‘২০ কোটি কোচের এই দেশে কোচ হিসেবে বেশিদিন কাজ করা অসম্ভব’ – হতাশায় একবার বলেছিলেন ব্রাজিলের বিশ্বকাপজয়ী কোচ লুই ফেলিপে স্কলারি।
সারা দুনিয়াতেই কোচদের চাকরি খোয়ানোর ভয় থাকে। সেটা ব্রাজিলে আরও বেশি। কারণ কেবলমাত্র জয় ব্রাজিল ফ্যানদের কখনোই সন্তুষ্ট করে না। প্রতিপক্ষকে পুরোপুরি গুঁডিয়ে দিতে পারলেই কেবল তাদের প্রশান্তি।
ব্রাজিলের ইতিহাসে একমাত্র ফ্লাবিও কস্তা সেলেসাওদের কোচ হিসেবে পাঁচ বছর টিকেছিলেন ১৯৪০-৫০ এর দশকে। কিন্তু বর্তমান ব্রাজিল কোচ যিনি প্রফেসর নামেই পরিচিত কোচ হিসেবে সফলতার সাথে দায়িত্ব পালন করছেন পাঁচ বছর ধরে। তার মেয়াদে ৫২ ম্যাচে ৩৮ জয়ের পাশাপাশি হেরেছে মাত্র চারটিতে। তার অধীনের টানা ২১ ম্যাচ ধরে অপরাজিত ব্রাজিল যার মধ্যে ১৬টি জিতেছে তারা। তিনি আদেনর বাচ্চি তিতে; দ্য প্রফেসর নামেই যিনি পরিচিত। সম্প্রতি ফিফা.কমের কাছে একটি সাক্ষাৎকার দেন এই কোচ। সেখানে কথা বলেন নেইমার, কৌতিনহোদের পাশাপাশি নিজের ফুটবল দর্শন নিয়ে।
টানা চার ম্যাচ জিতে পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষে ব্রাজিল। ১২ গোলের বিপরীতে হজম করেছে মাত্র দুটি। বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে ব্রাজিলের পারফরম্যান্সকে কতটা মূল্যায়ন করছেন আপনি?
প্রতিটা খেলাই আলাদা। প্রতি ম্যাচেই নতুন করে শুরু করতে হয়। ব্যাপারটা কেবল ম্যাচেই সীমাবদ্ধ না। আমাদের আরো বড় করে ভাবতে হবে। করোনা মহামারীর কারণে আমাদের সবকিছু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফুটবল খেলার কোয়ালিটিতেও প্রভাব ফেলেছে। সত্যি বলতে শেষ তিন ম্যাচেই ছেলেরা আমার কল্পনাতীত পারফরম্যান্স করেছে এবং অবশ্যই এটা মানতে হবে ভেনেজুয়েলার বিপক্ষে জিততে আমাদের যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে। তবে সবমিলিয়ে আমি খুশি। পয়েন্ট তালিকার দিকে তাকালেই দলের পারফরমেন্স অনুমান করা যায়।
আর্জেন্টিনার ব্যাপারে, ডিয়েগো ম্যারাডোনা কয়েকদিন আগে মারা গিয়েছেন, তার সম্পর্কে আপনি কি ভাবেন?
ম্যারাডোনার ব্যাপারে বলতে গিয়ে আমার বন্ধু কারেকার (সাবেক ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার) কথাগুলোই মনে পড়ে যাচ্ছে। ম্যারাডোনার অসাধারণ ট্যাকটিক্যাল দক্ষতা, বল পায়ে সৃজনশীলতা, মাঠে নতুন কিছু করে দেখানো সব মিলিয়ে ম্যারাডোনার মুখোমুখি হবার আগে কারেকার ভয়ার্ত চেহারার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। মাঠে ম্যারাডোনা ছিলেন অনবদ্য।
নেইমার সম্পর্কে আপনার অভিমত?
