‘আন্ডাররেটেড’ শব্দটা আজকাল সস্তা হয়ে গেছে। হঠাৎ হঠাৎই এই শিরোপা অনেকে অর্জন করে ফেলে। পিছন ফিরে তাকালে, ঘাঁটলে দেখা যাবে অনেকেই সেই তকমা অর্জন করার বিন্দুমাত্র যোগ্যতা পর্বও উত্তীর্ণ হতে পারেনি। অথচ দিয়ে দেওয়া হয়। তবু, যে লোকটা প্রিমিয়ার লিগের প্রথম সিজনে বোম্বাস্টিক পারফরমেন্স দিল এবং নিজের দ্বিতীয় ও তৃতীয় মৌসুমে প্লেয়ার অফ দ্য ইয়ার সম্মানে ভূষিত হল, তাকে নিয়ে শোরগোল তো হয়ই না বরং এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। একে আন্ডাররেটেড না বললে স্বয়ং ফুটবল দেবতা বড় অপমানিত বোধ করেন।
হুয়ান মাতা। ভ্যালেন্সিয়া থেকে বেশ বড় ট্রান্সফারে চেলসিতে আসার পেছনে ছিল আরেক স্বদেশীয়র মন্ত্রণা। লক্ষ্য করার, তিনিও সাবেক স্ট্রাইকারদের মধ্যে একজন আন্ডাররেটেডই। ফার্নান্দো তোরেস। মাতাকে চেলসিতে খেলানোর পিছনে তোরেসের একটা বড় ভূমিকা ছিল, সেটা মাতা বহুবার বহু জায়গায় বলেছে। অবশ্য স্পেনের স্বর্ণযুগ বলতে তো ঐ যুগটাকেই বোঝায়।
পরপর ইউরোপ আর বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য যে লেভেলে দক্ষতা প্রয়োজন, সেটা গোটা টিমের মধ্যেই ছিল। যে স্পেন টিমটা সংঘবদ্ধ চক্র হয়ে বিশ্বকাপ জিতে ইতিহাস গড়ল, তার ৮জন প্লেয়ারই তখন বার্সেলোনায় খেলছে। জাভি, ইনিয়েস্তা, বুস্কেটস, পুওল, ভিয়া – বাকিরা খেলছে রিয়াল মাদ্রিদে। যেমন রামোস, ক্যাসিয়াস। অথচ লক্ষ্যণীয়, সেই টিমের দু’জন কিন্তু খেলছে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে। সেস ফ্যাব্রেগাস এবং হুয়ান মাতা। আর্সেনাল এবং চেলসি। চিরাচরিত লন্ডন শহরের লড়াই বলতে যে দুটো ক্লাবকে বোঝায়।
সেই খুয়ান মাতা আসার পর চেলসির যা টিম দাঁড়াল, তাতে প্রিমিয়ার লিগ জেতা অবশ্যম্ভাবী ছিল। কিন্তু বহুদূর পৌঁছেও সেটা সম্ভব হয়নি কারণ মাঝপথে বেশ কয়েকটা ম্যাচে আনচেলোত্তির টিম গেল আটকে। ফলে সে বছর মাতার লিগ জেতা স্বপ্ন থেকে গেল। কিন্তু ২০১১-১২ সিজনে চেলসি ইউরোপে হয়ে উঠল ত্রাস! চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে পৌঁছে বিশ্বকে রীতিমতো হুঙ্কার দিচ্ছে তারা। এ হেন চেলসিকে আটকাতে প্রয়োজন ছিল আরেক ত্রাসের, যাদের সাথেই চেলসির ফাইনাল পড়েছিল আলিয়াঞ্জ এরিনায়। ক্লাবটার নাম – বায়ার্ন মিউনিখ!
