বাংলাদেশের টেস্টে ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধান করছি আমরা। সেই সাথে খোজ করছি, এখান থেকে বের হয়ে আসার উপায়।
আমরা এই ব্যাপারটা নিয়ে এবার মুখোমুখি হয়েছি দেশের অভিজ্ঞ ও কৌশলী কোচ নাজমুল আবেদীন ফাহিমের।
বাংলাদেশের ক্রিকেটার ও ক্রিকেটার কাঠামো গড়ে তোলার এক অনন্য কারিগর নাজমুল আবেদীন ফাহিম। সাকিব আল হাসান থেকে শুরু করে অনেক ক্রিকেটার উঠে এসেছেন তার হাত ধরে। ফাহিম আমাদের বলেছেন টেস্টে ব্যর্থতার কারণ ও সাফল্য পাওয়ার উপায় নিয়ে
ফাহিম ভাই, আমাদের সাম্প্রতিক এই টেস্টে খারাপ পারফরম্যান্সের কারণ কী বলে মনে হয়?
কয়েকটা ফ্যাক্টর আছে— একটা হলো যে, আমরা স্পিনিং উইকেটের সাহায্য নেওয়ার চেষ্টা করতাম আগে, সেটা আর বিদেশীদের ক্ষেত্রে কাজ করছে না। পাঁচ-সাত বছর আগেও ব্যাপারটা এমন ছিলো যে, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ— বা এই ধরনের দলগুলো কিন্তু স্পিন খুব একটা ভালো খেলতে পারতো না এবং ওদের ওই মানের স্পিনার ছিলো না। কিন্তু এখন এই অবস্থার পরিবর্তন এসেছে। এখন ওরা স্পিন ভালো খেলে এবং ওদের ঘরোয়া ক্রিকেটেও স্পিনাররা ভালো করে। ওরা স্পিনটা এখন ভালো বোঝে। পাঁচ-সাত বছর আগের এবং এখনকার স্কিলের যে পার্থক্য— তাতে ওদের ব্যাটসম্যানরা আমাদের স্পিনারদের ভালো খেলে, ওদের স্পিনাররা এখানে ভালো করে। অর্থাৎ একচেটিয়া যে সুবিধার আর কোনো সুযোগ নাই।
আমাদের ব্যাটসম্যানরাও কোয়ালিটি স্পিন একটু স্পিন উইকেটে ভালো খেলতে পারছে না।
হ্যা। আমরা বেশ কয়েক বছর ধরে ঘরোয়া ক্রিকেটে মূলত ব্যাটিং উইকেটে খেলছি। স্পিনিং উইকেট এখন আমাদের ব্যাটসম্যানদের জন্যও সমস্যার বিষয়। এই ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে ভালো স্পিনার আছে। একজন হোক, আর একাধিক হোক। প্রতিটি দলেই এখন এক দু জন উইকেটটেকিং (স্পিনার) বোলার থাকে; ওয়েস্ট ইন্ডিজেরও আছে।
আমাদের বোলারদেরও নিশ্চয়ই লিমিটেশন আছে?
হ্যা। সেটা হলো, ঘরোয়া ক্রিকেটে আমরা যে ধরনের উইকেটে খেলি, সেখানে টার্ন করানোর জন্য আমাদের বোলারদের খুব বেশি এফোর্ট লাগে না। এটা একটা অভ্যাসের ব্যাপার। অস্ট্রেলিয়াতে একজন যদি স্পিনার হিসেবে বেড়ে উঠতে চায়, তাহলে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত যদি সে বল টার্ন করাতে না পারে, তাহলে সে স্পিনার হিসেবে গণ্যই হবে না। কিন্তু আমাদের এখানে পরিস্থিতি তা না। এখানে আপনি টার্ন না করিয়েই উইকেট পাচ্ছেন। ফলে আপনার বোলার হিসেবে স্কিল তৈরী হচ্ছে না। মোট কথা, আগে বিদেশের ক্রিকেটাররা এখানে খেলতে পারতো না, এখন পারে। তারা এখন আগের চেয়ে প্রস্তুত। উল্টো দেখা যাচ্ছে, এই স্পিন লড়াইয়ের জন্য আমরা প্রস্তুত নই। যা একটা বিরাট পার্থক্য তৈরি করে দিয়েছে।
আমাদের স্পিনারদের মধ্যে কী আসলে সেরকম টার্নারের অভাব?
