ব্রাত্য রাজার নীরব লড়াই

বাংলাদেশকে, বাংলাদেশের মাটিকে মনে রাখার কথা মিশ্রর। ২০১০ সালের বাংলাদেশ সফরে চট্টগ্রাম টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে নাইটওয়াচম্যান হিসেবে তিনে নেমে ৭০ বলে ৫০ রান করেছিলেন। চতুর্থ ইনিংসে জয়ের জন্য বাংলাদেশের সামনে ছিল ৪১৫ রানের লক্ষ্য। সেখানে তামিম ইকবালের হাফ সেঞ্চুরি ও মুশফিকুর রহিমের সেঞ্চুরিতে বাংলাদেশ ৩০১ রানে অলআউট হয়। কে জানে, অমিত মিশ্র’র অভাবনীয় ব্যাটিং না করলে হয়তো ফলাফলটা অন্যরকম হত!

২০০০-০৮ এই সময়টায় ভারতের স্পিন বিভাগের নেতৃত্বে ছিলেন কিংবদন্তি অনিল কুম্বলে। এর পরবর্তী সময়ে তার দায়িত্ব নেন হরভজন সিং, রবিচন্দ্রন অশ্বিন ও রবিন্দ্র জাদেজারা।

এর মাঝে বেশ কিছু প্রতিভাবান স্পিনার আসলেও জাতীয় দলে ভীত গড়তে পারেননি। তেমনি একজন হলেন লেগ স্পিনার অমিত মিশ্র। ২০০৩ সালে যখন তার টেস্ট অভিষেক হয় তখন ভারতীয় দলের স্পিন বিভাগের মূল সৈনিক অনিল কুম্বলে। একসাথে দুই লেগ স্পিনার তো আর দলে থাকবে না। তাই গুটি কয়েক ম্যাচে সুযোগ পেয়ে পারফর্ম করলেও কপাল পুড়ে মিশ্রর।

বর্তমানে তাঁকে অবশ্য আইপিএল কিং বললেই ভালো হয়। জাতীয় দল থেকে তিনি ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল) বরং বেশ সমৃদ্ধ ক্যারিয়ার গড়তে পেরেছেন ৷ আইপিএলে তাঁর রেকর্ডও রয়েছে বেশ! এখন পর্যন্ত তিনটি হ্যাট্রিকের রেকর্ড করেছেন যা আর কারোই নেই।

আইপিএলে ১৫৪ ম্যাচে নিয়েছেন ১৬৬ উইকেট! যা কিনা আইপিএল ইতিহাসের তৃতীয় সর্বোচ্চ উইকেট। সামনে আছেন কেবল শ্রীলঙ্কার লাসিথ মালিঙ্গা (১৭০) ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের ডোয়াইন ব্রাভো (১৬৭)। আর মাত্র চার উইকেট পেলেই তিনি হবেন আইপিএলের ইতিহাসের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি। ভারতীয় ক্রিকেট সার্কিটে অবশ্য তাঁকে নিয়ে আলোচনা হয় সামান্যই। নীরবেই নিজের কাজটা লম্বা সময় ধরে করে চলেছেন তিনি।

তার পুরো নাম অমিত মিশ্র। ২৪ নভেম্বর ১৯৮২ সালে দিল্লীতে জন্ম। বাবা এস এম মিশ্র ও মা চন্দ্রকলা মিশ্র। বাবা ছিলেন রেলওয়ের একজন কর্মচারী! সাত ভাই বোন সহ নয় জনের সংসার চালাতে বাবার বেশ কষ্টই হতো। ছোট বেলা থেকে মিশ্র চাইতেন তিনি একজন ব্যাটসম্যান হবেন। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে বেশ কষ্ট করে বেড়ে ওঠা অমিত মিশ্র জানতেনই না তার প্রতিভা রয়েছে লেগ স্পিনে। তার কোচ সাঞ্জে ভরত্তজই তার প্রতিভা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেন।

