ফুটবল অদ্ভুত এক অনুভূতির নাম; এই অনুভূতি ঠিক কতটা সুখের আর কতটা দুঃখের সেইটা নিয়ে এক সুবিশাল বাকবিতণ্ডা হয়ে যেতে পারে! আমার কাছে ফুটবল ভালো থাকার মন্ত্র, ফুটবলে ভালো থাকি, ভালো থাকার চেষ্টা করি! এই ফুটবল আমাকে যতটা ভালো রেখেছে, আবার দু:খে কষ্টে কখনো কখনো ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছে!
এইটাই ফুটবল নামক অনুভূতির রুপ, ফুটবল আপনাকে আনন্দে ভাসাবে, আবার এই ফুটবলই আপনাকে কাঁদাবে! গ্যালারির উল্লাসধ্বনিতে কখনো কখনো আপনার যান্ত্রিক জীবণের যাবতীয় ডিপ্রেশন মিলিয়ে যাবে, আবার কখনো বা সেই একই উল্লাসধ্বনি আপনাকে হতাশাগ্রস্ত করবে! স্বপ্ন দেখা, স্বপ্ন ভাঙা কিংবা তা দু:স্বপ্নে ছেঁয়ে যাওয়া, ফুটবলের দর্শকদের জন্য খুবই স্বাভাবিক রকমের ঘটনা! প্রিয় দল, প্রিয় খেলোয়াড়ের প্রতি আমরা স্বপ্ন দেখি, তারা আমাদের সেই স্বপ্ন দেখায় কিংবা তাদের প্রতি অগাধ ভালোবাসা সেই স্বপ্ন তৈরি করে, আর আবার তারাই সেই স্বপ্ন ভেঙে দেয়, কস্ট দেয়, প্রচন্ড রকমের মানষিক যন্ত্রণা দেয়!
প্রিয় দল ব্রাজিলের কথাই বলি, ২০০৫’র কথা খুবই যৎসামান্য মনে থাকলেও, ২০০৬ থেকে ব্রাজিল’কে অনুসরণ করা হয় নিয়মিত! দুঙ্গা অধ্যায় থেকে শুরু করে মানেজেস, স্কলারি অধ্যায় থেকে এখনকার তিতে অধ্যায় অবধি; দলের চরম উত্থান পতন কত কিছুরই তো সাক্ষী হলাম, কতবারই তো হতাশার চরম গভীরতায় নিমজ্জিত হলাম, কস্টে কত শত ব্যাথিত হলাম, দলের প্রতি ভালোবাসায় কখনও চির ধরেনি, এই হলুদ রঙ্গের অনুভুতি স্বপ্ন দেখতে নিরুৎসাহিত করেনি, একেকটা স্বপ্ন ভঙ্গ দলটাকে অধিক পরিমাণে ভালোবাসতে শেখায়, পুনরায় নতুন করে স্বপ্ন দেখায়!
২০২২ সালে ব্রাজিল ফেভারিট নয়; হলুদ জার্সির সমর্থকেরা এই সত্যটা উপলব্ধি করতে পারলে নতুন করে স্বপ্নভঙ্গের কষ্ট আপনাকে পোহাতে হবেনা! কিঞ্চিৎ তিতা হলেও, এটিই সত্যি! দলের কিছু কথায় আসি! ব্রাজিলের কোচ কতখানি সামর্থ্যবান, নাকি তিনি এই দল’কে কোচিং করানোর যোগ্যতা রাখেন না – সেই বিতর্ক আমার বিষয় নয়! প্রথমেই সেলেসাও সমর্থকদের মাথায় রাখতে হবে আপনাদের ফেডারেশন বিদেশি কোচের তকমায় বিশ্বাসী নন! এখন কেনো বিশ্বাসী নয়, আনলেই বা কি হবে, সেই তর্ক আলোচনা করে আমাদের কোন লাভ নেই! আরো কতদিন আমাদেরকে দেশি কোচের উপরেই ভরসা রাখতে হবে তাও সঠিক জানা নেই!
