অধিনায়ক নাকি কোটার অধিনায়ক!

সব দলীয় খেলায়ই একটা কথা প্রচলিত আছে – ‘ক্যাপ্টেন লিডিং ফ্রম দ্যা ফ্রন্ট’।  ক্রিকেটে বোধহয় এই কথাটা আরো বেশি করে প্রযোজ্য। একজন অধিনায়ক নেতৃত্বগূণ দিয়ে দলকে দলকে যতটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন, ঠিক ততটাই বোধহয় তার পারফরম্যান্স দিয়ে। আর ঠিক এই জায়গায় গত এক বছরের বেশি সময় ধরে মোটা দাগে ব্যর্থ মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ।

মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারের সোনালি সময় ২০১৬-১৮ সাল। এই সময়কালে বাংলাদেশকে অনেক ম্যাচ জিতিয়েছেন তিনি একা হাতে। আবার অনেক ম্যাচে খেলেছেন অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু ইনিংস। ২০১৬ সালের এশিয়া কাপে তিনি ছিলেন দুর্দান্ত ফর্মে। প্রায় প্রতি ম্যাচেই ইনিংস এর শেষের দিকে নেমে ঝড় তুলিছিলেন ঠিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের চাহিদার সাথে মিল রেখে। এরপরেও টি-টোয়েন্টি টিমে তার ‘ফিনিশার’ রোল বাংলাদেশকে অনেকদিন এই পজিশন নিয়ে দু:চিন্তা করতে দেয় নি।

২০১৮ সালের নিদাহাস ট্রফির ফাইনালে উঠার লড়াইয়ে শ্রিলংকার বিপক্ষে তার ১৮ বলে ৪৩ রানের ইনিংসটি তো বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি ইতিহাসের অন্যতম সেরা ইনিংস হয়ে থাকবে। কিন্তু ২০১৯ ওডিআই বিশ্বকাপ এর পরবর্তী সময়ে ফর্ম হারাতে থাকেন মাহমুদউল্লাহ। সাকিব আল হাসানের নিষেধাজ্ঞার পর তিনি টি-টোয়েন্টি টিম এর অধিনায়কত্ব পান।

তার অধিনায়কত্ব পাওয়াটা অনেকটা ‘হারাধনের দশটি ছেলের মধ্যে রইলো বাকি এক’ এর মত। সাকিব নিষেধাজ্ঞায়,তামিম ইঞ্জুরিতে,মুশফিক বাংলাদেশ দলে আর অধিনায়কত্ব করবেন না বলে জানিয়েছেন ; টি-টোয়েন্টি টিমে তখন একমাত্র অভিজ্ঞতা সম্পন্ন খেলোয়াড় মাহমুদউল্লাহ।যদিও ঘড়োয়া ক্রিকেটে অধিনায়ক হিসেবে ভালোই সুনাম রয়েছে মাহমুদউল্লাহর।

বিপিএল সহ অন্যান্য ঘরোয়া টুর্নামেন্টগুলোতে তার নেতৃত্ব গূণ প্রসংশা কুড়িয়েছে। তবে এর আগে টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে ঘরের মাঠে জিম্বাবুয়ের মত দলের সাথে টেস্ট হারার রেকর্ড ও রয়েছে অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহর। তার অধীনে বাংলাদেশ ভারতের মাটিতে ভারতকে টি-টোয়েন্টিতে হারালেও অধিনায়ক সুলভ পারফরম্যান্স তিনি সেই সিরিজেও করতে পারেননি।

এরপর ২০২০ সালে পাকিস্তানের মাটিতে ধবলধোলাই হওয়া সিরিজেও তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো পারফরম্যান্স নেই রিয়াদের। এরপর ঘরের মাটিতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে জিততে অধিনায়ককে তেমন কিছু করতেই হয় নি। ২০২১ সালে নিউজিল্যান্ডের মাটিতে টি-টোয়েন্টিতে আবারো ধবলধোলাই হয় বাংলাদেশ। এরপর জিম্বাবুয়ের মাটিতেও রিয়াদের পারফরম্যান্স ছিল ভুলে যাবার মত।

৩য় ম্যাচে ১৯৪ রান তাড়া করতে নেমে তার ২৮ বলে ৩৪ রানের ইনিংস দলকে প্রায় খাঁদে ফেলে দিয়ছিলো। পরবর্তীতে আফিফ আর শামিমের দুটি দুই শতাধিক স্ট্রাইক রেটের ইনিংস দলকে জয়ের বন্দরে নেবার পাশাপাশি রিয়াদের প্রশ্নবিদ্ধ ‘ইনটেন্ট’-কে প্রবল প্রশ্নের মুখে পড়া থেকে বাঁচায়। এরপর ঘরের মাঠে অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ডকে মিরপুরের সেই চরম প্রশ্নবিদ্ধ পিচে সিরিজ হারায় বাংলাদেশ।যার ফল পরে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে পায় বাংলাদেশ।