২০০০ সালের দিকে এসে বাঁক নেয় মিশ্রর ক্যারিয়ার। হারিয়ানা রাজ্যে ক্রিকেটে তখন লেগ স্পিনারের প্রয়োজন ছিলো। নিজ রাজ্যে উপেক্ষিত হয়ে তাই মিশ্র পাড়ি জমান হারিয়ানার উদ্দেশ্যে। এরপর সেখানে অনূর্ধ্ব-১৭ দলের হয়ে সুযোগ পেয়ে গেলেন। বোলার হিসেবে দলে নিলেও মিশ্র পারফর্ম করলেন ব্যাট হাতে!

বল হাতে ছিলেন বিবর্ণ। তবে এরপরের ম্যাচ থেকেই বল হাতে নিজের প্রতিভা দেখাতে শুরু করেন মিশ্র। সেই মৌসুমে হারিয়ানার হয়ে বল হাতে ৫৫ উইকেট শিকার করেন তিনি! এরপর হারিয়ানার হয়ে রঞ্জি ট্রফিতেও সুযোগ পান এই লেগ স্পিনার। নিজের খেলা প্রথম মৌসুমেই শিকার করেন ৩২ উইকেট।

২০০২ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্টে ডাক পেলেও সুযোগ পাননি কোনো ম্যাচেই। এরপর দীর্ঘ ৬ বছর অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ২০০৮ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্টে অভিষেক হয় অমিত মিশ্রর। অনিল কুম্বলের ইনজুরিতে দ্বিতীয় টেস্টে সুযোগ পেয়েই প্রথম ইনিংসে শিকার করেন পাঁচ উইকেট!

ভমন কুমার ও নরেন্দ্র হিরওয়ানির পর তৃতীয় ভারতীয় লেগ স্পিনার হিসেবে অভিষেকেই পাঁচ উইকেট শিকার করার কীর্তি গড়েন মিশ্র। কিন্তু তৎকালীন ভারতের কোচ গ্যারি কার্স্টেন বলেন, কুম্বলে পরের ম্যাচে রিকোভার হলে বাদ পড়বেন মিশ্র! অনেকটা এভাবেই উপেক্ষিত থেকে জাতীয় দলে আক্ষেপে কপাল পুড়েছেন এই লেগি!

কখনো অনিল কুম্বলে, কখনো হরভজন তো কখনো প্রজ্ঞান ওঝার কাছে জায়গা খুইয়েছেন মিশ্র। বাংলাদেশের বিপক্ষে চট্রগ্রাম টেস্টে হরভজনের ইনজুরিতে দলে সুযোগ পায় মিশ্র। ৭ উইকেট নেওয়ার পাশাপাশি দ্বিতীয় ইনিংসে ফিফটি করার পরেও ওঝা ফিরলে পরের টেস্টেই বাদ পড়েন তিনি!

অনেকটা ইনজুরি ব্যাকআপ বোলার হিসেবে জাতীয় দলে আসা-যাওয়া করতেন তিনি।

টেস্টে ২০০৮ সালে অভিষেক হলেও ওয়ানডেতে অবশ্য তার অভিষেক হয়েছিলো ২০০৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে। ২০০৯ সালের দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে খেলেন তিনি। ২০১৩ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে ডাক পান মিশ্র।

৫ ম্যাচের দ্বিপাক্ষিক সিরিজে ১৮ উইকেট নিয়ে বিশ্ব রেকর্ড গড়েন মিশ্র। এর আগে ৭ ম্যাচে সমান সংখ্যাক উইকেট নিয়ে এই রেকর্ড নিজের আয়ত্তে রেখেছিলেন জাভাগাল শ্রীনাথ। ২০১৬ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজে ৫ ম্যাচে ১৫ উইকেট নিয়ে তিনি সিরিজ সেরা পুরষ্কার জেতেন।

টেস্ট ও ওয়ানডেতে খানিকটা সুযোগ পেলেও টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে তিনি ছিলেন সবচেয়ে উপেক্ষিত। ২০১০ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি অভিষেক হবার পর মোটে ৮টি টি-টোয়েন্টিতে সুযোগ পান মিশ্র!

