মেসিই কি সর্বকালের সেরা ফুটবলার?

সর্বকালের সেরা ফুটবলার নির্ধারণ করার মানদণ্ড কী কী? অর্থাৎ কোন কোন বৈতরণী পার হলে একজন ফুটবল খেলোয়াড়কে গ্রেটদের কাতারে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে?

নিজের টিমকে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন করানো (এক বা একাধিক বার)? বড় টিমে কয়েক সিজন দাপটের সাথে খেলা? টানা এক দুই দশক অন্যান্য প্লেয়ারের (টিম মেম্বারদের তো বটেই) তুলনায় যোজন দূরত্বে এগিয়ে থাকা?

নাকি এইসব মানদণ্ড, ক্রাইটেরিয়ার রাস্তা ধরে আপনি হাঁটেন না? যদি হাঁটেন, তাহলে পুসকাস-ক্রুইফ-প্লাতিনি-জিকো-রুমেনিগেদের কী নামে ডাকা হবে? আর যারা জীবনে কোনদিন বিশ্বকাপে খেলারই চান্স পায় নাই (ডি স্টেফানো-জর্জ বেস্ট-ক্যান্টোনা), তাদেরই বা কী হবে?

লিওনেল মেসি ২০২২ বিশ্বকাপ জিততে না পারলে কি সে সর্বকালের সেরা হতো না? যে অবিশ্বাস্য ফর্মে বছরের পর বছর ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো ফুটবল মাঠে রাজত্ব করল, শুধুমাত্র বিশ্বকাপ পায়নি বলে সে কি সর্বকালের সেরার কাতারে আসতে পারবে না?

এটা চিরন্তন বিতর্ক চলার মত এক টপিক। তবু নিজের মতামত তুলে ধরি। এতোদিন আমি অন্যান্যদের মতো সেই স্কুলের বারান্দায় ছিলাম, যেখানের ছাত্ররা ‘গ্রেট ফুটবলারদের শ্রেষ্ঠত্ব ট্রফি বা বিশ্বকাপ দিয়ে মাপা যায় না’ – তত্ত্বে বিশ্বাসী। কিন্তু আমার মনে দ্বিধার খচখচানি ছিল। এখন আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি— লিওনেল মেসি ইজ দ্য বেস্ট! এই শতাব্দীর বেস্ট ফুটবলার তো বটেই, তর্ক-সাপেক্ষে সর্বকালের সেরা ফুটবলার মেসি!

এক্ষেত্রে প্রথমে আসি ‘ইম্প্রেশন’ প্রেক্ষিতে। ধরুন, যে ফুটবলারকে কেউ গোনাতেই ধরে না, তাকে আপনার ভালো লাগে বা আপনার বিচারে সেই সেরা। আমি ব্যক্তিগত একান্ত ভালো লাগা-মন্দ লাগার (ইম্প্রেশন) বিচার করতে যাব না। বলে রাখা ভালো, আমি কোন কিছু দ্বারা কাউকে শর্তারোপ করে দিতে চাই না।

এই সাব্জেক্টিভ ম্যাটার নিজে যেমন সহজে গ্রহণ করতে পারি, তেমনি অন্যকেও গ্রহণ করতে বলি। ফলত, কারো কাছে যদি জর্জ উইয়াহ ‘সর্বকালের সেরা ফুটবলার’ হিসেবে বিবেচিত হয়, আমি তার এই বয়ানকে রিফিউট করতে যাই না। এটা তার ইম্প্রেশনেই সীমাবদ্ধ থাক। কোন ক্ষতি নেই তাতে।

