ইতি, ইশান্ত!

লর্ডস তখন প্রায় পূর্ণ। ছয় ফুট তিন ইঞ্চি দীর্ঘকায় ঝাকড়া চুল ওয়ালা যুবক ছুটছে। একটু কল্পনা শক্তিতে জোড় দিলে মনে হতে পারে একটি সিংহ ছুটে চলেছে তাঁর শিকারের উদেশ্যে। সেই যুবক ছেলেটির উদ্দেশ্যও খানিক একই। কিন্তু প্রেক্ষাপট ভিন্ন, ভিন্ন স্থান কাল ও পাত্র।

খানিকটা খাটো লেন্থের বল একেবারে গা গেসে বেরিয়ে যাওয়ার সময় স্টুয়ার্ট ব্রডের ব্যাট আলোত করে ছুঁয়ে দেখলো বলটি। তাতেই ব্রড বনে গেলেন সেই ঝাকড়া চুলে দীর্ঘকায় যুবকের সপ্তম শিকার। ছেলেটি ভারতের পেসার ইশান্ত শর্মা। ঘটনাটা ২০১৪ সালে ইংল্যান্ড বনাম ভারতের মধ্যকার টেস্ট সিরিজের।

লর্ডসের সেই টেস্টের চতুর্থ ইনিংসে ৭১ রানে সাত উইকেট শিকারই ইশান্ত শর্মার টেস্ট ক্যারিয়ারের বেস্ট বোলিং ফিগার। ২০০৭ সালে টেস্ট অভিষেক হওয়া ইশান্ত এখন পর্যন্ত খেলেছেন ১০৫টি টেস্ট। কিন্তু সম্প্রতি ভারতের টেস্ট দলে তাঁর থাকা নিয়ে উঠেছে সংশয়। যদিও তিনি রয়েছেন আসন্ন দক্ষিণ আফ্রিকা সফরকারী দলে তবুও অনেক ক্রিকেট বোদ্ধাদের মত প্রোটিয়াদের বিপক্ষের সিরিজ দিয়েই সমাপ্তি ঘটতে পারে ইশান্ত শর্মার টেস্ট ক্যারিয়ারের। এর পেছনের সবচেয়ে বড় কারণ, দলের রাডারে থাকা অন্যসব পেসারদের আমূল উন্নতি।

ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের বিভিন্ন সূত্র থেকেও এমনটাই আভাস মিলেছে। ইশান্তের সাথে দলের আরো দুই খেলোয়াড় যে গভীর পর্যবেক্ষণে থাকবেন আসন্ন দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজে সেই তথ্যও মিলিছে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে। বাকি দুইজন আজিঙ্কা রাহানে ও চেতেশ্বর পুজারা।

ভারত ক্রিকেট দলে মোহাম্মদ শামি ও জসপ্রিত বুমরাহদের অতিঅসাধরণ পারফর্মেন্সের ভীরে ক্রমশই আড়াল হতে থাকা ইশান্ত শর্মা ছিলেন দলের তৃতীয় কিংবা চতুর্থ পছন্দ। সেখানেও রয়েছে কন্ডিশন ও টিম কম্বিনেশনের বাগড়া। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে মোহাম্মদ সিরাজ, শার্দুল ঠাকুরদের নজড়কাড়া পারফর্মেন্স যেন আরো সংকীর্ণ করে ফেলছে ইশান্ত শর্মার জাতীয় টেস্ট দলে টিকে থাকার পথ।

এছাড়াও প্রসৃদ্ধ কৃষ্ণা, আবেশ খান, নবদ্বীপ সাইনিদের মতো উঠতি তারকাও কড়া নাড়ছে জাতীয় দলের দরজায়। তাছাড়া নিজের স্বভাবজাত আগুন ঝড়ানো গতিতে মুগ্ধ করা উমরান মালিকও নির্বাচকদের বাধ্য করছে তাঁকে নিয়েও ভাবতে। সুতরাং সামনে ইশান্তকে পাড়ি দিতে হবে কঠিন পরীক্ষা।

