একটি ম্যাচ। একটি টেস্ট ম্যাচ। সেই ম্যাচে হয়েছে দাঙ্গা, সেই ম্যাচে হয়েছে বিশ্ব রেকর্ড, সেই ম্যাচে। এছাড়াও ক্রিকেটীয় সৌন্দর্য্য তো ছিলই। একটু কৌতুহল জেগেছে নিশ্চয়ই। অপেক্ষা করুন বলছি সেই ম্যাচের ঘটনা। শুরু করি সবচেয়ে বড় তথ্য দিয়েই। ম্যাচটি ছিল ভারত-পাকিস্তান মধ্যকার একটি টেস্ট। কৌতুহলের মাত্রা বেড়েছে?
ম্যাচটি ১৯৯৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের। উপমহাদেশে ক্রিকেটের আলাদা একটা জনপ্রিয়তা রয়েছে তা নিয়ে তো নতুন করে বলার কিছু নেই। মূলত সেই সময় উপমহাদেশে ক্রিকেট খেলুড়ে দল ছিল তিনটি। না ভুল বলা হয়ে যায়। টেস্ট খেলুড়ে দল ছিলো তিনটি। ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা। বাংলাদেশ তখনও টেস্ট স্ট্যাটাস পায়নি। তো পরিকল্পনা হলো বাকি তিন টেস্ট খেলুড়ে দল নিয়ে হবে এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়শিপ।
আজকের বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ধারণা সম্ভবত সেখান থেকেই। তো এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নের আসর বসলো ভারতে। প্রথম ম্যাচেই মুখোমুখি ভারত-পাকিস্তান। দুই চির প্রতিদ্বন্দ্বী। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট চিন্তা করলেও সেই সময় এই দুই দেশের মধ্যে একটা চাপা দ্বন্দ্বের আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। সেই টুর্নামেন্টের মাস খানেক বাদেই তো বেঁধে গেল যুদ্ধ। সে আবার ভিন্ন কথা, ভিন্ন আলোচনা। আমরা বরং ম্যাচে ফিরি।
সবকিছু ঠিকঠাক। ম্যাচ হবে কোলকাতার ইডেন গার্ডেন্সে। এর আগেই টুর্নামেন্টের উত্তেজনা বাড়িয়ে দিয়েছে দুই দলের মধ্যকার দ্বি-পাক্ষিক টেস্ট সিরিজ। ১-১ ব্যবধানে ড্র হওয়া সিরিজের প্রথম ম্যাচে ভারতীয় সমর্থকদের কাছ থেকে অভিবাদন পেয়েছিলেন পাকিস্তানের খেলোয়াড়েরা। আর দ্বিতীয় ম্যাচে অনিল কুম্বলের অনন্য বিশ্বরেকর্ড দখল। নিয়ে নিলেন এক ইনিংসে দশ উইকেট।
রাজনৈতিক উত্তাপ ছাড়াও ক্রিকেটীয় উত্তাপে একেবারে কোলকাতা জুড়েই নেমেছিল জ্বর। সেই জ্বর ছাড়াতে কোলকাতার দর্শক-সমর্থকেরা গিনিজ বুকে নিজেদের নামটি তুলে ফেললেন। পুরো টেস্ট জুড়েই ইডেন গার্ডেন্সের গ্যালারি ছিল লোকে লোকারণ্য। একদিনে প্রায় ৯০ হাজার দর্শক এসেছিল টেস্ট ম্যাচ দেখতে। ভাবা যায়! শুধু যে একদিন এসেই কোলকাতার দর্শকদের দখলে বিশ্বরেকর্ড চলে গেছে তা নয়।