নেইমার এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি পরিণত। বার্সায় থাকাকালীন কিংবা ব্রাজিল দলে আমার শুরুর দিনগুলোতে নেইমার কেবল উইং ধরে খেলতো, হয়তো গোল করতো কিংবা ড্রিবলিং করার চেষ্টা করতো;একাই খেলার চেষ্টা করতো। কিন্তু এখন নেইমার তাঁর খেলার পরিধি বাড়িয়েছে, মাঠের পুরোটা জুড়ে খেলছে, গোল করার পাশাপাশি সতীর্থদের দিয়ে গোল করাচ্ছে। নেইমার তাঁর তূণে তীরের পরিমাণ বাড়িয়েছে।
দলে ফিলিপে কৌতিনহোর ভূমিকা সম্পর্কে?
আমি দায়িত্ব নেবার পর থেকেই ব্রাজিল দল নানা পালাবদলের মধ্য দিয়ে গিয়েছে। তবে আমরা সবচেয়ে ভালো সময় কাটিয়েছি সম্ভবত ২০১৮ বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে। সুন্দর ফুটবলের পাশাপাশি প্রচুর সুযোগ তৈরি করতাম এবং বড় ব্যবধানে ম্যাচ জিতেছি। সেই ম্যাচগুলোতে কৌতিনহো ছিল এককথায় অনবদ্য, দলের প্রাণ। প্রথমে সে ডানপ্রান্তে খেলতো। পরে রেনাতো অগাস্তো ইনজুরিতে পড়লে আমি তাকে মিডফিল্ডের মাঝে নিয়ে আসি, অনেকটা লিভারপুলে সে যে ভূমিকায় খেলতো। সে সেখানেও দারুণ খেলেছে। প্রত্যেকের ক্যারিয়ারেই দু:সময় আসে। আমি আশা করি সে দ্রুতই ফর্মে ফিরে আসবে।
আপনি কি মনে করেন অ্যালিসনই বিশ্বের সেরা গোলরক্ষক?
আমাকে এটা নিয়ে চিন্তা করতে হবে। তবে হ্যাঁ আপনি যদি সেরা তিনজনের কথা বলেন তবে অবশ্যই আমি শতভাগ নিশ্চিত অ্যালিসন সেখানে থাকবে। কিন্তু সবার সেরা বলতে হলে আমাকে আগে বাকি গোলরক্ষকদের ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। কেবলমাত্র গত মৌসুমের কথা বললে সে অবশ্যই সেরা ছিল।
ব্রাজিল বাদে আপনার মতে বিশ্বের সেরা দল কোনটি?
এটা বলা কঠিন। মহামারীর পর এখনো সব দলগুলো পর্যাপ্ত ম্যাচ খেলার সুযোগ পায়নি। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, কলম্বিয়া খুব বেশি ম্যাচ খেলার সুযোগ পায়নি। ইউরোপের দলগুলো আটটি ম্যাচ খেলেছে যা আমাদের চেয়ে বেশি। ইতালি খুব সুন্দর ফুটবল খেলছে, মানচিনি দারুণ কাজ দেখিয়েছেন। আরিগো সাচ্চির মতো ইতালিয়ান ফুটবলে নতুন ধারার সূচনা করেছেন তিনি। প্রথাগতভাবে ইতালি রক্ষণাত্নক ফুটবল খেললেও মানচিনি রক্ষণের সাথে আক্রমণভাগের সুন্দর মেলবন্ধন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন। ইতালির দলটা পূর্বের তুলনায় অনেক বেশি ব্যালেন্সড। বেলজিয়াম তাদের ইতিহাসের সেরা দলটাকেই পেয়েছে; কেভিন ডি ব্রুইনা, ইডেন হ্যাজার্ড, রোমেলু লুকাকুদের মতো প্রতিভাবানরা রয়েছে দলে যারা কিনা একাই ম্যাচ জেতাতে সক্ষম। এছাড়া ফ্রান্সও যথেষ্ট ভালো খেলছে।
আপনার মতে বর্তমানে বিশ্বের সেরা তিনজন ফুটবলার কারা?