সাধারণত আমাদের বোলিং খুবই ওয়ানডে-ঘরানার হয়। টেস্টে সাধারণত একই জায়গায় বল করে যাওয়ার চেষ্টা থাকে। কিন্তু আমাদের বোলাররা একই ওভারে তিন-চার রকমের ডেলিভারি করে, যাতে ব্যাটসম্যানরা বুঝতে না পারে; এটা ওয়ানডে বা লিমিটেড ক্রিকেটের স্টাইল। টেস্ট ক্রিকেট তো তা নয়। টেস্ট ক্রিকেটে একই জায়গায় বল করে যাওয়া জরুরি; সেখান থেকে আপনাকে বল টার্ন করাতে হবে, নানা অস্ত্র প্রয়োগ করতে হবে। টেস্টে একই জায়গায় বল করে যাওয়ার স্ট্রাটেজি থাকা উচিত। এই দক্ষতা বা ধরনটা— সেটার অভাব আছে। ওদের কর্নওয়াল একই জায়গায় বল করে গেছে। কোনোটার হয়তো গতি কম, কোনোটার বেশি। এ রকম হওয়া দরকার।
ফাহিম ভাই, আমাদের টেস্ট খেলার জন্য যেরকম প্রতিদ্বন্ধীতামূলক ঘরোয়া ক্রিকেট দরকার, তা কী আছে?
এটা একটা গুড পয়েন্ট। আমাদের ঘরোয়া প্রথম শ্রেনীর দল তৈরি হচ্ছে কেন্দ্রীয়ভাবে। কোচও বোর্ড থেকে নির্ধারিত। ম্যানেজমেন্টও তাই। এখানে দলটা কারো নয়, কারো কোনো ওনারশিপ নেই। খেলোয়াড়, কোচ, কর্মকর্তা; কেউ মনে করে না, এই দলটা আমার। এই দেখুন, বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপে দেখবেন খুব হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়েছে। কারণ সেখানে দলের মালিকানা ছিলো। যে যার পছন্দ মতো কোচ নিয়েছে। পছন্দ মতো তারা টিম সিলেক্ট করেছে। সবার মধ্যেই জেতার তাড়না ছিলো। আমাদের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে কোনো ধরনের প্রতিযোগিতা নেই। সেখানে জিতলে খুশি হয়, কিন্তু হারলে কেউ কোনো কষ্ট পায় না। এই যে কষ্ট না পাওয়া— এটা ক্ষতিকর। কষ্ট পেলে সবাই জেতার চেষ্টা করতো, আরো প্রস্তুতি নিতো। সে রকম হলে সবার মধ্যে পরিবর্তন হতো। যেটা আমরা আন্তর্জাতিকে কখনো এ রকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হই এবং চেষ্টা করি।
এখন এই ওনারশিপ তৈরী করার উপায়টা কী?