ক্রিকেটের প্রতি কলকাতাবাসীর মহব্বত তাঁরা দেখিয়েছিলেন সেই টেস্টের পুরো পাঁচ দিন ধরেই। মোট ৪৬৫০০০ দর্শক সমাগম হয়েছিল সেই এক টেস্ট ম্যাচে। সেই যে গিনিজ ওয়ার্ল্ড রেকর্ড বইয়ে নাম উঠল তা আর সড়াতে পারেনি কেউ দীর্ঘ দুই যুগেও। কিন্তু মুদ্রার ওপর পিঠটাও দেখিয়েছিলেন সেই কলকাতার দর্শকরা।
টেস্ট ম্যাচের শুরুতে পাকিস্তান ব্যাটিং এ। ভারতীয় সমর্থকদের সামনে ভারতের দুর্দান্ত বোলিং পারফর্মেন্স। ২৬ রানে ছয় উইকেট হারিয়ে প্রথমেই ব্যাকফুটে চলে যায় পাকিস্তান। সেখান থেকে কেবল ১৮৫ রানই সংগ্রহ করতে পেরেছিল ওয়াসিম আকরামের দল। জবাব দিতে নেমে যে ভারতের ব্যাটিংও খুব একটা ভাল হয়নি। কেবল ৪১ রানের লিড নিতে পেরেছিল স্বাগতিকরা।
দ্বিতীয় ইনিংসে নিজেদের ব্যাটিং সামলে নেয় পাকিস্তান। ৩১৬ রান করে অল আউট হওয়ার পর ২৭৯ রানের একটি মোটামুটি বড় টার্গেট ছুঁড়ে দেন ভারতকে। দিন বাকি দুই। সম্ভব, খুব সম্ভব। ভারতও হয়ত তাই বিশ্বাস করতে চাইছিল। শুধু চাইছিল তা নয়। ম্যাচ জিততেও ছিল বদ্ধপরিকর। ব্যাটিং দেখে তো তাই মনে হচ্ছিল। ১৪৩ রানে মাত্র দুইটি উইকেট হারিয়ে বেশ একতা স্থিতিশীল পর্যায়ে ছিল ভারত।
এরপর সব বদলে যায়। দর্শকরা হারিয়ে ফেলেন নিজেদের মেজাজ। একটি রান আউটকে কেন্দ্র করে ফুঁসে ওঠে পুরো ইডেন গার্ডেন। তখন সেই স্টেডিয়ামে উপস্থিত প্রায় লাখ খানেক দর্শক। একটা বার একটু কল্পনা করুন তো সেই দৃশ্য। মানুষে ঠাসা সেই স্টেডিয়ামে পাকিস্তানি খেলোয়াড়েরা বড্ড বেশি মানসিক চাপেই ছিলেন। তা বেড়ে যায় শচীন টেন্ডুলকারের রান আউটকে ঘিরেই।
নয় রানে ব্যাট করতে থাকা শচীন ডিপ স্কোয়ার লেগে ঠেলে দেওয়া বলে রান নিতে যান। সেই বল কুড়িয়ে পাকিস্তানি ফিল্ডার নাদিম খান ছুঁড়ে মারেন উইকেটের দিকে। বল ধরতে উইকেটের কাছে চলে আসেন শোয়েব আখতার। কিন্তু তিনি নিজের অজান্তেই প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেন। যার ফলে আউট হয়ে যান শচীন। ব্যাস! হয়ে গেল কান্ড। ক্রিকেট জ্বরের উত্তাপ বেড়ে পরিণত হলো রাগের উত্তাপে।
গ্যালারি জুড়ে বিভিন্ন রকমের স্লোগান চলতে থাকে। এমনকি বাউন্ডারি লাইনে ফিল্ডিং করতে যাওয়া শোয়েব আখতারকে উদ্দেশ্য করে চলতে থাকে বিদ্রূপ। পাশাপাশি উচ্ছিষ্ট ও পানির বোতলের বর্ষণ হতে থাকে। পরিস্থিতি এতটাই বেগতিক হতে শুরু করে যে বাধ্য হয়ে ম্যাচ অফিসিয়ালদের চা-বিরতি এগিয়ে নিয়ে আসতে হয়। সময়ের সাথে ক্ষোভের বিস্তার হতে থাকে ইডেন গার্ডেনের সমস্ত গ্যালারি জুড়ে। প্রায় এক ঘন্টা যাবৎ বন্ধ থাকে খেলা।
