এখন তুলনা শব্দটা আমাদের ভাত-ডালের দিনযাপনে ঢুকে গেছে। বিরাট কোহলি অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে টেস্ট জেতার পর অনেকে একবাক্যে স্টেটমেন্ট দিয়েই দিচ্ছেন ভারতের বিদেশের মাটিতে তথা টেস্ট ক্রিকেটের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ অধিনায়ক তিনিই।
তখন ফেসবুক ছিল না। একজন খেলোয়াড়ের ব্যক্তিগত ফ্যানক্লাব শব্দটা দূরকল্পনাতেও ছিল না। অঙ্ক শেষ কথা বলে না কিন্তু, স্কোরবোর্ড নেমে যায়, ফিঁকে হয় পুরোনো রেকর্ডবুক। নতুনকে জায়গা ছেড়ে দিতে হয় প্রাক্তনকে। বিরাট কোহলি ভারতের হৃদয়পুরের নতুন সম্রাট। এমন বিস্ময় প্রতিভা ভারত কেন সারা বিশ্বেও সচরাচর আসেন না।
২০০০ সালে লোকটা ক্যাপ্টেন্সি পাওয়ার পর ২০০১ সালে অস্ট্রেলিয়া যখন ভারত সফরে এল তখন তারা ১৫ টেস্ট আনবিটেন। হেইডেন-গিলি-ওয়াহ-পন্টিং-ম্যাকগ্রা-ওয়ার্ন- দূর চিন্তাতেও সর্বকালের শ্রেষ্ঠ দল হিসেবে কেউ ঐ অজিদের ছাড়া অন্যকিছুকে ভাবতে পারবেন না।
ভারতের হাতে তখন একটা জাসপ্রিত বুমরাহ ছিল না, টেস্ট ক্রিকেটের ব্রহ্মাস্ত্র ফার্স্ট বোলিং-এই জায়গাতে লোকটা অধিনায়কত্ব পাবার পর হাতে পেয়েছিল নড়বড়ে অজিত আগরকর, তরুণতম জাহির আর কেরিয়ারের সায়াহ্নে আসা শ্রীণাথকে। ১৫ ম্যাচ অপরাজিত অজিদের রথ থেমে গেল উপমহাদেশে। সিরিজ ২-১ জিতলেন ক্যাপ্টেন গাঙ্গুলি।
সেই বছরই নভেম্বরে পোর্ট এলিজাবেথে অত্যধিক আগ্রাসী মানসিকতার জন্য ব্যান করা হল কিছু ভারতীয় খেলোয়াড়কে এই তালিকায় থাকলেন সৌরভ, সচিন,বীরু। মাইক ডেনিস জানালেন অত্যধিক আপিল ও খেলোয়াড়দের উত্তেজনা ছড়াতে প্ররোচনা দিচ্ছেন সৌরভ৷ ভারত হেরে গেল সিরিজ৷ সৌরভ জানতেন তিনি ভুল করেন নি৷ পোর্ট এলিজাবেথে গিবস-কার্স্টেন-ক্লুজনার-এনটিনি-পোলক-কালিস-হেওয়ার্ডসদের বিপক্ষে দূর্বল দল নিয়ে জিততে গেলে এই আগ্রাসন দরকার৷
২০০২ তে ইংল্যান্ডের মাটিতে ভারত টেস্ট জিতল। যে ইংল্যান্ডে পরবর্তীকালে সুইং পিচে ৪-০ এর লজ্জা দেখেছে ভারত সেই ইংল্যান্ডে, নাসির হুসেইন-ফ্লিনটফ-ভন-হগার্ড-জাইলস দের বিপক্ষে হেডিংলের উইকেটে ম্যাচ জেতা যেখানে ভারতের ওপেনার ছিলেন খাতা কলমে দূর্বল সঞ্জয় বাঙার, বোলিং ও একেবারেই সাধারণ মানের।
জোড়া সেঞ্চুরি করেন দ্রাবিড় ও স্বয়ং ক্যাপ্টেন সৌরভ। তখনো কিন্তু টেস্ট পিচে ঘাস ছাঁটা, রোলার প্রেস করে বাউন্স কমানোর চল আসেনি, ইংল্যান্ডের সুইং আর আফ্রিকার গতি-বাউন্স মরণফাঁদ উপমহাদেশীয় ব্যাটসম্যানদের জন্য। এপ্রিল ২০০৪-এ প্রথম ভারতীয় অধিনায়ক হিসেবে পাকিস্তানের মাঠে টেস্ট সিরিজ জয়। সেই পাকিস্তান দলের ১০ শতাংশ ক্ষমতার খেলোয়াড়ও আজ আর নেই। মাঝে অ্যাডিলেডে ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন অজিদের বিরুদ্ধে টেস্ট জয়- সবকিছু স্কোরবোর্ড বিচার করে না।
বিরাট কোহলি টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে অন্যতম সফল। ভবিষ্যতে ভারতীয় ক্রিকেটে বনস্পতির ছায়া দেবেন কিং কোহলি কিন্তু টেস্ট জয়ের সংখ্যায় সৌরভকে পিছনে ফেলে দিলেই কিন্তু তুলনা শুরু হয়ে যাওয়া বোধ হয় সঠিক নয়৷
কোহলির সাফল্য নিরঙ্কুশ, কোহলির জয়ের রাস্তাতেও যে কাঁটা বিছানো ছিল না এমনটা নয়। কিন্তু অধিনায়কত্ব পাবার আগে ও পরে কোহলির মাথার ওপর ভীষ্মের মতন ছিল মহেন্দ্র সিং ধোনির ছায়া। সৌরভের হাতে দায়িত্ব আসে যে সময়ে তা আমরা যারা চাক্ষুষ করেছি তারা ছাড়া চট করে কেউ বিশ্বাস করবেন না।
সমস্ত রূপকথা স্বাদ সকলে পান না, আমরা চোখের সামনে একটা পাঁচ ফুট ১১ ইঞ্চির মানুষকে দেখেছি যিনি টেস্টের আগে সাংবাদিকদের সামনে মানসিকতাটা এমন রাখতেন যেন ওদের লি-গিলেসপি-ম্যাকগ্রা আছে,আমি ভয় পাই না। আমার ভাজ্জি-জহিরও কিছু কম যায় না। মিলিয়ে নেবেন।
নিজের জীবনকে ইশতেহার করে বিলিয়ে দেবার নাম সৌরভ। ২০০০ এর ভারতীয় ক্রিকেটে কিচ্ছু ছিল না। শুধু ভালবাসা আর বিশ্বাস ছিল। বিরাট যেমন নিজের জায়গায় স্বতন্ত্র, যেমন নিজেই এক ইতিহাস তেমনই তুলনা যারা করছেন একটু ভেবে করবেন, সকলেই যেমন বিরাট কোহলি নন তেমনই সকলেই সৌরভ হন না।