কাজী নজরুল ইসলাম ও দাবা

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্য জীবন এবং গানের পাশাপাশি দাবা’র একটা বিশেষ পরিচয় পাওয়া যায়।

বিভিন্ন বইপত্রে এই বিষয়ের উল্লেখ মোটামুটিরকমের। আরো অন্যান্য খেলার প্রতি নজরুলের বর্ণনা করবার মতো আগ্রহ থাকলেও বিশেষভাবে এখানে দাবার কথা লিখছি- কারণ এই দাবা খেলা নিয়ে তার লেখায়ও প্রখর পান্ডিত্যের ছাপ আছে। যারা শিউলিমালা গল্পটি পড়েছেন- তারা হয়তো ধরে ফেলতে পেরেছেন ঠিক কোথাকার কথা আমি বলছি।

বাংলাদেশের দাবার পথিকৃৎ ব্যক্তি যাকে বলা হয়- পরিসংখ্যানের অধ্যাপক ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেন- সর্বভারতীয় দাবা প্রতিযোগিতায় মেধার সর্বোচ্চ স্বাক্ষর রাখা মহান ব্যক্তি তিনি- তাঁর সাথে নজরুলের বন্ধুত্ব ছিলো চমৎকার। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কাজী মোতাহার হোসেন এবং আমাদের এই জাতীয় কবি- তিনজনই ছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু৷ শরৎচন্দ্র নিজেও দাবাড়ু মানুষ ছিলেন। জানা যায়- তিনি দুই কাজীকে তাঁর বাসায় আমন্ত্রণ জানান দাবা খেলবার জন্য৷ অনেক রাত হয়ে গেলেও তারা দাবায় মত্ত থাকেন। এই অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে পরবর্তীকালে নজরুল ‘শিউলিমালা’ গল্পের প্লট সাজান, জনৈক উকিল আজহার সাহেবের বরাতে সেই গল্পের চমৎকার বর্ণনা শোনা যায়৷

ইউরোপসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে দাবার প্রতিযোগিতামূলক প্রেক্ষাপট ১৯০০ সাল থেকেই শুরু হয়, সেই হিসেবে আমি আমার বিভিন্ন কল্পনাপ্রসূত লেখায় আমাদের উপমহাদেশীয় লেখকবৃন্দের পয়েন্ট অফ ভিউ থেকে দাবার সেই ট্রেন্ড’টা বুঝবার একটা ছেলেমানুষী চেষ্টা করছিলাম। সেইসমস্ত কথায় সুনীলসহ জীবনানন্দ এবং এমনকি বিনয় মজুমদারকেও ভাবার চেষ্টা করেছি৷ তবে, বলতে লজ্জা হচ্ছে- নজরুল এবং শরৎচন্দ্র এই দুটি ব্যক্তি অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে দাবায় অংশগ্রহণ করলেও আমার জীর্ণশীর্ণ মস্তিষ্ক তাদেরকে সেই ভাবনায় তুলে আনতে সময় নিয়েছে৷ তবে একেবারে অজানা ছিলোনা এই বিষয়গুলো। আমার বন্ধু সামিরা অত্যন্ত আগ্রহভরে নজরুলের দিন-রাত দাবা খেলার বিষয়টা নজরে নিয়ে আসার পরই ঘাঁটাঘাঁটি করলাম একটু।

বিশ্বদাবার হালচাল সম্পর্কে নজরুল ওয়াকিবহাল ছিলেন, তার লেখায় পশ্চিমা বিশ্বের গ্র‍্যান্ডমাস্টারসহ বিভিন্ন মহিলা মাস্টারদের কথাও এসেছে। শিউলিমালা গল্পটাকে আমরা প্রমাণ হিসেবে ধরতে পারি। নজরুল সেখানে আজহারের দোহাই দিয়ে কাপাব্লাংকা, আলেখিন, রুবিনস্টাইন, রেটি, মরফির কথা বলছেন৷ শিউলিমালার শুরুর দিকের কিছু অংশ যদি কোট করি- তবে দেখা যায় নজরুল লিখেছেন-