পরিস্থিতি সামাল দিতে তৎকালীন আইসিসি সভাপতি জগমোহন ডালমিয়া ও শচীন টেন্ডুলকার মাঠ প্রদক্ষিণ করে দর্শকদের শান্ত হতে অনুরোধ করেন। এমনকি পরিস্থিতি এমনই বেগতিক হতে শুরু করেছিল যে ভারতীয় সাবেক ক্রিকেটার সুনীল গাভাস্কার ওয়াসিম আকরামকে অনুরোধ করেছিলেন শচীনকে ফিরিয়ে আনতে। এমন তথ্য পাওয়া যায় পাকিস্তানের সেই সময়কার টিম ম্যানেজার শাহরিয়ার খানের লেখা ‘ক্রিকেট: এ ব্রিজ অব পিস’ নামক বইয়ে।
সেই যাই হোক চতুর্থ দিনে খেলা শেষ হলো। ভারত আরো তিনটি উইকেট হারিয়ে স্কোর বোর্ডে ২১৪ রান জমা করতে সক্ষম হয়। তখন ক্রিজে ছিলেন সৌরভ গাঙ্গুলি ও অনিল কুম্বলে। পঞ্চম দিনে জয়ের জন্য ভারতের প্রয়োজন মাত্র ৬৫ রান। হাতে রয়েছে চার উইকেট। কিন্তু শঙ্কার বিষয় স্বীকৃত ব্যাটার একজন, তিনি সৌরভ।
আগুনে ঘি ঢালার মতো ঘটনা ঘটে গেল পঞ্চম দিনের সকাল সকাল। মাত্র নবম বলেই ওয়াসিম আকরামের বলে স্লিপে ক্যাচ দিয়ে সাজঘরে ফেরেন সৌরভ গাঙ্গুলি। দ্রুতই আরো দুইটি উইকেট পড়ে যায়। সেদিনও মাঠে প্রায় ৬৫ হাজারের মতো দর্শক উপস্থিত ছিল। পরিস্থিতি আবার খারাপ হতে শুরু করে। উপায়ন্তর না থাকায় ম্যাচ বন্ধ থাকে প্রায় তিন ঘন্টা।
এই তিন ঘন্টা সময়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী লাঠিচার্জের মুখে দর্শকদের বেড়িয়ে যেতে হয় মাঠ থেকে। কি পরিমাণ বেপরোয়া হয়ে গেলে লাঠিচার্জের প্রয়োজন পড়ে তা নিশ্চয়ই ভেঙ্গে বলে দেওয়ার কিছু নয়। সে যাইহোক বেড়িয়ে গেলেন সকল দর্শক। গিনেজ বুকে রেকর্ড গড়া ম্যাচের পরিসমাপ্তি ঘটে দর্শকশূন্য গ্যালারীতে। ম্যাচটি জিতেছিল পাকিস্তান। ফাইনালটাও খেলেছিল তাঁরা।
কিন্তু সেই ম্যাচে দর্শকদের রেকর্ড ছাড়াও আরো দুইটি রেকর্ড হয়েছিল। ৫০০০ টেস্ট রান পার করেছিলেন শচীন অন্যদিকে, মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন ছুঁয়েছিলেন ৬০০০ টেস্ট রানের মাইলফলক। তাছাড়া দারুণ পারফর্ম করেছিলেন জাভাগাল শ্রীনাথ।
দুই ইনিংস মিলিয়ে নিয়েছিলেন ১৩ উইকেট। অন্যদিকে, ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প লিখেছিল পাকিস্তান। ব্যাটিং বিপর্যয় থেকে ৪৬ রানে ম্যাচ জেতা। যদিও, এত সব অর্জন, এত সুন্দর সব ক্রিকেটীয় সৌন্দর্য ম্লান হয়ে যায় দর্শকদের বিরূপ আচরণে। খবরের কাগজের বড় অংশ জুড়ে জায়গা নেয় দাঙ্গা।
গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেই ম্যাচ। এর ফলাফলও ভোগ করতে হয়েছিল কলকাতার দর্শকদের। প্রায় দুই বছর অলিখিত এক নিষেধাজ্ঞায়। এমন ঘটনা না ঘটুক আর। দর্শক শূন্য মাঠের হাহাকার নিশ্চয়ই বুঝেছে বিশ্ব কোভিড থাবায়।