ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেন এর বিভিন্ন পর্যায়ের দলের হয়ে ম্যাচ খেলেছিলেন, খেলেছিলেন কোপেনহেগেন অনূর্ধ্ব ১৯ দলেও। কিন্তু দেশের মায়া ভুলতে পারেনি ছেলেটা। তাই নিজের তাগিদেই মা-বাবার কথা উপেক্ষা করে ২০১০ সালে আসার চেষ্টা করেন বাংলাদেশে। কিন্তু পাসপোর্ট জটিলতায় ফিরে যেতে হয়েছিল তাঁকে।
এরপর ২০১১ সালে বাংলার মাটিতে পা রাখলেও ভাগ্য তার সহায় হয়নি। নতুন স্থানে এসে পেরে উঠতে পারেনি ছেলেটা, দ্রুতই হাঁপিয়ে উঠেছিল। বাধ্য হয়ে তাকে বাদ দিতে হয় কোচদের। জাতীয় দলের কাছে গিয়েও সেবার ফিরে যেতে হয় তাকে।
আর সেই শোককে শক্তিতে পরিণত করেই তৎকালীন বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের কোচ লোডভিক ডি ক্রুইফের ডাকে সাড়া দিয়ে ২০১৩ সালে ক্যাম্পে ট্রায়াল দিয়ে বাজিমাৎ করেন এই ফুটবলার। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। দেশের হয়ে লাল-সবুজের জার্সি গায়ে অভিষেকটাও হয়ে যায় নেপালে অনুষ্ঠিত সাফে।
ডেনমার্ক, কোপেনহেগেন, বাংলাদেশ ফুটবল; নিশ্চয়ই বুঝেছেন কার কথা বলা হচ্ছে। জ্বী, বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়া’র বাংলার ফুটবলে পা রাখার গল্পই বলা হয়েছে।
ষাটের দশকে জামাল ভূঁইয়ার বাবা-মা পাড়ি দেন ডেনমার্কের উদ্দেশ্যে। জামালের জন্মও হয়েছিল ডেনমার্কেই। ১৯৯০ সালের ১০ এপ্রিল জন্ম নেন তিনি।
ছোটবেলা থেকেই ফুটবলের প্রতি ঝোঁক ছিল জামালের। ক্যারিয়ারের শুরুতে ডেনমার্কের বিভিন্ন পর্যায়ে খেলেছিলেন, এরপর বাংলার লাল-সবুজ জার্সি গায়ে জড়িয়েছেন। শুরুতে কষ্টকর ছিল জামালের জন্য তবে সুযোগ পাওয়ার পর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
২০১৪ সালে শেখ জামাল ধানমণ্ডি ক্লাবের সাথে প্রথম চুক্তি করেন জামাল। সে সময় টাকার অঙ্কে স্থানীয় ফুটবলারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেতনভুক্ত খেলোয়াড়ও ছিলেন তিনি। পরের মৌসুমে অবশ্য চুক্তি করেন ক্লাব শেখ রাসেল ক্রীড়াচক্রের সঙ্গে। এখন সাইফ স্পোর্টিং ক্লাবের হয়েই খেলছেন জামাল ভূঁইয়া। কলকাতা মোহামেডানের হয়ে ভারতীয় আইলিগে খেলারও অভিজ্ঞতা রয়েছে তা&র।
জামাল ভূঁইয়া’র জাতীয় দলে অভিষেক হয়েছিল ২০১৩ সালে, তবে লাইমলাইটে প্রথম আসেন ২০১৫ সালে। সেবছর আট দল নিয়ে অনুষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু গোল্ড কাপে রানার আপ হয়েছিল বাংলাদেশ, আর টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের পুরুষ্কার জিতেছিলেন জামাল ভূঁইয়া। পারফরম্যান্স দিয়ে ধীরে ধীরে একসময় দলের অপরিহার্য হয়ে উঠেছিলেন।