রবেন, মুলার, রিবেরি, জাভি মার্টিনেজ, শোয়াইনস্টাইগার, ফিলিপ লাম সমৃদ্ধ বায়ার্ন চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনাল খেলতে নামছে তাদেরই ঘরের মাঠ আলিয়াঞ্জ এরিনায়। চেলসি খুব সুবিধে করতে পারবে এটা কেউই ভাবছে না, ভাবেওনি। খেলা শেষের মিনিট চারেক আগে মুলারের হেডেই যার পরিসমাপ্তি হওয়ার কথা ছিল, তা শেষমেষ হয়নি। হয়নি, কারণ চেলসিতে একজন হুয়ান মাতা ছিল।
চেলসিতে যার রোল ছিল ফ্রি প্লেয়ার হিসেবে। টিমের প্রয়োজনে কখনও সেকেন্ড স্ট্রাইকার, অর্থাৎ মেন ফরোয়ার্ডের একটু পিছন থেকে আক্রমণ শানানো প্লেয়ার, কখনও রাইট উইং থেকে ওয়াল খেলে চকিতে বক্সে ঢুকে পড়াই যার মূল লক্ষ্য ছিল। সেই খুয়ান মাতা এক্সট্রা টাইমে নিতে গেল কর্নার। যা থেকে হেডে গোল করে সমতা ফেরাবে সদ্য প্রিমিয়ার লিগের হল অফ ফেমে একমাত্র আফ্রিকান প্লেয়ার হিসেবে সুযোগ পাওয়া দিদিয়ের দ্রগবা।
‘চিন্তা করো না, আমরাই জিতব। বিশ্বাস রাখো, হারব না।’ – অনেক বছর পরে মাতা সম্পর্কে দ্রগবার এই উক্তি।
খুয়ান মাতা। আন্ডাররেটেড খুয়ান মাতা। ২৩ মিলিয়নে ভ্যালেন্সিয়া থেকে চেলসিতে যোগ দেওয়ার পর লিগ পাওয়া, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ পাওয়া খুয়ান মাতা এবার যোগ দেবে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে। যেখানে একবার এফ এ কাপ, একবার ইউরোপা কাপ পেয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে তাঁকে।
কোচের পর কোচ পরিবর্তন হবে, সমর্থকরা মুখ কালো করে ঘরে ফেরার পথ ধরবে, প্লেয়ারের পর প্লেয়ার আসবে, যাবে। স্ট্রাইকারে কখনও ইব্রাহিমোভিচ, কখনও লুকাকু, কখনও রোনাল্ডোর মতো তাবড়দের দেখা যাবে। তবু ক্লাবের অবস্থান পাল্টাবে না। ২০১৪-১৫ থেকে ২০২১-২২, এই আট বছরের জার্নির মধ্যে খুয়ান মাতার সঙ্গে থেকে যাবে ওল্ড ট্র্যাফোর্ডের উচ্ছ্বাস, ফার্গুসনের হাসি মুখ আর অগণিত সমর্থকদের ৮ নম্বরের ভালবাসা।
সূদূর ভারতে বা বাংলাদেশেও শুধুমাত্র তার জন্য একজন জার্সি কিনে নিজের নামের পেছনে ৮ নম্বরটাই লিখবে। কারণ ম্যানচেস্টারে ওই হুয়ান মাতাই ওর ইন্সপিরেশন। ওর ভেতরের সুপ্ত ইচ্ছের বহি:প্রকাশ। ওর না খেলতে পারা খেলাগুলো বরাবর খেলে দিয়েছে খুয়ান মাতা। আজ ম্যানচেস্টার ছাড়ার সময় মাতা যখন সমর্থকদের ভালবাসা কুড়িয়ে নিচ্ছিল পরশমণির মতো, চোখ কি ভিজে ওঠেনি একবারও?
হুয়ান মাতা চলে যাচ্ছে। এই শেষবারের মতো। আর ফিরবে না ওল্ড ট্র্যাফোর্ডের সবুজ ঘাসে। ‘মাতা, আউটস্ট্যান্ডিং’ বলে পিটার ড্রুরি তাঁর উচ্ছ্বাস প্রকাশ করবেন না। আর আমরা, হাজার হাজার ফুটবলপ্রেমীরা মনে রেখে দেব ২০১২ ইউরো কাপ ফাইনালে বিধ্বংসী স্পেনের হয়ে মাতার ঐ পারফরমেন্স। শেষ গোলটা। দাভিদ সিলভাকে জড়িয়ে ধরা। ঐ মূহূর্তগুলোই সম্পদ, যখের ধন। ফুটবল যে কবে কাছে টেনে নেয়, খেয়ালও থাকে না। হুয়ান মাতা, থ্যাঙ্ক ইউ ফর এভরিথিং!