“বড়ো ব্যারিস্টার যখন ‘উইকলি নোটস’ পড়েন আজহার তখন অ্যালেখিন, ক্যাপাব্লাঙ্কা কিংবা রুবিনস্টাইন, রেটি, মরফির খেলা নিয়ে ভাবে, কিংবা চেস-ম্যাগাজিন নিয়ে পড়ে, আর চোখ বুজে তাদের চালের কথা ভাবে।

সকালে তার হয় না, বিকেলের দিকে রোজ দাবার আড্ডা বসে। কলকাতার অধিকাংশ বিখ্যাত দাবাড়েই সেখানে এসে আড্ডা দেয়, খেলে, খেলা নিয়ে আলোচনা করে।

আজহারের সবচেয়ে দুঃখ, ক্যাপাব্লাঙ্কার মতো খেলোয়াড় কিনা অ্যালেখিনের কাছে হেরে গেল। অথচ অ্যালেখিনই বোগোল-জুবোর মতো খেলোয়াড়ের কাছে অন্তত পাঁচ পাঁচবার হেরে যায়!

মিস্টার মুখার্জি অ্যালেখিনের একরোখা ভক্ত। আজও মিস্টার আজহার নিত্যকার মতো একবার ওই কথা নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করলে, মিস্টার মুখার্জি বলে উঠল – ‘কিন্তু তুমি যাই বল আজহার, অ্যালেখিনের ডিফেন্স – ওর বুঝি জগতে তুলনা নেই। আর বোগোল-জুবো? ও যে অ্যালেখিনের কাছ তিন-পাঁচে পনেরোবার হেরে ভূত হয়ে গেছে! ওয়ার্লড-চ্যাম্পিয়ানশিপের খেলায় অমন দু চার বাজি সমস্ত ওয়ার্লড-চ্যাম্পিয়ানই হেরে থাকেন। চব্বিশ দান খেলায় পাঁচ দান জিতেছে। তা ছাড়া, বোগোল-জুবোও তো যে সে খেলোয়াড় নয়!’

শিউলিমালার পুরো গল্পের শুধু এইটুকুনই যদি আমরা একটু চাখতে বসি- তাহলে বহির্বিশ্বের দাবা সম্পর্কে নজরুলের জ্ঞানের নমুনা প্রায় পরিষ্কার হয়ে যাবে৷ নজরুল এখানে দুটি চ্যাম্পিয়নশীপ ম্যাচের কথা উল্লেখ করেছেন, এক. কাপাব্লাংকা বনাম আলেখিন, দুই. আলেখিন বনাম বোগোলজুবো।

কাপাব্লাংকা বনাম আলেখিনের চ্যাম্পিয়নশিপ ম্যাচ সংঘটিত হয় ১৯২৭ সালে। সেখানে আলেখিন কাপাব্লাংকাকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়নের মুকুট ছিনিয়ে নেন৷ দুই বছর পর, অর্থাৎ ১৯২৯ সালে বোগোলজুবো’র সাথে প্রতিযোগিতায় নামেন, সেখানেও তিনি তার মুকুট ধরে রাখতে সক্ষম হন৷ আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে- নজরুল সেই চ্যাম্পিয়নশীপের ফলাফল সম্পর্কেও জ্ঞাত! গল্পের মিস্টার মুখার্জির ভাষ্যে তিনি জানাচ্ছেন বোগোলজুবো আলেখিনের কাছে তিন-পাঁচে পনেরোবার হেরে ভূত হয়ে গেছেন!

আসলেও তাই। ১৯২৯ সালের সেই ম্যাচের রেজাল্ট আলেখিন সাড়ে পনেরো পয়েন্ট এবং বোগোলজুবো সাড়ে নয়!

নজরুল শুধু দাবাড়ুদের সম্পর্কে জ্ঞান রাখেননি, খোদ দাবা খেলার বিভিন্ন চাল সম্পর্কেও তিনি বেশ ভালো জানতেন। দাবার ডিফেন্স থেকে শুরু করে নৌকোর চাল, পন এন্ডগেম, দুটো গজের কারিশমা- আরো নানানকিছু। আজহারের জবানে নজরুল বলছেন –

‘আজহার হেসে বলে উঠল, ‘আরে রাখো তোমার অ্যালেখিন। এইবার ক্যাপাব্লাঙ্কার সাথে আবার খেলা হচ্ছে তার, তখন দেখো একবার অ্যালেখিনের দুর্দশা! আর বোগোল-জুবোকে তো সেদিনও ইটালিয়ান মন্টেসেলি বগলা-দাবা করে নিলে! হাঁ, খেলে বটে গ্রানফেল্‌ড।’