তাছাড়া ঘরের মাঠের টেস্ট সিরিজে দলে সাধারণত দুইজনের বেশি পেসার খেলানো হয় না ভারতীয় টিম ম্যানেজমেন্টের পক্ষ থেকে। সেহেতু দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজেই ইশান্তকে নিজের সামর্থ্যের পূর্ণ প্রমাণ রাখতে হবে। দক্ষিণ আফ্রিকার পরবর্তী সময়ে ভারত শ্রীলঙ্কা বিপক্ষে খেলবে ঘরের মাঠে তারপর পাড়ি জমাবে ইংল্যান্ডে। ইংল্যান্ড সফরে দলে থাকতে তাঁকে পারফর্ম করতেই হবে।

ইশান্ত শর্মার বাদ পড়া বা শেষ সুযোগ এই বার্তা ছড়িয়ে পড়ার কারণ তাঁর সাম্প্রতিক পারফর্মেন্স ও ওয়ার্কলোড সামলে উঠতে অপারগতা। গেলো এক বছরে ইশান্ত খেলেছে আটটি টেস্ট ম্যাচ। যেখানে ৩২.৭১ গড়ে উইকেট নিয়েছেন ১৪টি। বছরের শুরুতে তাঁর দ্রুত ক্লান্তি কাটিয়ে উঠতে না পারার প্রমাণ মিলেছে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে। যেখানে দ্বিতীয় টেস্টের দুই ইনিংসে সমান পাঁচটি করে উইকেট নেওয়া ইশান্ত পুরোপুরি নিষ্প্রভ ছিলেন তৃতীয় টেস্টে। ২২ ওভার বল করে দেখেননি কোন উইকেটের মুখ।

সদ্য সমাপ্ত হওয়া নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম টেস্টেও ইশান্ত ছিলেন অকার্যকরী। প্রথম ইনিংসে ১৫ ওভার বল করে তাঁর উইকেটের খাতা ছিল শূন্য। অন্যদিকে দ্বিতীয় ইনিংসে তিনি বল করেছন মাত্র সাত ওভার। যেখানে আলো কেড়েছেন আরেক পেসার উমেশ যাদব। এমন স্তিমিত পারফর্মেন্সের পর আঙ্গুলের ইনজুরিতে ছিটকে যান তিনি দ্বিতীয় টেস্ট থেকে।

সম্প্রতি ভারত ক্রিকেট একটি পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দলে কোচের দায়িত্ব পেয়েছেন রাহুল দ্রাবিড়, টেস্ট অধিনায়ক বিরাট কোহলি থাকলেও টি-টোয়েন্টি ও ওয়ানডে দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পেয়েছেন রোহিত শর্মা। সুতরাং দলের একাদশেও যে পরিবর্তন অবিসম্ভাবী তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

তাছাড়া রাহুল দ্রাবিড় যুব খেলোয়াড়দের নার্সিং করে অভস্ত্য তিনি জানেন পাইপলাইনে ঠিক কেমন খেলোয়াড় রয়েছেন বিশেষ করে পেসাররা। শিভাম মাভি, কমলেশ নাগারকোটিদের মত উদীয়মান গতি তারকারাও রয়েছেন ইশান্তকে টেক্কা দিতে।

তাছাড়া মোহাম্মদ সিরাজ অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট অভিষেক হওয়ার পর থেকেই রয়েছেন দারুণ ছন্দে। ১০ টেস্টে তাঁর উইকেট সংখ্যা ৩৩টি। রয়েছে একবার ইনিংসে পাঁচ উইকেট ও দুইবার চার উইকেট শিকার করে নিজের সামর্থ্যের প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। সম্প্রতি নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে দ্বিতীয় টেস্টেও উজ্জ্বল ছিলেন সিরাজ। স্পিনারদের ভীরে তিনি বাগিয়েছিলেন তিনটি উইকেট। এমন বিধ্বংসী পেস আক্রমণের অভাব নিশ্চয়ই বোধ করেছে টিম ইন্ডিয়া প্রথম টেস্ট ম্যাচে।

সুতরাং অলিখিত বিদায় টেস্ট ম্যাচ খেলতে চলেছেন ইশান্ত প্রোটিয়াদের বিপক্ষে। হয়ত তিনি সকলকে ভুল প্রমাণ করে নিজের সেরাটা দিয়ে আরো কিছুদিন দলের জন্যে খেলে যেতে চাইবেন এবং নির্বাচকরাও তাঁর প্রতি আস্থা রাখার মতো পারফর্মেন্স খুঁজে পাবেন আসন্ন সিরিজে। প্রত্যাশা ঠিক ততটুকুই করেন হয়ত ইশান্ত শর্মা ও তাঁর ভক্তরা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link