এই দুই সিরিজের ১০ ম্যাচের মধ্যে একটি ম্যাচেই রান পান রিয়াদ; অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তৃতীয় টি-টোয়েন্টিতে ৫৩ বলে ৫২ রান করে ম্যাচসেরা হন তিনি। এরপর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভরাডুবি হয় বাংলাদেশের। ব্যাট হাতেও ওমান এবং পাপুয়ানিউগিনি বিপক্ষে ম্যাচ ছাড়া চরম ব্যর্থ ছিলেন রিয়াদ। এরপর যথারীতি ঘরের মাঠে পাকিস্তান, আফগানিস্তানের বিপক্ষেও হাসেনি রিয়াদের ব্যাট। সবশেষ ৯ ইনিংসে তার মোট রান ১০০।এরমধ্যে মাত্র ৩ ইনিংসে তার স্ট্রাইক রেট ১০০ পার করেছে।

টি-টোয়েন্টিতে ৪-৫ নাম্বারে ব্যাট করা একজন ব্যাটসম্যান এর কাছে দলের চাহিদা থাকে খুনে মেজাজের ব্যাটিং এবং ইনিংস ফিনিশ করে আসা। যেটা করতে বারবার ব্যার্থ হচ্ছেন রিয়াদ। মাউন্ট মোঙ্গানুইতে ঐতিহাসিক টেস্ট জয়ের ম্যাচে ৮৮ রানের অসাধারণ ইনিংস খেলার পরের ১০ ইনিংসে রান না পাওয়ায় অধিনায়কত্ব থেকে সরে যেতে হয়েছে টেস্ট অধিনায়ক মমিনুল হককে।

তাহলে গত প্রায় ১ বছর ধরে মোটাদাগে ব্যর্থতা এবং টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভরাডুবি হবার পরেও মাহমুদউল্লাহর বেলায় এমনটা হচ্ছে না কেন? গুঞ্জন আছে, দেশের ক্রিকেটে “সিনিয়র সিন্ডিকেট” এবং এর কারণেই অধিনায়কত্বে বহাল আছেন রিয়াদ।এছাড়াও বাংলাদেশে দলের বোঝা হবার আগে সরে দাঁড়ানোর সংস্কৃতি নেই বললেই চলে। ক্রিকেট পাড়ায় জোর গুঞ্জন শুধুমাত্র রিয়াদের অধিনায়ক থাকার কারণেই টি-টোয়েন্টিতে যাচ্ছেতাই রেকর্ডের পরেও এখনো টি-টোয়েন্টি দলে বিবেচনা করা হয় মুশফিকুর রহিমকে।

তথাকথিত পঞ্চপান্ডবের সাকিব ছাড়া বাকি সবারই টি-টোয়েন্টি পারফরম্যান্স নিয়ে আলোচনা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। তামিম টি-টোয়েন্টি থেকে স্বেচ্ছা বিরতিতে। মুশফিকের টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ার পারফরম্যান্স যাচ্ছেতাই।রিয়াদ ২০১৬-১৮ সেরা সময় পার করলেও এরপর ব্যর্থতার সোপান বেয়ে নেমে গেছেন অনেকটাই। শেষ ৩০ ইনিংসে তার স্ট্রাইকরেট কাঙ্খিত মানের ধারে কাছেও নেই। শেষ ১০ ইনিংসের পারফরম্যান্স আমলে নিলে তো এই কথা বলে দেয়াই যায় যে,ক্যাপ্টেন কোটায় এখনো দলে টিকে আছেন রিয়াদ।

ক্রিকেট অঙ্গনে ফিসফিসানি, শুধুমাত্র তথাকথিত পঞ্চপান্ডবের একজন হওয়ায় তার নামের ওপর কলম ধরার সাহস পাচ্ছেন না নির্বাচক সহ বোর্ডের কেউই। অধিনায়ক নিজের পারফরম্যান্স দিয়ে দলকে অনুপ্রাণিত না করতে পারলে শুধুমাত্র নেতৃত্বগূণ দিয়ে দলে কতৃত্ব ধরে রাখা কঠিন। সেই নেতৃত্বগূণের জায়গাতেও রিয়াদ ‘আপ টু দ্য মার্ক’ নন বেশি কিছুদিন ধরেই।

এছাড়াও রিয়াদের ফিল্ডিং পারফরম্যান্সও দলের মাথা ব্যাথার কারণ অনেকদিন ধরে। কে কবে কতটা ভালো খেলেছে সেটা দিয়ে দলে বিবেচনার সংস্কৃতি বোধহয় এখনো বাংলাদেশেই আছে।ভালো খেলতে না পারার কারণে প্রথমে অধিনায়কত্ব এবং পরে দলে জায়গা হারানো মোমিনুল হকের ঘটনা দেশের ক্রিকেটে এখনো খুবই তাজা।

অথচ গত একবছরে এতটা বাজে পারফরম্যান্সের পর রিয়াদকে ‘কোটার অধিনায়ক’ বলা ছাড়া অন্য কিছু বলার সুযোগ কি খুব একটা আছে? টি-টোয়েন্টি টিমে অধিনায়কত্ব বদল সহ যে পূন:গঠন ২০২১ এর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভরাডুবির পরেই করা উচিত ছিল,সেই ঢেলে সাজানোর কাজে হাত দিতে খুব বেশি দেড়ি করে ফেলছে না তো বিসিবি?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link