তাই আমি নির্বাচকদের সাথে কথা বলে এই নিয়ম তৈরি করি, যাতে করে ক্রিকেটাররা সেঞ্চুরী ও পাঁচ উইকেট কে অভ্যাসে পরিণত করতে পারে।

জেসিএ থেকে দারুণ সহযোগিতা পেয়েছি আমি। দলের সদস্যদের আমি নেটে চ্যালেঞ্জ করতে শুরু করি। তারা কঠোর পরিশ্রম করতে শুরু করে। দলে ট্যালেন্টের দিক দিয়ে আমরা খুব উপরে ছিলাম না। আমি তাদের চ্যালেঞ্জ করতে লাগলাম, তুমি ১০০ বল খেললে আমি ১০১ বল খেলবো। তুমি ৫০ ক্যাচ নিলে আমি তার তুলনায় একটা বেশী নিবো। এভাবেই সবাই উন্নতি করতে থাকে, আমি নিজেরও অনেক উন্নতি হয়। এই সংস্কৃতি চালু করি আমরা। এর ফলাফলও দৃশ্যমান – অধিনায়ক হিসেবে আমি গর্বিত, আক্সার প্যাটেল, জাসপ্রিত বুমরাহ জাতীয় দলের অংশ হয়েছে। বুমরাহ এখন ক্রিকেটের ১ নম্বর বোলার। প্রিয়াঙ্ক পাঞ্চাল, মানপ্রিত জুনেজার মত অনেক ভালো ক্রিকেটার সেখানে রয়েছে। সবাই এখন গুজরাটের ক্রিকেট নিয়ে কথা বললেও। পূর্বে বিষয়টা এমন ছিলোনা।

এতকিছুর মাঝে নিজের জন্য সময় বের করা কঠিন বলে কি মনে হয়না?

২০১০-১১ তে, আমি সিদ্ধান্ত নিই আমি হাল ছাড়বো না। রঞ্জি ট্রফি হোক আর টেস্ট ক্রিকেট। পরবর্তী ট্যুরের জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখতে চেয়েছি। নিজেকে তৈরি রাখতে চেয়েছি যখন সুযোগ পাবো তখন পারফর্ম করার জন্য। এটাকেই আমি নিজের মানদণ্ড তৈরি করে নিয়েছিলাম। এবং এটাই আমাকে সাহায্য করেছে সবসময় প্রস্তুত থাকতে।

গুজরাটের পরিবর্তন নিয়ে যদি কিছু বলতেন — ২০০৪ থেকে ২০১৬-১৭ যখন দল শিরোপা জয়লাভ করলো…

জাতীয় দলের হয়ে খেলার পর গুজরাটের জন্য মাঠে নামা আমার জন্য একেবারেই ভিন্ন ছিলো। আমার ধারণা আগে আমাদের খেলার উদ্দেশ্য ছিলো প্রথম ইনিংসে লিড নেওয়া। প্রথম কয়েক বছর তাই আমরা দুই পয়েন্ট পাচ্ছিলাম। নিয়মিত পয়েন্ট লাভের পর, আমরা ম্যাচ জয়ের কথা ভাবতে শুরু করলাম। জয়ের ধারা শুরু হলো, আমাদের মানসিকতা ও খেলার ধরণেও পরিবর্তন আসতে শুরু করলো। আমরা বিশ্বাস করতে শুরু করলাম আমরাও টূর্ণামেন্ট জিততে পারি।

আমাদের অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেটাররা ইতোমধ্যেই শিরোপা জিতেছে জাতীয় পর্যায়ে, আমাদের ছেলেরা কুচবিহার এবং বিজয় মার্চেন্ট শিরোপাও ঘরে এনেছে। সুতরাং তাদের জানা আছে জিততে হলে কি করতে হবে, এছাড়াও এটা অন্য মাত্রার ক্রিকেট। তাদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছি, প্রথমেই অগ্রাধিকার পাবে ম্যাচ জেতার লক্ষ্য। সেটা সম্ভব না হলে লক্ষ্য হবে ওয়েস্ট জোনের হয়ে তালিকায় শীর্ষ অবস্থানে থাকা। এভাবেই আমরা প্রক্রিয়ার কাজ শুরু করেছি।

অবসরের সময়টায় ফেরত যেতে পারলে নিজের কোন দিকটায় পরিবর্তন আনবেন?

শারীরিক ফিটনেস ফেরত আনতে চাইবো। স্কিল অনুযায়ী কাজ করবো। অভিষেকের সময়টায় আমি বেশ ফিট ছিলাম। স্বাস্থ্য সচেতন হতাম অবশ্যই। বিশেষত আইসক্রিম, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই এগুলো গ্রহণ থেকে বিরত থাকতাম।

কোন অধিনায়ক কে এগিয়ে রাখবেন, যাদের অধীনে আপনি খেলেছেন?

অবশ্যই সৌরভ গাঙ্গুলি, অনিল কুম্বলে। তাদের দুজনের সবকিছু গুছানোর ক্ষমতা মাঠে ও মাঠের বাইরে ছিলো অসাধারণ। তাদের অধীনে খেলা আমাকে মাঠে ও মাঠের বাইরে দারুণ ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে।

ক্যারিয়ার অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে বলে কি মনে হয় আপনার?

আমি আফসোস করিনা। যতবার মাঠে নেমেছি, আমি নিজের সেরাটা দিয়েই নিজের ও দলের সদস্যদের এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছি। আমি ঘুমন্ত অবস্থায় থাকলেও চোখের পানিতে সবসময় আমার পরিবার ছিলো। তবে নিজের সিদ্ধান্ত নিয়ে আমি খুশি আছি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link