তারপর আসি ‘পরিসংখ্যান’ প্রেক্ষিতে। ১০টা লা লিগা, ৭টা কোপা দেল রে, ৭টা স্প্যানিশ সুপার কাপ, ৪টা উচল (উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ), ৩টা উয়েফা সুপার কাপ, ৩টা ক্লাব ওয়ার্ল্ড কাপ, রেকর্ড ৮টা ব্যালন ডি’অর (এই বছর জিতবে ধরে নিয়ে), রেকর্ড ৬টা ইউরোপিয়ান গোল্ডেন বুট, ১ ক্যালেন্ডার ইয়ারে ৯১ গোল, ১টা অলিম্পিক, ১টা কোপা, ১টা বিশ্বকাপ, রেকর্ড ২ বার বিশ্বকাপে গোল্ডেন বল! এইসব অর্জন লিখতে লিখতে হাত ব্যথা হয়ে যাবে, তবু মেসির সাফল্য-গাঁথা হয়তো ফুরাবে না।

এইবার আসি ‘লজিক’ প্রেক্ষিতে। ক্যারিয়ারে ২৫ শতাংশ ম্যাচ ভালো খেলতে পারলেই গ্রেটদের কাতারে নাম উঠে যায়– এরকম এক কন্ডিশনাল আলাপ আছে ফুটবল বিশেষজ্ঞদের মাঝে। মেসি কী করেছে, জানেন? মেসির আসল ‘মেসি’ হয়ে ওঠা ২০০৯ সাল থেকে। তখন থেকে ধরলে এই বিশ্বকাপ পর্যন্ত প্রায় ছয়শত ম্যাচ খেলে তার ঝুলিতে ৩১০-এর মতো ‘ম্যান অব দ্য ম্যাচ’ পুরস্কার! মানে তার ভালো খেলার হার ৫০ শতাংশের বেশি (যা দুনিয়ার আর কারও নেই)।

গ্রেটদের কাতারে থাকতে গেলে শুধুমাত্র গোল করতে জানলেও হয়। আর গ্রেটেস্ট হতে গেলে শুধু গোল করলেই চলে না, প্লে মেকিং এবিলিটি, অ্যাসিস্ট- প্রি অ্যাসিস্ট নাম্বার, ক্লাব ক্যারিয়ার, ন্যাশনাল ক্যারিয়ার, ম্যান অব দ্য ম্যাচ ইত্যাদি অনুষঙ্গ হিসেবেও ঘুরেফিরে আসে।

একজন প্লেয়ার তার ক্যারিয়ারে যা যা পাওয়ার, মেসি তার চাইতেও বেশি পেয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। ‘এলএম টেন’ দশকের পর দশক একই কাজ করে যাচ্ছে। শুধু ঝুলিতে ছিল না একটা বিশ্বকাপ, সেটাও অবশেষে অর্জিত হয়েছে।

’৮৬ তে ডিয়েগো ম্যারাডোনা যেভাবে একক নৈপুণ্যে আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ জিতিয়েছে, ২০২২-এ মেসি কোন অংশে পিছিয়ে ছিল না। ছিয়াশির আসরে ‘ফুটবল ঈশ্বরে’র ছিল ৫ গোল ও ৫ অ্যাসিস্ট অর্থাৎ দশ গোলে সম্পৃক্ততা।

মেসিও ছত্রিশ বছর পর এসে ঠিক ম্যারাডোনার মতোই দশ গোলে সম্পৃক্ত থেকেছে (৭ গোল, ৩ অ্যাসিস্ট)। গোল্ডেন বল পাওয়ার ক্ষেত্রে মেসি অনেকটা এগিয়েও রইল ম্যারাডোনা থেকে।

পরিশেষে আবারও বলি– ‘শ্রেষ্ঠত্ব’ ধারণাটাই সাবজেক্টিভ বা রিলেটিভ। এটা কোনভাবেই সামগ্রিক বা অব্জেক্টিভ কোন বিষয় না। আপনার ওপিনিওন এই ক্ষেত্রে ভিন্ন হতেই পারে। তবে এইসব বিশ্লেষণ শেষে আমি বিশ্বাস করি— লিওনেল মেসি শুধু এই শতাব্দীর বেস্ট ফুটবলারই নন, মেসি হলেন সর্বকালের সেরা ফুটবলার!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link