আমি সেই তিনজনের কথা বলছি যাদেরকে আমি ভোট দিয়েছি। নেইমার, লেওয়ান্ডস্কি, কেভিন ডি ব্রুইনা। ইনজুরিতে পড়বার আগে নেইমার দারুণ খেলেছে। লেওয়ান্ডস্কি অসাধারণ এক স্ট্রাইকার, নিয়মিতভাবে গোল করে যাচ্ছেন। ডি ব্রুইনা প্রতিনিয়ত নিজেকে ছাড়িয়ে যাচ্ছেন, বল পায়ে তার দক্ষতা কল্পনাতীত।
২০১৩ সালে আপনি একবছরের জন্য কোচিং থেকে বিরতি নিয়েছিলেন। এ সময়টাতে আপনি বিশ্বের বিভিন্ন জায়গা থেকে ফুটবলের পাঠ নিয়েছেন। এ ব্যাপারে যদি কিছু বলতেন?
আমি সবসময়ই ফুটবল নিয়ে পড়াশোনা করতে চেয়েছি এবং নিজের জ্ঞানের পরিধি বিস্তৃত করতে চেয়েছি। করিন্থিয়াস ছাড়ার পর আমার জন্য সেরা সময় ছিল ফুটবল নিয়ে গবেষণা করার এবং উচ্চতর প্রশিক্ষণ নেবার। কারণ করিন্থিয়াসের হয়ে ক্লাস পর্যায়ে যেসব ট্রফি জেতা সম্ভব সবই জিতেছি আমি; ব্রাজিলিয়ান সিরি আ, কোপা লিবার্তেরোস, ক্লাব বিশ্বকাপ যেখানে আমরা চেলসিকে হারিয়ে শিরোপা জিতি। আমার পরবর্তী লক্ষ্য ছিল সেলেসাওদের কোচ হওয়া এবং আমি সেজন্য সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিতে চাচ্ছিলাম। আমি সিমিওনে, গার্দিওলাদের বইগুলো পড়েছিলাম।
আমি জানতে চাচ্ছিলাম বোকা জুনিয়র্সে বিয়াঞ্চি এবং ক্রুইফ বার্সেলোনার হয়ে কিভাবে সবকিছু জয় করেছিলেন। বিশ্বের প্রতিটি জায়গায় ফুটবলের দর্শন আলাদা, আপনি সব জায়গা থেকে শিখতে পারবেন। আমি বিয়াঞ্চির সাথে দেখা করেছিলাম এবং তার আইডিয়া শুনেছিলাম। আমি আর্সেনালে সময় কাটিয়েছি। আমি রিয়াল মাদ্রিদে আনচেলত্তির সান্নিধ্যে ছিলাম। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ চ্যাম্পিয়ন ম্যানচেস্টার সিটি, বুন্দেসলীগা চ্যাম্পিয়ন বায়ার্ন মিউনিখে গিয়েছি, দেখেছি মাঠের বাইরে কিভাবে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা হয় এবং মাঠে কিভাবে পরিকল্পনা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে হয়। আমি ২০১৪ বিশ্বকাপের সবগুলো ম্যাচে দেখেছি এবং প্রতিটি দলের পরিকল্পনা-খেলার ধরণ নিয়ে গবেষণা করেছি। আমার ক্যারিয়ারের জন্য ঐ সময়টা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
কোন কোচের কাছে থেকে সবচেয়ে বেশি শিখেছেন?
আনচেলত্তি। সিমিওনে তার দলকে যেভাবে ডিফেন্ডিং করতে শিখিয়েছে সেটা অসাধারণ। কিংবা গার্দিওলার আক্রমণাত্নক ফুটবল, প্রতিপক্ষের পরিকল্পনা ভেস্তে দেবার দারুণ দক্ষতা। বিয়াঞ্চি শিখিয়েছে কিভাবে বড় ম্যাচে খেলোয়াড়দের কাছে থেকে সেরাটা বের করে আনতে হবে। ক্রুইফের বেশকিছু ট্যাকটিক্যাল আইডিয়া অসাধারণ। তবে কোনো সন্দেহ ছাড়াই আমি সবচেয়ে বেশি শিখেছি আনচেলত্তির কাছে থেকে। তিনি খেলাকে সম্পূর্ণ আলাদা স্টাইলে বিশ্লেষণ করেন।