১৮ বিশ্বকাপ ব্যার্থতার পর নিজেদের রেওয়াজ ভেঙে তিতে’কে পুনরায় সুযোগ দেয় সিবিএফ! লক্ষ্য ছিলো ২০২২ বিশ্বকাপ! সে সময় গ্লোবোর এক রিপোর্টে জানা যায় – ২২ বিশ্বকাপ কে টার্গেট করে প্রস্তুতির সময়কে ৩ টি ধাপে ভাগ করেছিলেন টিতে; ১৯ কোপা আমেরিকা, ২০ কোপা আমেরিকা, ২০২০ – ২০২২ মধ্যবর্তী সময়। সেখানে জানা যায় ২০১৯ কোপা আমেরিকায় টিতে অভিজ্ঞ ও তারুণ্যের মিশেলে দল গঠন করবেন টিতে। ১৯ পরবর্তী সময়ে টিতে তার দলে আমুল পরিবর্তন আনবেন। এবং তার ইচ্ছা ২০ কোপা আমেরিকায় একটি তারুণ্য নির্ভর দল নিয়ে খেলানোর। এবং ২০ থেকে ২২ মধ্যবর্তী সময়ে তিনি তার দলকে বিশ্বকাপের জন্যে তৈরি করবেন।
তিনি ব্রাজিলের অনূর্ধ্ব ২০ কিংবা অনূর্ধ্ব ১৭ দলের কোচের সাথেও যোগাযোগ রাখবেন, যা পরবর্তীতে দলগঠনে ভুমিকা রাখবে! যদিও পরবর্তীতে ২০২০ অলিম্পিক কে সামনে রেখে নতুন পরিকল্পনায় যায় সিবিএফ, প্রতি ইন্টারন্যাশনাল ব্রেকেই জাতীয় দলের পাশাপাশি নিয়মিত অনূর্ধ্ব ২৩ দলকে খেলিয়েছে তাঁরা। এবং স্কোয়াড নির্ধারণে টিতে ও ব্রাজিল অলিম্পিক দলের কোচ আন্দ্রে জারদিন সমন্বিত ভুমিকা পালন করেছেন! এইখানে তিতে একদিকে যেমন কিছু অভিজ্ঞ প্লেয়ারদের নিয়ে এগিয়েছেন, অন্যদিকে অলিম্পিক দল অপেক্ষাকৃত তরুণ কিংবা যারা জাতীয় দলের রাডারে আছে তাদের নিয়েই এগিয়েছেন।
এতে করে গত ৩ বছর সার্বক্ষণিকভাবে ইন্টারন্যাশনাল ব্রেকে ৪০’র উপরে খেলোয়াড়েরা ব্রাজিলের জার্সি নিয়মিত গায়ে জড়িয়েছেন। এইখানে সমস্যা হয়েছে দুটো! কোপা আমেরিকা ও অলিম্পিক দুইটাই এক বছর পিছিয়ে যাওয়াতে বিশ্বকাপ ও কোপা আমেরিকার পরবর্তী সময়ের ব্যবধান কমেছে ১ বছর! যেখানে পরিকল্পনা অনুযায়ী ২ বছর দলটাকে বিশ্বকাপের জন্য তৈরি করার কথা ছিলো সেখানে আমরা পাচ্ছি মাত্র ১ বছর!
কেন এই কোপা আমেরিকাতেই দল নির্বাচনে সাহসী কিছু সিদ্ধান্ত কোচ নিলেননা তা আমার জানা নাই! অন্য আরেক সমস্যা হইলো যেই অলিম্পিক’কে ফোকাস করে আমরা এত পরিকল্পনা সাজালাম, সেই অলিম্পিকেই ক্লাবের নিয়মের বেড়াজালে খেলতে পারছেন না ব্রাজিলের রাডারে থাকা অনেককজন খেলোয়াড়! এতদিন যারা একসাথে খেলে একটা টিম কম্বিনেশন তৈরি করেছেন, অথচ আমাদের যে দল গিয়েছে তা সেই কম্বিনেশনের উলটো! এই অলিম্পিকে ব্রাজিলের খুব বেশিদূর যাওয়ার কথা না আসলে!
এইবার আসি, কোপা আমেরিকা পরবর্তী ব্রাজিল জাতীয় দল নিয়ে! বিশ্বকাপের আগে ব্রাজিলের হাতে আছে মোট ১৮ টি ম্যাচ! দল সাজাতে, দল’কে গোছাতে আপনার হাতে এই ১৮ টি ম্যাচই মাত্র অবশিষ্ট রয়েছে! তিতা হলেও সত্যি, ২২ বিশ্বকাপের দল আসলে এই কোপা আমেরিকার দলের চেয়ে খুব বেশি অপরিবর্তিত থাকবেনা! স্বল্পমাত্র কিছু পজিশন রয়েছে যেখানে পরিবির্তন আসতে পারে বা আসা উচিত! হয়ত রাইটব্যাক পজিশনে মেনিনো কিংবা দানিলোর একজনের অন্তর্ভুক্তি; লেফটে সান্দ্রো, এলেক্স টেলস, অলিম্পিক দলের গগুইয়ার্মে আরানার যেকোনো একজনের অন্তর্ভুক্তি!
