আইপিএল আসলে একটা ডায়নামাইট

পেছনে পড়ে আছে সেই নরম বিকেলের আভা, সেই টেস্ট ম্যাচের নি:শব্দতা, সেই দিনের ক্রিকেটের কাব্যিক প্রেম। তবু স্বীকার করতেই হবে — এই সময়ের ক্রিকেটের আরেক নাম, আইপিএল। এই আইপিএল অপ্রতিরোধ্য। আইপিএলকে আটকাবে - সেই সাধ্য কারও নেই।

শচীন-লারা বা ওয়সিম আকরামেদের যুগ আর নেই। সেই চোখ ধাঁধানো শিল্প আর নেই। আর এখন ক্রিকেট মানে স্ট্রাইক রেট, ক্রিকেট মানে ইমপ্যাক্ট – এর বাইরে আর কিছুই না। প্রতিটা ওভারে কে কতটা মারতে পারবে, কতটা আয় হবে – মানে কতটা বানিজ্য হবে। এখন ক্রিকেটে ডট বলেও তালি পড়ে, তবে সেটা নির্ভর করে ম্যাচ সিচুয়েশনে। এই বদলের নাম — ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল)।

একটা সময় ছিল, যখন ক্রিকেটের চেহারাটা ছিলো আভিজাত্য আর আবেগে মোড়া। যারা খেলতেন, তাঁরা ছিলেন একেকজন শিল্পী। এরপর আইপিএল এসে সবকিছু পাল্টে দিলো। গানের জায়গা নিলো ডিজে, গ্যালারির চিৎকারে চাপা পড়ে গেলো কভার ড্রাইভের সৌন্দর্য। কিন্তু এখানেই তো গল্প শেষ নয়। গল্পের আসল মোড় তো এখনো বাঁক নেয়নি।

লোলিত মোদিকে অনেকেই চিনেন ‘কেলেঙ্কারির পুতুল’ হিসেবে। কিন্তু খুব কম মানুষ জানেন, এই মানুষটাই নব্বই দশকের শেষ দিকে চেয়েছিলেন ইউরোপিয়ান মডেলে ক্রিকেট বানাতে। তাঁর চোখে তখনই ধরা দিয়েছিল ভবিষ্যতের ক্রিকেট—যেখানে খেলোয়াড়রা হবে তারকা, আর দল হবে ব্র্যান্ড।

জগমোহন ডালমিয়ার আমলে সেই স্বপ্ন স্রেফ ফাইলেই পড়ে ছিল। কিন্তু সময় থেমে থাকে না। ২০০৭ সালে ধোনির তরুণ ভারত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতে ফেলে, আর ভারতীয় বোর্ড বুঝে ফেলে — সময়টা বদলে গেছে। যে ফরম্যাটকে গুরুত্ব দিচ্ছিল না, সেটাই হয়ে দাঁড়ায় ভবিষ্যতের ‘গেম চেঞ্জার’।

২০০৮ সালের ১৮ এপ্রিল, ব্যাঙ্গালুরুতে সূচনা হয় ক্রিকেটের এক নতুন ইতিহাসের। সেদিন সেই ম্যাচটা হয়তো এখন অতীত, কিন্তু ক্রিকেটের ‘নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার’-এর জন্ম হয়েছিল সেদিন। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের বর্ণময়, বাণিজ্যিক আর বিনোদননির্ভর এক যুগের সূচনা।

ব্রিদোহী আইসিএলের কবর রচনা করে, সেই প্রেক্ষাপটে গড়ে ওঠে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল) উত্থানের গল্প। আইসিএল না আসলে কিংবা ভারত যদি ২০০৭ সালে বিশ্বকাপ না জিতত – তাহলে হয়তো আইপিএল এই সুদিন আসতোই না। ভারতের মিডিয়া মুঘল জি গ্রুপ যে ক্রিকেট ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেছিল, সেই স্বপ্ন ‘চুরি’ করে সেটা বিশ্বজুড়ে এখন বাস্তবায়ন করছে মূলত বিসিসিআই।

গেইল, কোহলি, ধোনি, রোহিতদের কাঁধে তখন শুধু দেশের জার্সির দায়িত্ব নয়, ফ্রাঞ্চাইজির ব্র্যান্ড ভ্যালুও বয়ে বেড়াচ্ছেন তাঁরা। একজন ক্রিকেটার কত বড়—এখন সেটা নির্ধারণ হয় কত কোটি রুপিতে তাঁকে দলে নেওয়া হয়েছে, সেটার ওপর। আগে ক্রিকেটে গ্লাভস, ব্যাট আর প্যাড থাকতো—এখন সাথে থাকে স্পনসর, লোগো, বিজ্ঞাপনী চাহিদা। ‘ভালো ক্রিকেট’ এখন শুধু স্কোরবোর্ডে মাপা যায় না, সেটা এখন ব্র্যান্ড ভ্যালুতে, স্টারডমে, সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সে।

ক্রিকেট মানেই এখন বাণিজ্যিক যুদ্ধ। কাকে দলে নেওয়া হবে, কাকে ছেড়ে দেওয়া হবে—সব কিছুই এখন টাকায় টানা যায়। ক্রিকেট যেমন ব্যাটে বলে খেলা, তেমনি এখন এক্সেলে আর পাওয়ার পয়েন্টেও খেলা।

যেখানে টাকার গন্ধ, সেখানে অনৈতিকতার হাতছানি। ফিক্সিং—একটা সময় ছিল যেটা ম্যাচ পাতানোকে বোঝাতো, এখন সেটা ঘটনারও পাতানো। স্পট ফিক্সিং এখন ক্রিকেটের বড় ভাইরাস। খেলোয়াড়রা হয়তো জিতে যান, কিন্তু হেরে যায় ক্রিকেটের হৃদয়।

আইপিএল অনেক কিছু এনেছে—গতি, গ্ল্যামার, গভীরতা। কিন্তু সেই সাথে এনেছে সন্দেহ, শঙ্কা আর সুনামের পতন। ক্রিকেট আজ দুই মুখো পৃথিবীর বাসিন্দা। আইপিএল আসলে একটা ডায়নামাইট। আইপিএল একটা পথ বানিয়ে দিয়েছে। আইপিএল একটা আগুনটা জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে। আগুন জ্বালানো পথেই হাঁটছে ক্রিকেট বিশ্ব।

পেছনে পড়ে আছে সেই নরম বিকেলের আভা, সেই টেস্ট ম্যাচের নি:শব্দতা, সেই দিনের ক্রিকেটের কাব্যিক প্রেম। তবু স্বীকার করতেই হবে — এই সময়ের ক্রিকেটের আরেক নাম, আইপিএল। এই আইপিএল অপ্রতিরোধ্য। আইপিএলকে আটকাবে – সেই সাধ্য কারও নেই।

লেখক পরিচিতি

সম্পাদক

Share via
Copy link