লিওনেল মেসির শৈল্পিকতা, নান্দনিকতা নিয়ে খেরোখাতা অনেক হয়েছে। নিপাট ভক্ত কিংবা তাঁর কট্টর সমালোচকদেরও তিনি এই বিশ্বকাপে রীতিমত মুগ্ধতায় ডোবাচ্ছেন। ফুটবল নামক রঙ তুলিতে যেন শেষ আঁচড়টা আরও বেশি নিখুঁতভাবে দিচ্ছেন। তবে এতে করে বিপত্তিও দানা বাঁধছে। মেসি বন্দনার শব্দভাণ্ডারে যেন আর কোনো নতুনত্ব নেই। আপাতত তিনি বিশেষণের ঊর্ধ্বেই চলে গিয়েছেন।
তবে কথায় আছে, কিংবদন্তিরা প্রস্থানের সময় নিজের একটা ছাপ রেখে যান। তাঁকে পূর্বসূরি হিসেবে অবলম্বন করে কেউ না কেউ তাঁর জায়গাটা ধরে এগিয়ে যান। মেসির ক্যারিয়ার সায়াহ্নে আর্জেন্টিনার হাল ধরবে কে? মেসি হীনতায় আর্জেন্টিনার যে শূন্যতা তৈরি হবে তা কি কিছু দিয়ে পূরণ সম্ভব? এমন সব আশঙ্কা কেন্দ্রীভূত প্রশ্নের একটা উত্তর অবশেষে পাওয়া গেছে। উত্তরটার নাম জুলিয়ান আলভারেজ।
বিশ্বকাপ ফাইনালে পৌঁছে গেছে আর্জেন্টিনা। খবরটা এতক্ষণে পুরনো। তবে নতুনত্বের জয়গান এরই মধ্যে হয়তো প্রস্ফুটিত হয়ে গেছে। নিজের উত্তরসূরি হিসেবে মেসি কাউকে রেখে যাচ্ছেন, সেই ভেবে মেসি কিছুটা তৃপ্ত হতেই পারেন। ম্যারাডোনার প্রস্থানের পর আর্জেন্টিনার হাল ধরেছিলেন গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতা। এরপর রিকুয়েলমে এসেছেন, পাবলো আইমার দ্যুতি ছড়িয়েছেন।
এর মাঝে হার্নান ক্রেসপোও গ্রেটদের ব্যাটন হাতে নিয়েছিলেন। কিন্তু মেসি সেই ব্যাটন কার হাতে তুলে দিবেন? এক যুগ পেরিয়ে ১৬ বছরের ক্যারিয়ারে মেসি কি তবে দলে তরুণদের পথযাত্রা রুদ্ধ করার দায়ে দায়ী হবেন? না। ক্যারিয়ারের শেষটায় সেই দায় মুক্তি তিনি পাচ্ছেন। তিনি নির্বিকার চিত্তে তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের ব্যাটনটা এখন আলভারেজকে তুলে দিতেই পারেন।
ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে জোড়া গোল করে আর্জেন্টিনাকে ফাইনালে তোলার অন্যতম নায়ক এই জুলিয়ান আলভারেজ। নিজের দ্বিতীয় গোলটা না হয় মেসির ইনডিভিজুয়াল ব্রিলিয়ান্সে। আলভারেজ শুধু দারুণ ফিনিশিং দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রথম গোলটা তো একটা কাব্যের কলেবর ছাপিয়ে মহাকাব্যের মত।
৫৫ গজ থেকে একটা দৌড় শুরু করলেন জুলিয়ান আলভারেজ। সেই দৌড়ের সামনে যেন রীতিমত অসহায় ক্রোয়াট ডিফেন্ডাররা। পেছন থেকে কতবার যে তাকে ট্যাকলের চেষ্টা করা হল, কিন্তু আলভারেজকে আর থামায় কে! ঢুকে গেলেন ডি-বক্সে। এবার বলটা একবার বাড়ালেন। মুহূর্তের আকস্মিকতায় সেই বলটা আবার ফিরেও এলো। আর সেই সুযোগটা নিয়ে সরাসরি ক্রোয়াট গোলবারের জালে জড়ালেন জুলিয়ান আলভারেজ। ব্যাস।