মালিকানার একটা ধারণা তৈরি করতে হবে। দলটাকে নিজের মনে করতে হবে। যা দল সে ভালো করার জন্য সর্বোচ্চ যা করনীয়, তা তাই করবে। জেতার জন্য ইচ্ছে হলে সে বিদেশ থেকে কোচ আনবে— এর মানে হলো সেরা জিনিসটা খোঁজ করবো। সে জন্য আমাদের প্রতিটা বিভাগীয় দলকে তাদের কাঠামোতে ছেড়ে দিতে হবে। তারা নিজেদের ভেতর থেকে খেলোয়াড় বেছে নেবে, জেতার জন্য তাদের লম্বা সময় ধরে একসাথে ট্রেনিং করাবে; প্রতিটা বিভাগে একটা ক্রিকেট কাঠামো থাকতে হবে। জাতীয় দলের নিচে যে দল আছে, প্রতিটি ডিভিশনে সে রকম থাকতে পারবো। এখন ছোটদের উঠে আসার একটা পথ আছে। কিন্তু প্রতিটি বিভাগে এরকম কাঠামো থাকলে অন্তত আটটা পথ থাকতো। যা আমাদের সামগ্রিক ক্রিকেটকে অনেক বেশি শক্তিশালী করতো। প্রতিটি ডিভিশনের একটা ছেলে বয়সভিত্তিক দলে খেলার স্বপ্ন দেখতো। আটটা বিভাগীয় বয়সভিত্তিক দল থাকলে ১৬ জন ওপেনার জাতীয় দলের স্বপ্ন দেখতো। এতে অনেক ক্রিকেটার বাড়তো, আমাদের পাইপলাইন আরো সমৃদ্ধ হতো। অনেক কার্যকরী সিস্টেম হতো। এখন যেমন আমরা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলি, তখন বিভাগে বিভাগে সেই প্রতিযোগিতা হতো এবং আন্তর্জাতিক ও ঘরোয়া ক্রিকেটের যে পার্থক্য, তা অনেকটা কমে যেতো। এখন তো অনেক পার্থক্য। আমাদের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের কোচদের দেখুন— এমন অনেক কোচ থাকে, যাদের আদৌ কোনো মান নেই।
প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেটের উইকেট নিয়ে নিশ্চয়ই কাজ করার সুযোগ আছে?
খেলোয়াড় হবে ভালো কখন— যখন আমরা তাদের সামনে বড় বড় চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিবো। দলের ওনারশিপ বিষয়টি এ ক্ষেত্রে বড় বিষয়। আমি যদি জিততে চাই, তাহলে প্রতিপক্ষকেও আমার বিরুদ্ধে জেতার জন্য খুব পরিশ্রম করতে হবে। আর আমি যদি জেতার ব্যাপারে উদ্দেশ্যহীন থাকি, তাহলে কিন্তু প্রতিপক্ষ সহজেই আমাকে হারাতে পারবে। আমি যখন নিজে নিজের দল করবো, তখন কিন্তু আমার শক্তি অনুযায়ী উইকেট বানাবো। একই সাথে, উইকেট ভালো হলে খেলোয়াড়ের সামনে চ্যালেঞ্জ আসে এবং তারা ভালো হয়। সব কিছুতেই আমাদের উন্নতির সুযোগ আছে-সেটা উইকেট হোক, দল নির্বাচনে হোক, ভালো মানের বল হোক, প্রস্তুতির ব্যাপার হোক বা দুই ম্যাচের মাঝখানে গ্যাপের বিষয়ে হোক।
মোস্তাফা মামুন আমাদের বলেছেন, প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেট ফ্রাঞ্চাইজির হাতে ছেড়ে দেওয়াটা একটা উপায় হতে পারে?
সেটা তো বিসিএলে (বাংলাদেশ ক্রিকেট লিগে) করা হয়েছে। ফ্রাঞ্চাইজির হাতে প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেট ছাড়াটা হতে পারে। কিন্তু এটা নিশ্চিত করতে হবে যে, তারা যেনো কোয়ালিটি ক্রিকেট দিয়ে জেতার চেষ্টা করে। যেনো তেনো উপায়ে জিতে গেলেই খুশী, এই ধারণাটা থাকলে ফ্রাঞ্চাইজিতে দিয়েও খুব লাভ হবে না। জিততেও হবে খেলার মানও ভালো করতে হবে। জেতাটাই শেষ কথা নয়। আমি যদি ৪৫ পেয়ে ক্লাসের প্রথম হই, সেটা এক রকম। আমি যদি ৯৮ পাই, সেটা আরেক রকম। যদি এমন হয় স্পন্সররা (ফ্রাঞ্চাইজি) খুব বেশি টাকা-পয়সা খরচ করলো না, বা খেলোয়াড়দের দিলো না, তাহলে তো কাজ হবে না; এরকমও তো হতে পারে। তারা খুব কম খরচে খেলা শেষ করার দুই ম্যাচের মাঝখানে গ্যাপ কমিয়ে দিতে পারে বা বলতে পারে বিমানে যাওয়ার দরকার নেই, বাসে গেলেই হবে। অর্থাৎ শুধু ফ্র্যাঞ্চাইজি দিলেই হবে না। এখানে কিছু শর্তও থাকতে হবে। আসল কথা হলো, ক্রিকেটকে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে এবং সেটা বোর্ডের কতৃত্বেই হতে হবে।
জাতীয় দলের আরেকটা সাপ্লাই লাইন হলো ‘এ’ দল। আমাএদর তো বয়সভিত্তিক দল ছাড়া আর তেমন কাঠামো জাতীয় দলের নিচে নেই। আপনি কী এইচপি বা এ দলের কর্মকাণ্ড ঠিকে আছে বলে মনে করেন?
