খারাপ, ভাল নাকি খুব ভাল -বেলিম আসলে কি!

আজকাল মাঝে মধ্যে তাঁকে বিশ্লেষক হিসেবে টিভি পর্দায় খুঁজে পাওয়া যায়। কিশোর বয়সী ছেলে হয়তো তখন আবিষ্কার করে, কোনো এক অজানা কারণে তার ক্রিকেটপাগল বাবা হাসছেন। জাভেদ ওমরকে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট কিভাবে খেলতে হয়, এ নিয়ে সরাসরি সম্প্রচারিত অনুষ্ঠানে জ্ঞান ঝাড়তে দেখলে, বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল) শহীদ আফ্রিদির দল রংপুর রাইডার্সকে কোচিং করানোর খবর রাখলে, কোন বাবা না হেসে থাকতে পারেন!

হয়তোবা এ লেখা যখন পড়ছেন, তখন আপনিও বলে উঠছেন, ‘কি? ও আফ্রিদিকে টি-টোয়েন্টি খেলা শেখাচ্ছে? কিভাবে টি-টোয়েন্টিতে বল ডিফেন্ড করতে হয়, সেটাই শেখাচ্ছে তো!’

মাঠের ভেতরে কিংবা বাইরে, জাভেদ ওমর যেন ছিলেন ধৈর্যের প্রতিমূর্তি। বলের পর বল ডিফেন্ড করে যেতেন বলে, যারা টিভি সেটের এপাশটায় বসে তাঁকে ব্যাট করতে দেখেছেন, তারাও বলবেন, ‘আমাদেরও অনেক সহিষ্ণু হতে হয়েছিল।’

এটা বোধকরি জাভেদ ওমরেরই কৃতিত্ব, আজ খেলা ছাড়ার এগারো বছর পরেও তাঁকে ঘিরে এখনও সেই ক্রিকেট ক্যারিয়ারের দিনগুলোর মতোই আলোচনা-সমালোচনা চলছে। কোনো এক ব্যাটসম্যান ক্রিজে একটু সংগ্রাম করছেন, রান তুলতে পারছেন না, ওই জাভেদ ওমরই ভরসা!

‘ওর ব্যাটিং দেখ! রান রেটকে কই নামাইছে, পুরা গোল্লার (জাভেদ ওমর) কার্বন কপি।’

‘ও জাভেদ ওমরের মতোই স্লো!’

এখানেই শেষ নয়। দ্রুত উইকেট পড়ে যাচ্ছে? এক প্রান্ত আগলে ধরে রাখবার কেউ নেই? কোথায় যাওয়া যায়? আহা, এদেশের ক্রিকেটে জাভেদ ওমর বেলিম এসেছিলেন তো!

‘আজ যদি বেলিম থাকতো! একটা উইকেট তো বাঁচতো!’

‘বাংলাদেশ দলে এখন জাভেদ ওমরের মতোই কাউকে দরকার। উনি জানতেন, কিভাবে বোলারদের উইকেট না দিয়ে হতাশ করে দিতে হয়।’

তিনি খেলেছেন, সে খেলা কাউকে মুগ্ধ করেছে, এমন কথা তিনি নিজেও বলবেন না (যদিও তিনি চেষ্টা করেছিলেন)। আর এখন অবসরের পরে তিনি যখন কোনো আলোচনায় প্রবেশ করেন, সবার আগে তাকে নিয়ে হাসাহাসি হয়, কখনো কখনো তার কথা কিছু কিছু মানুষের মনে সহানুভূতি জাগায়, এবং বাদবাকি সব সাবেক ক্রিকেটারের মতোই, আবার ভুলেও যাওয়া হয়

ওমর আর আমার চাচাতো ভাই, নব্বই দশকের গোড়ায় একই দলের হয়ে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে খেলেছিলেন। আমার দাদাবাড়িতে আমাদের দেখা হলেই, বেলিম আমার চুল এলোমেলো করে দিত। সেই সময়ে তিনি ততটা পরিচিতি পাননি, তবে তার ব্যাটিং টেকনিক দেখে তাকে টেস্ট ব্যাটসম্যান বলে ভাবা হতো, অনেকটা আতহার আলী খানের মতোই।