২০১৬ সালে ভুটানের বিপক্ষে ৩-১ গোলে হেরে বসে বাংলাদেশ। থমকে যায় বাংলার ফুটবল, দুই বছরের জন্য নির্বাসিত হয়ে পড়ে দেশের ফুটবল। বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসে ভুটান ট্রাজেডি নামে পরিচিত হয়ে উঠে এই ঘটনা। সেই ম্যাচে ছিলেন না জামাল ভূঁইয়া। নির্বাসন থেকে ফেরার পরে তার হাতেই তুলে দেয়া হয় লাল-সবুজের আর্মব্যান্ড। ২০১৮ সালে প্রথমবার দেশের মাটিতে অনুষ্ঠিত সাফ ফুটবলে অধিনায়কত্ব করতে নেমেছিলেন জামাল।
প্রথম ম্যাচে ভুটানকে হারিয়েছিল বাংলাদেশ, পরের ম্যাচে পাকিস্তান-কেও হারানোর স্বাদ পেয়েছিল। ঝিমিয়ে পড়া ফুটবল জামালের নেতৃত্বে আবারো জেগে উঠেছিল। ২০২২ বিশ্বকাপের প্লে-অফে লাওস’কে হারিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বকাপ বাছাই পর্বে জায়গা করতে সক্ষম হয়।
বাছাই পর্বের প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশ হেরে যায় আফগানিস্তানের বিপক্ষে, দ্বিতীয় ম্যাচে কাতারের কাছেও হার। তবে পরিবর্তন ঘটেছিল খেলোয়াড়দের মানসিকতায়। আগের মত ঝিমানো ফুটবল নয়, বরং নব্বই মিনিট ধরে প্রতিপক্ষের সাথে সমানে সমানে টক্কর দেয়া শুরু করে বাংলার ফুটবলাররা। এমন পরিবর্তনের পিছনে নিঃসন্দেহে অধিনায়ক জামালের বড় অবদান রয়েছে।
২০১৯ সালের ১৫ই অক্টোবর, কলকাতার সল্টলেকে বিশ্বকাপ বাছাইয়ের ম্যাচ খেলতে নেমেছিল ভারত-বাংলাদেশ। সল্ট লেক তখন বিভোর বিশাল জয়ের স্বপ্নে, অধিনায়ক সুনীল ছেত্রীর হ্যাটট্রিকের স্বপ্নে। কিন্তু পুরো গ্যালারি-কে স্তব্ধ করে দিয়ে ম্যাচের ৪২ মিনিটে গোল করে বসে বাংলাদেশ।
অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়ার দুর্দান্ত এক ফ্রি-কিকে মাথা ছুঁয়ে গোল করেছিলেন সাদ উদ্দিন। ম্যাচের শেষ দিকে অবশ্য গোল হজম করায় ড্র নিয়েই মাঠ ছাড়তে হয়েছিল বাংলাদেশকে তবে জামালের নেতৃত্বে সেদিন ফুটবল দল সবার হৃদয় জিতেই ফিরেছিল বাংলাদেশে।
বৈশ্বিক ফুটবলে অনেকটাই পিছিয়ে থাকা বাংলাদেশ দলে জামাল ভূঁইয়া হয়তো কোন সুপারস্টার নয়, দেশ সেরা কয়েকজনের একজন বড়জোর। কিন্তু অদম্য মানসিকতা জামালকে আলাদা করেছে সবার চেয়ে। লড়াই করেছেন, লড়াই করতে শিখিয়েছেন; উজ্জীবিত করেছেন মাঠের সবাইকে। হয়েছেন ফুটবলের পোস্টার বয়।
ডেনমার্কে এক পার্টিতে দূর্বৃত্তদের গোলাগুলিতে একবার চার – চারটি গুলি লেগেছিল ছোট্ট জামালের। কিন্তু লড়াই করে ঠিকই জীবন যুদ্ধে জিতেছিলেন। সূদুর ডেনমার্কের আভিজাত্যের মায়া ছেড়ে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে এসেছেন বাংলাদেশ ফুটবলে, ব্যর্থ হয়েছেন তবে হাল ছাড়েন নি। চারটে গুলি লাগার পরেও হারতে না শেখা, কিংবা স্বপ্নের পিছু ছুটতে গিয়ে থামতে না শেখা জামাল ভূঁইয়ারা-ই আমাদের অনুপ্রেরণা।