না, না; একদমই না। এটা হলো খেলোয়াড়দের প্রস্তুত করার জায়গা। আমি এখান থেকে জাতীয় দলে খেলোয়াড় নিবো। এটা কিন্তু দলের জয়-পরাজয়ের জন্য প্রস্তুত করা নয়। এখানে তিন-চারজন খেলোয়াড় থাকবে। যাদেরকে স্টেপ বাই স্টেপ সুযোগ দিতে হবে। সেটা জাতীয় দলে হোক, এর নিচে হোক। প্রতিটি খেলোয়াড়ের একটা সময় আছে। লেভেল বাই লেভেলে তাদেরকে সুযোগ দিতে হয়। ১৮ বছর বয়সে আমরা শান্তকে খেলিয়ে দিলাম। যদিও বাধ্য হয়ে খেলানো হয়েছে। ওকে যখন যেখানে সুযোগ দেওয়ার সেটা দেওয়া হয়নি। ধাপে ধাপে না খেললে আত্মবিশ্বাসে প্রভাব পড়ে। আত্মবিশ্বাস একবার কমে গেলে সমস্যা সৃষ্টি হয়। সেটা হয়তো বাইরে থেকে বোঝা যায় না, কিন্তু ভেতরে ভেতরে ক্ষয় হয় কিন্তু। এ রকম অনেক খেলোয়াড়ের ক্ষেত্রে হয়, কিন্তু আমরা খেয়াল করি না। বয়সভিত্তিক এবং জাতীয় দলের মাঝখানে যে ব্রিজটা থাকা দরকার, সেটা ভালোভাবে নেই। আমাদের এখানে বেশীরভাগ খেলোয়াড় এজ লেভেল থেকে সরাসরি জাতীয় দলে ঢুকে যাচ্ছে। মাঝের প্রস্তুতিটা হচ্ছে না। স্কুলে যেমন ডাবল প্রোমোশন দেয় না, এখানেও সেটা হতে পারে। কিন্তু সেটা সবাইকে না, যাদের যোগ্যতা আছে, তাদেরকেই দেওয়া হয়।
একটা খাটি টেস্ট খেলুড়ে দেশে যেরকম অনেক যোগ্য কোচ থাকা দরকার, তা কী আমাদের আছে?
দুঃখজনকভাবে, এটারও উত্তরও-না। কোচদের একটা ভূমিকা থাকা দরকার। খেলোয়াড়দের উন্নয়নের জন্য কোচদের বিরাট ভূমিকা থাকে। আমরা কিন্তু সেই মানের কোচ তৈরি করতে পারলাম না। সে দিকে আমাদের একেবারেই নজর নাই কিন্তু। যে কারণে, প্রথম শ্রেণির বা লিস্ট-এ ক্রিকেটে কিন্তু যথেষ্ট ভালো মানের কোচ নাই। এই খেলোয়াড়রা কিন্তু এই কোচদের অধীনেই বড় হয়েছে। এটা একটা বড় সমস্যা বলে মনে করি।