আধুনিক ফুটবল কাব্যের গোড়ার দিককার কথা। ফুটবল পটে ছন্দের ঝংকার দিচ্ছে টোটাল ফুটবল। নেদারল্যান্ডসের কমলা রাঙা নীলমণি এক সুঠাম যুবক মাঠে নামলেন। সেদিন থেকেই যেন এক নতুন ছন্দে রঙে ভেসে চললো ফুটবল কাব্যের ধারা। বলছি টোটাল ফুটবলের সরব ইতিহাসের সেই নীরব কবির গল্প। নাম যার ইয়োহান নিসকেন্স।
নীরব কবির গল্পে ফিরতে একটু পেছনে যাই। ৬৮ সালের দিকে কিশোর নিসকেন্স জেদ ধরেন ফুটবল খেলার। ওদিকে টেবিলে তার ডাচ লিগ থেকে আসা বেসবলের প্রেমপত্র। কিন্তু ভাগ্যদেব যার তালুতে ফুটবল কবির গল্প লেখেন তাকে কি আর অন্য গল্পে টানে?
মাত্র ১৭ বছর বয়সে নিসকেন্স স্থানীয় ফুটবল দল রেসিং ক্লাব হিমস্টেডে রাইটব্যাক হিসেবে ফুটবল যাত্রা শুরু করেন। ঠিক দু’বছর বাদে ডাচ ফুটবলের দিকপাল আয়াক্স দলের স্কাউটের নজর কাড়েন তিনি।
ম্যানেজার টোটাল ফুটবলের জনক রিনাস মাইকেলস যেন মেঘ না চাইতে বৃষ্টি পেয়ে গেলেন। আমাদের কবিকে রক্ষণভাগ থেকে কিছুটা মাঝমাঠের দিকে নিয়ে আসেন তিনি। শিষ্যকে একসাথে আগে পিছে খেলার তালিম দিতে থাকেন। এদিকে শিষ্য যেন দ্রোণাচার্যের একলভ্য। মাঝ মাঠে রপ্ত করে বসেন অনবদ্য সব পাস দেবার ক্ষমতা।
কাব্যপটে নীরব কবি যেমন সরব তেমনই ক্ষিপ্র। গায়ে ৮ নম্বরের সিলমোহর এটে কখোনো হিংস্রভাবে বল ফেরাচ্ছেন। আবার কখনো এগিয়ে দিচ্ছেন খুনে একেকটা কাউন্টার পাস। ওদিকে পা দুটোতে যেন মোটর সাটা। ক্ষিপ্র কবি হয়ে ওঠেন নিসকেন্স। সাথে হাতে পান ফিনিশিং আর প্রেসিং নামক ব্রক্ষ্মাস্ত্র। বনে যান মাঝমাঠের সর্বেসর্বা।
পরিপক্ক নিসকেন্স ৭০ সালেই দেশের জার্সিতে পশ্চিম জার্মানির বিরুদ্ধে অভিষেক ঘটান। গড়ে তোলেন ইয়োহান ক্রুইফের সাথে অনবদ্য জুটি। ৭৪ সালে ব্রাজিলের সাথে ক্রুইফের ফ্রিকিকের এসিস্টের গোল প্রজন্মের সেরা গোল গুলোর একটি।
ইতালীয় চলচিত্র নির্মাতা জিয়ানি সিয়েরা তো বলেই বসেন, ‘ডাচরা যদি ফুটবলের বিটলস হয় ক্রুইফ আর নিসকেন্স হলো লেনন আর ম্যাকার্টনি। একলাতে মহান দ্বিত্বে স্পর্শাতীত।’
জাতীয় দলেও কোচ মাইকেলসের হাতে একাধিক ঘরোয়া ট্রফির সাথে টানা তিনটি ইউরোপীয় শ্রেষ্টত্বের কাপ অর্জনের করেন। একই গুরুর হাতে জাতীয় জার্সিতেও পরপর দু’বার বিশ্বকাপে রানার্সাপ হন তিনি। ইউরোতেও হন তৃতীয়।
আয়াক্স ছাড়াও উল্লেখযোগ্য ক্লাবের মধ্যে স্পেনে বার্সেলোনা। যেখানে আবার পাশে পান ক্রুইফকে। একত্রে জেতেন ইউরোপের শ্রেষ্ঠত্ব। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক কসমসে আলো ছড়ান তিনি।
টোটাল ফুটবলের ছাত্র নিসকেন্স খেলা ছেড়ে বার্সেলোনা দলেও অ্যাসিস্ট্যান্ট কোচ ছিলেন। পাশে পান মাঠের সাথী ক্রুইফকে। যদিও বন্ধু ক্রুইফের মতো ম্যানেজার জগতে আলো আদতে ছড়াতে পারেননি নীরব কবি নিসকেন্স। বার্সা বাদেও এসিস্ট্যান্ট কোচ ছিলেন তুরুস্কের গালাতাসারায়ে।
এছাড়া অস্ট্রেলিয়া ও নিজ মাতৃভূমির অ্যাসিস্ট্যান্ট কোচের দায়িত্বে থাকা নিসকেন্স ২০১৬ সাল থেকে ফুটবল পট থেকে হারিয়ে যেতে থাকেন। সে সময়ে চিরদিনের কাব্যিক সখা ক্রুইফের প্রয়ান যেন ধাতে সয়নি নিসকেন্সের।
সইবেই বা কেন? ক্রুইফই তো এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘এক গোলরক্ষক, নয়জন নিসকেন্স আর সামনে ক্রুইফকে এনে দাও।’ আদর্শ দলেও তার সখা যে তাকেই খুঁজতেন। সেই খোজেই সারা দিতে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন এককালের টোটাল ফুটবল কাব্যের অনন্য এ দিকপাল।
নিভৃতে সরবে কাটানো ক্যারিয়ারের মোহ আজও বিশ্বপটে ছন্দ ছাড়াচ্ছে। তাতেই হতবিহবল হয়ে ইয়ুর্গেন ক্লপের মতো বাঘাবাঘা সব ম্যানেজাররা আজও তার খেলা দেখে খেলতে নামে। নি:সন্দেহেই ফুটবল কাব্যের এক অনবদ্য অমৃত কমলা জার্সির এই কবি।