ওখানেই আর্জেন্টিনার আরও একবার এগিয়ে যাওয়া। ওখানেই যেন তিনি ফিরিয়ে আনলেন ৮৬ এর সেই ম্যারাডোনাকে। সে বারের বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার ৫,৬ ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে গোল করার দৃশ্যটা তো এখনও অমর। আলভারেজ যেন সেই নস্টালজিক দৃশ্যেরই একটা চিত্রায়ণ করলেন লুসাইল স্টেডিয়ামে। এক মুহূর্তের জন্য বোধহয় তাঁর মধ্যে সেই ডিয়েগোই ভর করেছিল।
এবারের বিশ্বকাপে সব মিলিয়ে ৪ টি গোল করেছেন আলভারেজ। প্রথমবারের মত বিশ্বকাপ খেলতে এসেছেন। প্রথমবারেই দারুণ রকম সফল। যে নাম্বার নাইন আর্জেন্টাইন সহস্র ভক্তের কান্নার কারণ হয়েছে, এবার সেই নয় নাম্বার জার্সি পরেই যেন আলভারেজ নতুন একটা গল্প লিখতে এসেছেন। এ গল্পে অশ্রু ঠিকই আছে, কিন্তু সেটি হলো বিজয়ের অশ্রু।
সত্যিকার অর্থেই, নাম্বার নাইন নিয়ে গত এক দশক ধরেই আর্জেন্টিনার হাহাকার অবস্থা। ঠিকঠাক ফিনিশিং দুর্বলতার কারণে কতবার যে আর্জেন্টিনা শিরোপা খুইয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। অবশেষে সেই সমস্যার সমাধান হয়ে এসেছেন আলভারেজ। এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপে যা করেছেন তা এক কথায় দুর্দান্ত। তবে নিজের প্রথম বিশ্বকাপটা স্মরণীয় রাখতে নিজের ধারাবাহিকতা আরও একটা ম্যাচ পর্যন্ত তাঁকে ধরে রাখতেই হচ্ছে।
আকাশী নীল জার্সির জুলিয়ান আলভারেজ ক্লাব পর্যায়ে খেলেন ম্যানসিটির হয়ে। ম্যানসিটি বস পেপ গার্দিওলা রত্ন চিনতে ভুল করেননি। ম্যানসিটির গ্রেট সার্জিও আগুয়েরোর জায়গায় তিনি এনেছেন আরেক আর্জেন্টাইনকেই। পেপ এর সে আস্থার প্রতিদান আলভারেজ নিয়মিতই দিচ্ছেন। তবে সম্ভবত গার্দিওলার ভবিষ্যদ্বাণীকে সত্য করার এক মিশনেই এবার নেমেছেন তিনি।
বিশ্বকাপের আগে ম্যানসিটি ড্রেসিংরুমে হঠাৎই শোরগোল একটি বিষয় নিয়ে। কী সেই বিষয়? কার হাতে উঠবে বিশ্বকাপ? কেউ বলে পর্তুগাল, কেউ বলে ফ্রান্স, আবার কেউ বলে ইংল্যান্ড। সবার মতামতের সিংহভাগই গেল ইউরোপের কোনো দলের পক্ষে। কিন্তু স্বয়ং পেপ গার্দিওলা আলভারেজের দিকে আঙুল তাক করে বললেন, ‘এই ছেলেটা বিশ্বকাপ নেবে’। বিস্ময়ে ভেসে গেল সবাই। কারণ লাতিন আমেরিকার কোনো দল বিশ্বকাপ নেবে তাতে সবার সম্মিলিত ভোট ছিল শূন্য।
যাহোক, সেই শূন্য ভোটের প্রেডিকশন এখনও মিথ্যা হয় নি। তবে সেটাকে মিথ্যা প্রমাণ করার পথে রয়েছে আলভারেজের আর্জেন্টিনা। আর একটি ম্যাচ জিতলেই দুই দশক পর আবার কোনো লাতিন আমেরিকার দল বিশ্বকাপ শিরোপা উঁচিয়ে ধরবে। জুলিয়ান আলভারেজের স্বপ্নটা তাই এখনও বড়ই থাকছে।
পারবেন কি আলভারেজ? মেসির সাথে তিনিও কি সেই সোনালি ট্রফি উঁচিয়ে ধরতে পারবেন? আপাতত সে সব প্রশ্নের উত্তরের জন্য দিন চারেকের অপেক্ষা। বাড়তি চার বছরের অপেক্ষায় না গিয়ে আর্জেন্টিনা তাই এই চারদিনের অপেক্ষার অবসানটা নিশ্চিতভাবেই ঘটাতে চাইবে। অনুরূপ কিছু ঘটাতে চাইবেন আলভারেজও।