সেই কোথাকার কোন ইতালিয়ান মন্টেসেলি (মারিও মন্তেচেলি) গ্রুনফেল্ড (নজরুলের লেখনীতে ‘গ্রানফেল্ড’) ডিফেন্স খেলে বোগোলজুবো’কে (Efim Bogoljubov) হারিয়েছেন- সেই বিষয়ক তীব্র ভর্ৎসনাও (ও পাণ্ডিত্যের নমুনা) শোনা যায় নজরুলের পরোক্ষ বয়ানে।

গ্রুনফেল্ড ডিফেন্স হচ্ছে সাদার বিপক্ষে কালোর একধরনের হাতিয়ার, যার সঠিক ব্যবহার সাদাকে ধরাশায়ী করে দিতে পারে খুব দ্রুত৷ এছাড়াও নজরুল আলেক্সান্ডার আলেখিন কর্তৃক উদ্ভাবিত আলেখিন ডিফেন্সের কথাও মুখরোচক করে উপস্থাপন করেছেন।

শুধু পুরুষ দাবাড়ুদের কথা নজরুল তার গল্পে তুলে আনেননি। তিনি বলছেন ব্রিটিশ মহিলা দাবাড়ু এবং শুরুর দিককার উইম্যান চ্যাম্পিয়ন ভেরা মেনচিকের কথাও!

‘আমি এইবার সংযত হয়ে মন দিয়ে খেলতে লাগলাম। দুই গজ ও মন্ত্রী দিয়ে এবং নিজের কোটের বোড়ে এগিয়ে এমন অফেন্সিভ খেলা খেলতে শুরু করে দিলাম যে, প্রফেসার চৌধুরিও আর এ-খেলা বাঁচাতে পারলেন না। শিউলি হেরে গেল! সে হেরে গেলেও এত ভালো খেলেছিল যে, আমি তার প্রশংসা না করে থাকতে পারলাম না। আমি বললাম – ‘দেখুন, মেয়েদের ওয়ার্লড-চ্যাম্পিয়ান মিস মেনচিকের সাথেও খেলেছি, কিন্তু এত বেশি বেগ পেতে হয়নি আমাকে, আমি তো প্রায় হেরেই গেছিলাম।’

সাহিত্য এবং শিল্পের সমস্ত দিকে পদার্পণকারী নজরুল দাবা বিশ্বের খোঁজখবরও রাখবেন আনাচেকানাচে- এ আর এমন কি অদ্ভুত বিষয়! বিদ্রোহী এবং প্রেমিক কবি নজরুল দাবাকে কেবল বুদ্ধির অথবা ভানুমতীর খেল্ হিসেবেই বিবেচনা করেননি, বরং প্রেম এবং সম্প্রীতির একটা পরিপূর্ণ বন্ধন হিসেবেও দেখেছেন, ভেবেছেন।

সেই নজির তিনি উপস্থাপন করে গেছেন শিউলিমালা’তেই। এছাড়াও দাবা সম্পর্কে জানাশোনা থাকার কারণে রুবাইয়াৎ-ই-উমর খৈয়াম অনুবাদ করেছেন প্রাঞ্জলভাবে। আজীবন বিদ্রোহী এই কবি ও দাবাড়ু নজরুলের পায়ের কাছে আমার বিনীত শ্রদ্ধা রাখি।

‘আমরা দাবা খেলার ঘুঁটি, নাই রে এতে সন্দ নাই!

আশমানি সেই রাজ-দাবাড়ে চালায় যেমন চলছি তাই।

এই জীবনের দাবার ছকে সামনে পিছে ছুটছি সব,

খেলার শেষে তুলে মোদের রাখবে মৃত্যু-বাক্সে ভাই!’

মূলঃ ওমর খৈয়াম; অনুবাদঃ কাজী নজরুল ইসলাম; রুবাই ১৬১

লেখক পরিচিতি

দাবাপ্রেমী, কবি, অনুবাদক। সিনেমা পড়ি, উপলব্ধিগুলোকে সিনেম্যাটিক ভাবি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link