২০১৬ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজে তিনি এক ম্যাচে ২৪ রানে ৩ উইকেট শিকার করেন যা তার ক্যারিয়ার সেরা। ২০১৮-১৯ বিজয় হাজারে ট্রফিতে ৯ ম্যাচে ১৬ উইকেট নিয়ে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী ছিলেন তিনি। তবুও চাহাল-অশ্বিন, জাদেজাদের ভীড়ে আর সুযোগ হয়নি জাতীয় দলে।

আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে ২২ টেস্টে ৪ ফিফটিতে ৬৪৮ রান করার পাশাপাশি নিয়েছেন ৭৬টি উইকেট। ৩৬ টি ওয়ানডেতে নিয়েছেন ৬৪ উইকেট, দুইবার শিকার করেন ৫ উইকেট করে। এছাড়া মাত্র ৮ টি-টোয়েন্টিতে শিকার করেন ১৪ উইকেট। ভুল সময়ে জন্ম না নিলে দিব্যি লম্বা সময় সার্ভিস দিতে পারতেন দলকে।

ক্যারিয়ারে উপেক্ষিত থাকা ছাড়াও নারীজনিত কাণ্ডে জড়িয়ে জেলও খেটেছেন তিনি। ২০১৫ সালে তার নারী বন্ধুর করা মামলায় ব্যাঙ্গালুরু পুলিশ মিশ্রকে আটক করে। তার নারী বন্ধু ফাইলে লিখেন যে, মিশ্র তার দিকে হোটেল রুমে তাকে দেখার পর চায়ের কেটলি ছুঁড়ে মারে। এই ঘটনায় তাঁর বন্ধুর করা মামলায় প্রায় বেশ কিছুদিন জেলে কাঁটান মিশ্র। পরবর্তীতে জামিনে ছাড়া পান তিনি।

আইপিএলে প্রতি মৌসুমেই বল হাতে এখনো নিদারুণ পারফরম্যান্স করে যাচ্ছেন ৩৯ বছর বয়সী এই মিশ্র। আন্তর্জাতিক না শুধু ঘরোয়া ক্রিকেটেও তিনি প্রায় ফুরিয়ে এসেছেন। তবে তার স্পিন ভেলকিতে ব্যাটসম্যানদের বোকা বানাতে এখনো কম জান না তিনি!

ক্যারিয়ারের পুরোটা সময় জুড়েই কারো না কারো ছায়ায় নিজের ক্যারিয়ারটা খুইয়ে দিয়েছেন তিনি। ক্রিকেট থেকে অবসরের পর হয়তো আইপিএল কিং হিসেবে তিনি স্মরনীয় হয়ে থাকবেন তবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আক্ষেপের তালিকায়ও থাকবেন এই প্রতিভাবান!

বাংলাদেশকে, বাংলাদেশের মাটিকে মনে রাখার কথা মিশ্রর। ২০১০ সালের বাংলাদেশ সফরে চট্টগ্রাম টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে নাইটওয়াচম্যান হিসেবে তিনে নেমে ৭০ বলে ৫০ রান করেছিলেন। চতুর্থ ইনিংসে জয়ের জন্য বাংলাদেশের সামনে ছিল ৪১৫ রানের লক্ষ্য। সেখানে তামিম ইকবালের হাফ সেঞ্চুরি ও মুশফিকুর রহিমের সেঞ্চুরিতে বাংলাদেশ ৩০১ রানে অলআউট হয়। কে জানে, অমিত মিশ্র’র অভাবনীয় ব্যাটিং না করলে হয়তো ফলাফলটা অন্যরকম হত!

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...