ক্রিকেটটা খুব অনুসরণ করেন না, এমন যে কোনো মানুষেরই আজ সকালে চমকে ওঠার কথা। প্রায় সব জাতীয় পত্রিকার প্রথম পাতায় বিশাল করে প্রধাণ খবর-বাংলাদেশের দক্ষিণ আফ্রিকায় সিরিজ জয়।
সিরিজ জিতলে প্রথম পাতায় খবর প্রকাশ হয়। তাই বলে এতো বিরাট বিরাট ছবি, এতো বড় বড় লেখা?
একটু যেনো সন্দেহ তৈরি হয়, আসলেই কী দক্ষিণ আফ্রিকাতে গিয়ে তাদের বিপক্ষে সিরিজ জয়, এতো বড় ঘটনা? আসলেই কী এটা বাংলাদেশের এ যাবৎকালের সেরা ক্রিকেটীয় অর্জন?
দক্ষিণ আফ্রিকায় এই সিরিজ জয় কেনো মাহাত্মপূর্ণ সে নিয়ে আলাদা করে বলাটা বাকী আছে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশ এখানে এর আগে কখনোই কোনো ম্যাচে স্বাগতিকদের হারাতে পারেনি। সবসময় বিশাল বিশাল ব্যবধানে হেরেছে।
শুধু বাংলাদেশ কেনো? ভারত-পাকিস্তানের জন্য তো বটেই, অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডও এই দক্ষিণ আফ্রিকাতে ভালো কিছু করতে বেগ পায়। ফলে সেই দেশে তাদেরকে এভাবে উড়িয়ে দেওয়াটা নিশ্চয়ই অনেক অনেক বড় ব্যাপার। কিন্তু সেটা কী আসলেই এতো বড়? সেই সিরিজ জয়কে কী আসলেই আমাদের সেরা অর্জন বলে দাবি করা যায়?
এই ধরণের তুলনা করাটা একটু কঠিন। কেউ হয়তো বলবেন, বাংলাদেশের এখনও অবধি সেরা অর্জন ১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফি জয়। কেউ আবার বলবেন, মেয়েদের এশিয়া কাপ জয়টা বৃহত্তম ব্যাপার ছিলো। আবার কেউ বলবেন ২০২০ সালে যুব দলের বিশ্বকাপ শিরোপা জেতাটা সবচেয়ে বড় ব্যাপার।
আসলে এভাবে তুলনা করে কোনো সমাধাণে পৌছানো কঠিন। আমরা বরং আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের সিনিয়র পুরুষ দলের অর্জনগুলো নিয়ে আলাপ করি। তাহলে হয়তো আমাদের হিসেব করতে সুবিধা হবে।
বাংলাদেশ পুরুষ দলের সেরা অর্জনগুলো নিয়ে লড়াই হলে সেই তালিকায় কয়েকটা সময় উঠে আসবে। ২০১৫ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল খেলা, ২০১৭ চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমিফাইনাল খেলা, ২০১৫ সালে দেশের মাটিতে ভারত-পাকিস্তান-দক্ষিণ আফ্রিকাকে সিরিজ হারানো এবং নিউজিল্যান্ডে টেস্ট জয়। এখন আমরা একটু বিচার করে দেখি যে, এই চারটি জয়ের তুলনায় দক্ষিণ আফ্রিকা জয়টা আসলে কোথায় আছে।
ভারত, পাকিস্তান ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টানা তিন সিরিজ জয় অবশ্যই ইতিহাসের বড় ব্যাপার। এর ভারত ও পাকিস্তানকে উপমহাদেশের মাটিতেই সিরিজ হারানোটাকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। আমাদের রণকৌশল তারা সবাই জানে এবং সামলাতে পারে। তারপরও তাদের আমরা হারিয়েছিলাম। তারপরও এই সিরিজ জয় তিনটেকে আমরা লড়াইয়ে একটু পিছিয়ে রাখতে পারি দেশের মাটির কারণে।
কিন্তু ২০১৫ ও ২০১৭?
২০১৫ বিশ্বকাপে আমরা অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের কণ্ডিশনে গিয়ে কোয়ার্টার ফাইনাল খেলেছিলাম। আবার ২০১৭ সালে আমরা ইংলিশ কণ্ডিশনে সেমিফাইনাল খেলেছি। তাহলে এই দুটি অর্জনকে আমরা কোথায় রাখবো?
এখানে একটু রূঢ় হয়ে একটা ব্যাপার স্বীকার করতে হবে যে, এই দুটি টুর্নামেন্টে আমরা আসলে একটা করে বড় ম্যাচ জিতেছিলাম। ২০১৫ সালে ইংল্যান্ড ও ২০১৭ সালে নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে আমরা পার হয়ে গিয়েছিলাম। ওখানে ধারাবাহিকভাবে নিজেদের প্রমাণের তেমন কিছু ঘটেনি।
একই যুক্তি আমরা মাউন্ট মঙ্গানুইয়ের টেস্ট জয়ের ক্ষেত্রে দেবো। নিশ্চয়ই আমাদের টেস্ট ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম অর্জন নিউজিল্যান্ডে ওই টেস্ট জয়। কিন্তু ওটাই হঠাৎ করে একটা ঘটনা ছিলো। এর আগে পরে আমরা ওরকম কিছু এখনও করিনি। ফলে ওটাকে সেই দাপটের সাথে মেলানো যাচ্ছে না।
আর এই জায়গাতেই সবার চেয়ে এগিয়ে গেলো দক্ষিণ আফ্রিকা জয়।
দক্ষিণ আফ্রিকাতে আমরা হুট করে একটা ম্যাচ জিতে গেছি, তা নয়। টানা তিন ম্যাচে আমরা ওদের চেপে ধরেছি। এর মধ্যে দুটি ম্যাচে একেবারে উড়িয়ে দিয়েছি। এবং এই কাজটা করেছি আমরা ওদের অস্ত্র নিয়ে। এতোদিন বাংলাদেশের জয় মানে অনেকটাই স্পিন ও সাকিব নির্ভরতা ছিলো। এখানে সেটা খুব বেশি ছিলো না।
স্পিনাররা এবং ব্যাটে সাকিব কিছু ভূমিকা রেখেছেন। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকাকে আমরা গুড়িয়ে দিলাম মূলত পেস বোলিং দিয়ে। আর এই ব্যাপারটাই দক্ষিণ আফ্রিকা জয়কে সেরা করে ফেললো। ভিনদেশের দূর্গে গিয়ে, তাদেরই অস্ত্র দিয়ে তাদের গুড়িয়ে দেওয়ার যে মাহাত্ম, তা পৃথিবীর আর কোনো কিছুতে নেই।ফলে এই জায়গাটায় তামিমের এই দল আগের সব অর্জনকে ছাপিয়ে গেলো।
এটা এখন বলাই যায় যে, দক্ষিণ আফ্রিকা জয় এখন অবধি বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম ঘটনা।
হ্যা, এই ঘটনা হয়তো খুব বেশিদিন ‘শ্রেষ্ঠতম’ থাকবে না। এই খেলোয়াড়রাই হয়তো দু দিন পর ইতিহাস বদলে ফেলবেন। আরও কঠিন কোনো ভূমিতে আরও বড় কিছু জিতে এই অর্জনকেও পিছিয়ে দেবেন। কিন্তু ইতিহাস তো একেবারে মুছে ফেলা যাবে না।
ইতিহাসের সেই ললাটে তাসকিনদের নাম লেখাই থাকবে।