জাভেদ ওমর, আতহার আলী খান কিংবা সেলিম শহীদের মতো স্টাইলিশ ছিলেন না, তাই কেউই তাঁকে পছন্দ করতো না। হাবিবুল বাশার ছিলেন মারমার কাটকাট ব্যাটসম্যান। আকরাম খান, মিনহাজুল আবেদীন, আমিনুল ইসলামরা ছিলেন নায়ক। মোহাম্মদ রফিক অর্জন করেছিলেন জনপ্রিয়তা। সেখানে বেলিমের মতো ঠুকঠুক ব্যাটসম্যানের জায়গা কোথায়!

জাভেদ ওমর বেড়ে উঠেছিলেন ঢাকার বকশীবাজারে। বেড়ে ওঠার সময়ে তিনি এমন জায়গায় ক্রিকেট খেলেছেন, যা আমার কাছে হাতের তালুর মতোই চেনা। যে জায়গায় সকালের নাস্তা হিসেবে নেহারি খাওয়া হয়, দুপুরে তেহারি। তবে এমন এলাকায় থেকেও তিনি ছিলেন দেশের সবচেয়ে ফিট ক্রিকেটারদের একজন!

একবার আমি তার কাছ থেকে ফিটনেস নিয়ে খুব দারুণ এক পরামর্শ পেয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন, প্রতি আন্তর্জাতিক ম্যাচের আগের রাতে তিনি ৯-১০ লিটারের মতো পানি পান করতেন, যেন ঘুম থেকে উঠে তার নিজেকে পুরোপুরি তরতাজা মনে হয়। নিজের জীবনে প্রয়োগের অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, ‘এটা কাজে দেয়।’

তৎকালীন সময়ে বাংলাদেশ দলে তাঁর মতো ফিট কেউ ছিলেন না, কিন্তু তার ব্যাটিং দর্শক টানতে সব সময়ই ব্যর্থ হতো। ১৯৯৮ সালে তার ব্যাটিং কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল, এক ম্যাচে জাভাগাল শ্রীনাথকে দারুণ এক স্কয়ার কাটে চার মারলেন তিনি, দর্শকেরাও নড়েচড়ে বসলেন। কিন্তু ওমরও আউট হলেন, দেবাশিস মোহান্তির বলে।

অনেক ভালো ভালো বোলারকে তিনি কাটিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন, তার হ্যান্ড-আই কো-অর্ডিন্যাশনের দ্বারা, যদিও অনেক সময়ই এরকম ব্যাটিং প্রশ্ন জাগাতো। এমন অনেকবারই হয়েছে, তিনি বল ব্যাট দিয়ে না খেলে, তার গাঁট্টাগোট্টা শরীর দিয়ে ঠেকিয়েছেন। তার ব্যাটিং তাই দর্শকের চোখে মায়াঞ্জন বুলিয়ে দিতো না, তবে কাজের কাজটা ঠিকই করে নিতো।

৪০ টেস্টে ২২.০৫ গড়ে ১৭২০ রান, পাকিস্তানের শোয়েব আকতার, উমর গুল, সাব্বির আহমেদ, দানিশ কানেরিয়াদের বিরুদ্ধে সেঞ্চুরি, তার ক্যারিয়ারের হাইলাইটস এতটুকুই। তবে জাভেদ ওমর বললেই সব ছাপিয়ে উঠে আসে, বাংলাদেশের হয়ে এক টেস্ট ইনিংসে আদ্যন্ত ব্যাটিং করবার একমাত্র কীর্তির গল্প। এখনও, তিনি ব্যতীত বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মাঝে কেবল তামিম ইকবাল আর মুশফিকুর রহিমের পাঁচ ঘণ্টাব্যাপী ইনিংস আছে, ওপেনিং-য়ে তামিম ইকবাল আর ইমরুল কায়েসেরই তাঁর চেয়ে বেশি রান আছে।

