সেটা ২০১০ সালের কথা।
শ্রীলঙ্কা সফর শেষ করে বাংলাদেশে এসেছে নিউজিল্যান্ড। বাংলাদেশে প্রথম ম্যাচেই হেরে গেছে তারা। হেরে গেলেও দলটির বালক এক ক্রিকেটার সেঞ্চুরি করেছেন।
এই বালককে নিয়ে তখন খুব হইচই হচ্ছে। মার্টিন ক্রো বলেছেন, নিউজিল্যান্ডের তো বটেই, বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যান হতে যাচ্ছে এই ছেলেটি। ফলে তার সাথে একটু কথা বলতেই হয়।
তখনও পৃথিবীতে করোনা ভাইরাস আসেনি, আকসু এতো তৎপর হয়নি। ক্রিকেটারদের পেছন পেছন অনুশীলনের আশেপাশে ঘুরে বেড়ানো যেতো। মিরপুর ইনডোর থেকে মূল মাঠ; অনেকক্ষন ঘুরেও ফাঁকা পাচ্ছিলাম না ছেলেটিকে। অবশেষে দেখি সেন্টার উইকেটের পাশে একা একা দাড়ানো। ত্রস্ত পায়ে কাছে গিয়ে বললাম-একটু কথা বলতে চাই।
বেশ অবাক হয়ে, একটু লজ্জা পেয়ে ছেলেটি বললো, ‘মি! আমি কেনো?’
আমি হেসে বললাম, ‘কাল সেঞ্চুরি করলে। তুমি ভবিষ্যত সুপারস্টার।’
তার মুখে হাসি আর ধরে না। হাসতে হাসতে বললো, ‘আমি সুপারস্টার? সাকিব আছে, ড্যান (ভেট্টোরি) আছে, ব্রেন্ডন (ম্যাককালাম) আছে; ওরা হলো স্টার। আমি কোনোদিনই স্টার হবো না।’
ছেলেটি কথা রেখেছে।
তারপর থেকে দুনিয়ার বুকে ঠিক দশটা বছর কেটে গেছে। এই সময়ে বিশ্বকে আক্ষরিক অর্থেই সে জয় করে নিয়েছে ব্যাট দিয়ে। এমন কোনো কীর্তি নেই, সে করেনি। কিন্তু ছেলেটি সুপারস্টার হয়নি। বিরাট কোহলি, স্টিভেন স্মিথ, বাবর আজমদের গ্লামারের কাছে সে নিতান্তই সেই বালকটি রয়ে গেছে। কিন্তু আড়ালে আড়ালে সে হয়ে উঠেছে এক নম্বর।
হ্যা, এক নম্বর কেন উইলিয়ামসন।
গেলো বছরের শেষটা করেছেন উইলিয়ামসন স্মিথ, কোহলিকে টপকে এক নম্বর ব্যাটসম্যান হিসেবে। তারপর নিজের র্যাংকিংটা যে ফ্লুক নয়, সেটার প্রমাণ দিয়ে চলেছেন। আজ সকালে পাকিস্তানের বিপক্ষে আরেকটা সেঞ্চুরি করেছেন। এই নিয়ে টানা তিন টেস্টে সেঞ্চুরি করলেন; এর মধ্যে একটা ২৫১ রানের ইনিংস।
এই তুঙ্গস্পর্শী ফর্ম বা এই রানের স্রোত; কোনোটাই উইলিয়ামসনের জন্য নতুন কিছু নয়। কার্যত গত দশ বছর ধরে এই কাজটাই নীরবে, হাসিমুখে, লাজুক ভাবমূর্তিতে করে যাচ্ছেন তিনি।
উইলিয়ামসনের ক্রীড়াবিদ না হয়ে উপায় ছিলো না।
বাবা ছিলেন ক্রিকেটার। নর্দান ডিস্ট্রিক্টের হয়ে অনুর্ধ্ব-১৭ দলেও খেলেছেন। মা বাস্কেটবল দলেও খেলেছেন। বোন নিউজিল্যান্ড বয়সভিত্তিক দলে ভলিবল খেলেছেন। এমন পরিবারে জন্মে উইলিয়ামসন খেলোয়াড় ছাড়া আর কী হতে পারতেন!
যদিও বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে বলার মতো কিছু পারফরম্যান্স ছিলো না। কিন্তু ঘরোয়া ক্রিকেটে খুব ছোটবেলা থেকেই নিজের পারফরম্যান্স দিয়ে নজর কেড়েছিলেন। তখনই বিশ্লেষকরা বলছিলেন, নিউজিল্যান্ড ‘নেক্সট বিগ থিং’ পেয়ে গেছে।
খুব কম লোকই এসব ভবিষ্যতবানী সত্যি করতে পারে। কেন উইলিয়ামসন পেরেছেন।
অভিষেক টেস্টেই ভারতের বিপক্ষে আহমেদাবাদে সেঞ্চুরি করেছেন। সেই শুরু। এরপর কেবল একটার পর একটা ধাপ টপকেছেন। আস্তে আস্তে নিজেকে আধুনিক গ্রেটে পরিণত করেছেন। এই সময়ের সেরা চার বা ফ্যাব-ফোরের একজন হয়েছেন। ২৪ বছর ১৫১ দিন বয়সে ৩ হাজার রান যখন পার করলেন, বয়সের দিক থেকে পেছনে ফেলে দিলেন স্বয়ং স্যার ডন ব্র্যাডম্যানকেও।
একটার পর একটা রেকর্ড ভেঙেছে। কিন্তু তিনি কখনোই তথাকথিত সুপারস্টার হয়ে ওঠেননি। এখনও হেসে বলেন, ‘আমি তো বাকীদের মতো গিফটেড নই।’
কিন্তু কথাটা কত সত্যি, তা নিয়ে তর্ক করার সুযোগ আছে। অর্থোডক্স এই ডানহাতিকে দেখে গিফটেড মনে না করার কারণ নেই। গিফটেড তো তাকে অধিনায়কত্বেও মনে হয়।
হ্যা, অধিনায়কত্ব। উইলিয়ামসের জীবনে এ আরেক কাব্যিক অধ্যায়।
ভেট্টোরির বিদায়ের পর মনে হচ্ছিলো, নিউজির্যান্ড সেরকম লিডার আর পাবে না। অন্তত ম্যাককালাম সেরকম হয়ে উঠতে পারেননি। কিন্তু উইলিয়ামসন এই লিডারশিপটাকে অন্য স্তরে নিয়ে গেলেন। ইংল্যান্ড ও ৪৯ বছর পর পাকিস্তানকে সিরিজে হারালেন। আর ২০১৯ বিশ্বকাপটা তো জিতেই ফেলেছিলেন।
ফাইনালে অতি নাটকীয়তা এবং আইসিসির ভুতুড়ে হিসেবের কারণে কাপটা তার হাতে উঠলো না। কিন্তু দর্শকের কাছে বিজয়ী ক্যাপ্টেনের তালিকাতে নিশ্চয়ই তাঁর নামটাও লেখা রইলো। তিনি আরও একবার নীরব বিজয়ী হয়ে রইলেন।
এই উইলিয়ামসনের জীবন। সবকিছু করবেন তিনি; কিন্তু শেষ হাসিটা অন্য কেউ হাসবে।