সিবি পজিশনে সিলভাকে নিয়ে সংশয় আছে ব্যাক্তিগতভাবে, তবে চেলসিতে এই সিজনেও পারফর্ম করলে হয়ত ২২ বিশ্বকাপেও দেখা যাবে তাকে! যদিই ব্যাক্তিগতভাবে মনে করি ব্রাজিলের সিলভা অধ্যায় শেষ করা জরুরি! রাডারে থাকা বাকীরা হলেন ফেলিপে, মাগালহাস, দিয়েগো কার্লোস, রজার ইবানেজ, লুকাস ভেরিসিমো, এছাড়া কাইয়ো তো আছেনই! মিডফিল্ডারদের একটা পজিশনের জন্য লড়াইটা জমবে বেশ! ফ্রেড, আর্থুর, দগলাস লুইজ, ব্রুনো গুইমায়ারেস, গার্সন, আর্থারের যেকোনো ২ জন হয়ত কাতারের ফ্লাইট ধরবেন! সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কউতিনহো’র ফর্মে ফেরাটা।
পাকুয়েতা আছেন, অন্যদিকে এবারের অলিম্পিকে ডাক পাওয়া ক্লাউদিনহো খুব ভালোভাবেই রাডারে আছেন কোচের! এবার আসি ফরওয়ার্ড লাইন নিয়ে! সেপ্টেম্বরের কল আপ থেকেই একাদশে বহুল প্রতিক্ষিত পেদ্রো আর ম্যাথিউজ কুনহা কে নিয়মিত করানো দরকার! ববি জেসুসের চাইতে বেটার আউটপুট পেলে হয়ত ভালো, আর না পেলে তো কিছু বলার নাই! তবে এই দুজনকে দলে নিয়মিত সুযোগ দেওয়া দরকার লম্বা সময়! এছাড়া ২২’কে সামনে রেখে একটা জেনুইন রাইট উইঙ্গার তৈরি করা দরকার আসলে!
তিতেকে রাইট উইংগার না তৈরি করতে পারার অভিযোগ দেওয়া হয়, তিনি ম্যালকম কিংবা নেরেস’কে ডেকেছিলেন তার পিরিয়ডে, কেউই সুবিচার করতে পারেনি! ক্লাবেও খুব ভালো অবস্থানে আছেন কি তারা!? নেরেস ইনজুরিতে ছিলেন, রদ্রিগো ইনজুরিতে ছিলেন! আসছে সিজনে তাদের পারফর্মের উপরেই হয়ত আমাদের রাইট উইংগারের হালচাল নির্ভর করবে! একই কথা রাফিনহা’র ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, আমি জানিনা রাফিনহা’কে নিয়ে ম্যানেজমেন্টের কি চিন্তাভাবনা; তবে আমি বিশ্বাস করি রাফিনহা এই সিজনের শুরুতেও গত সিজনের ধারাবাহিকতা ধরে রাখলে দলে অবশ্যই জায়গা পাবেন রাফিনহা! এই মুহুর্তে এই পজিশনটার অভাব পুরণ করার জন্যে এই প্লেয়ারগুলোকে ট্রাই করার কোন বিকল্প নেই!
আগেই বলেছিলাম, আমরা ২২ বিশ্বকাপে ফেভারিট নই; এই সত্য মানতে আসলেই অসুবিধা নেই! কিন্তু একজন সমর্থক হিসেবে কখনোই আশা হারালে চলবে না, স্বপ্নই যদি না দেখি তবে সমর্থক নামক স্বত্তাটার মুল্যই তো হারিয়ে যায়! এই দলের ভালো সময়ে, ট্রফি উঁচিয়ে ধরার সুসময়ের স্বাদ যদি নিতে পারি তবে খারাপ সময়ে দু:খের ভার কেনো বহন করবোনা?
সময়ের সাথে জীবিকার টানে এই ফুটবলটাকে কি পরিমাণ সময় দেওয়া হবে অদুর ভবিষ্যতে তা নিয়ে সন্দিহান থাকলেও এই দলের প্রতি আমৃত্যু অকুন্ঠ সমর্থনে কোনই সন্দিহান নেই! ব্রাজিল তার ভালো সময়ে ফিরবে, ব্রাজিলকে ফিরতেই হবে!
শেষ করি, আর্জেন্টিনাকে অভিনন্দন জানিয়ে! আগেই বলেছিলাম – ফুটবল নামক অনুভূতি তার সমর্থকদের দুমুখো রুপ দেখায়, কখনো বিষাদের নীল রঙে ছেয়ে দেয় আবার কখনো সাত আসমানসম সুখের পরশ বুলিয়ে দেয়! দীর্ঘসময়ের বিষাদের নীল কাটিয়ে অবশেষে সুখের পরশ, দলের প্রতি নি:স্বার্থ ভালোবাসা আস্থা আর বিশ্বাসের প্রতিদানস্বরুপ এই আনন্দ উচ্ছাস আপনাদের প্রাপ্য!