বাংলাদেশ টেস্ট স্ট্যাটাস পাবার পরের প্রথম সাত বছর ছিলো রীতিমতো বিভীষিকা। চাপ ছিলো বোর্ড থেকে, দর্শকমহল থেকে, মিডিয়া হতে, অন্য টেস্ট খেলুড়ে দেশ হতে। এমন প্রেশারকুকারের মাঝেও কয়েকজন ছিলেন, যাদের দেখলে মনে হতো, তারা হেরেছেন, কিন্তু দলের জন্যে নিজেদের সেরাটা দিয়েছেন। হাবিবুল বাশার, খালেদ মাসুদ, মোহাম্মদ রফিকরা এ দলে ছিলেন। এ দলে জাভেদ ওমর বেলিমও ছিলেন।

অনেকেই মনে করেন, তাঁর টেস্ট অভিষেক আরও এক টেস্ট আগে হওয়াই উচিৎ ছিলো। ২০০০ সালের ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের প্রথম টেস্টে তাঁর থাকা উচিৎ ছিলো, কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে তিনি সেবার উপেক্ষিত ছিলেন। তার বদলে, মেহরাব হোসেন কিংবা শাহরিয়ার হোসেনের মতো স্ট্রোক মেকাররা সুযোগ পেয়ে গিয়েছিলেন। এ যেন তার গোটা খেলোয়াড়ি জীবনেরই গল্প। মেহরাব, শাহরিয়ার হোসেন কিংবা আল শাহরিয়ার রোকনের আড়ালে তিনি ঢাকা পড়েছেন সবসময়ই।

দর্শকেরা তাদের স্ট্রোকপ্লেতে মুগ্ধ তো হতেনই, নির্বাচকদের দৃষ্টিও ছিলো তাদের দিকেই। তৎকালীন এক নির্বাচক রোকনকে ডাকতেন ‘বিএমডব্লিউ’ বলে, তাঁর ড্রাইভের সাবলীলতা দেখে।

২০০১ সালের এপ্রিলে, বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের প্রথম টেস্টে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৬২ আর অপরাজিত ৮৫ রানের ইনিংস খেলে নিজের যথার্থতার প্রমাণ দেন জাভেদ ওমর। তবে এই রানগুলো দেখেও যেন কেউ দেখেনি। অপর প্রান্তে হাবিবুল বাশার তুলোধোনা করছেন বোলারদের অথবা মোহাম্মদ আশরাফুল জাদু দেখাচ্ছেন ব্যাট হাতে, এর মাঝে তার সংগ্রাম চোখে পড়বে কি করে!

জাভেদ ওমরকে তাই সহসাই উপেক্ষা করা যেতো, কিন্তু তৎকালীন প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ দলে তার চেয়ে জরুরী ক্রিকেটার আর একজনও ছিলেন না। ২০০৩ সালে পেশোয়ারে ১১৯ রানের ইনিংস খেলতে তিনি আট ঘণ্টা লাগিয়েছিলেন।

এর ১৬ মাস পরে, তিনি তামিম ইকবালের বড় ভাই নাফিস ইকবালের সঙ্গে বাংলাদেশের হয়ে সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী ওপেনিং জুটি গড়েছিলেন, বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট সিরিজ জয়ে যা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তামিম ইকবাল-ইমরুল কায়েসের ৩১২ রানের জুটিও তাদের ৮৩ ওভার স্থায়ী জুটিকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি। ওই ৮৩ ওভারে তারা কত রান তুলেছিলেন? ১৪২!

এভাবে মাটি কামড়ে আঁকড়ে থাকাটা যে অভিশাপ বয়ে এনেছিলো, তা হচ্ছে, ‘টেস্ট ব্যাটসম্যান’ ট্যাগ। যদিও গত শতাব্দীর শেষার্ধে কিংবা এ শতাব্দীর শুরুর দিকে টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়াটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো, কিন্তু বাংলাদেশের ক্রিকেট সংস্কৃতি সবসময়ই একদিনের ক্রিকেটের জন্যই তৈরি ছিলো। এদেশে সব প্লেয়ারকেই তাদের ওয়ানডের উপযোগিতা দিয়ে মাপা হতো, এখনও তাই হয়। তাইতো, তাঁর সময়ে তিনি বাংলাদেশের পক্ষে ২য় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হলেও, তার ৫১.৭৬ স্ট্রাইক রেট ছিলো দলের সর্বনিম্ন, অন্ততপক্ষে যারা ১০ ইনিংসে বাংলাদেশের হয়ে ব্যাট হাতে মাঠে নেমেছিলেন।

ওমর ছিলেন সঠিক সময়ে সঠিক ব্যক্তি, কিন্তু তিনি পড়েছিলেন ভুল কিছু দর্শকের সামনে, ভুল কিছু মানুষের সামনে। তাই দর্শকেরা, মিডিয়া কিংবা নির্বাচকেরা যে নিক্তিতে তাকে মেপেছিলেন, সে দাঁড়িপাল্লাই খুব সম্ভবত ভুল ছিলো। এটাই প্রমাণ করে, বাংলাদেশে টেস্ট ক্রিকেটের মর্যাদা ঠিক কতটা!

২০১৩ সালে, এক প্রোগ্রামে অংশ নিতে বেলিম শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে এসেছিলেন। পরিচিত সাংবাদিক পেয়ে শুরু আলাপচারিতা হঠাৎ করেই দিক বদলে রূপ নেয় ‘অবসর কবে নিচ্ছেন’ এই আলোচনায়। কমবয়সী এক সাংবাদিক আশ্চর্যান্বিত হলেন এ শুনে যে তিনি তখনও (২০১৩ সালে) আনুষ্ঠানিকভাবে অবসর নেননি। অবসর না নেওয়া যেন তাঁর প্রতিবাদেরই ধরন, যে প্রতিবাদ, ২০০৭ সালে শ্রীলঙ্কা সফর থেকে ফিরে কোনো কারণ না জানিয়েই তাকে বাদ দেবার বিরুদ্ধে।

অবশ্য বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে আনুষ্ঠানিকভাবে অবসর নেবার সৌভাগ্য অনেকেরই হয়নি। প্রথম টেস্টের নায়ক আমিনুল ইসলামও কিন্তু এখনও সাবেক হননি, তিনিও যে এখনও ঘোষণা দেননি।

অবশ্য জাভেদ ওমরের অবসর না নেয়ার এ খবর জানাজানি হবার পরে বাংলাদেশ ক্রীড়ালেখক সমিতি তার সম্মানে এক বিদায়ী ম্যাচের আয়োজন করে, যে ম্যাচে মাশরাফি মোর্তজাও খেলেছিলেন। আরও কয়েকজন সাবেক ক্রিকেটারের সঙ্গে সেখানে তামিম ইকবালও ছিলেন।

সে ম্যাচে অবশ্য জাভেদ ওমর মাটি কামড়ে থাকেননি, তবে জীবনে প্রথমবারের মতো বোধহয় মাঠে তাঁর প্রবেশ কিংবা মাঠ ত্যাগ দর্শকের হাততালি কুড়িয়েছে। এই হাততালিই বোধহয় সে শীতের বিকেলে তাঁর চোখে জল এনেছিলো, পুরো ক্যারিয়ার জুড়েই যা তাঁর প্রাপ্য ছিলো। এই হাততালি পাবার জন্যে কত কিছুই না তিনি করেছিলেন, কিন্তু বাংলাদেশের ক্রিকেট কখনোই তা দেখে গলে পড়েনি।

তবে বাংলাদেশের ক্রিকেটে তাঁর চিরস্থায়ী জায়গা বোধহয় নিশ্চিত। ‘কেন জাভেদ ওমরের মতো এত আস্তে আস্তে খেলছো!’ থেকে ‘আজ যদি জাভেদ ওমর থাকতো!’ ভালো হোক কিংবা খারাপ, জাভেদ ওমরের সাথে তুলনা দেয়া ছাড়া যে চলা যাচ্ছে না। তাঁকে ভুলি কি করে!

_______________

Javed Omar, no, yes, sorry শিরোনামে মূল লেখাটি দ্য ক্রিকেট মান্থলিতে লিখেছেন ইএসপিএন ক্রিকইনফো’র বাংলাদেশ প্রতিনিধি মোহাম্মদ ইশাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link