ব্যাঙ্গালুরুর হিরো হওয়া আইরিশ গ্রেট

কেভিন ও’ব্রায়েনের কথা মনে পড়লে বলিউডের ‘রাউডি রাঠোর’ ছবির একটা সংলাপ মনে আসে! যেখানে অক্ষয় কুমার বলেছিলেন, ‘একশো বছর বেঁচে থাকার জন্য একশো বছরের আয়ুর প্রয়োজন নেই, বরং একদিন এমন কিছু করো যাতে দুনিয়া তোমাকে একশো বছর মনে রাখে।’ এই ডায়লগটি পুরোপুরি যায় কেভিন ও’ব্রায়েনের সাথে। এক ইনিংস দিয়েই যিনি নিজের নামকে এখনো কোটি ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে গেঁথে আছেন।

২০১১ বিশ্বকাপের ইংল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডের ম্যাচের কথা মনে আছে আপনার? সেই ম্যাচের কথা মনে পড়লে আপনার চোখে ভেসে ওঠার কথা এক মহাকাব্যিক ইনিংসের, এক বিধ্বংসী ইনিংস যেটা ইতিহাস রচনা করেছিল ব্যাঙ্গালুরুর মাটিতে। কেভিন ও’ব্রায়েনের ৬৩ বলে ১১৩ রানের ঝলমলে ইনিংসে ইংলিশদের তিন উইকেটে হারিয়ে এক ঐতিহাসিক জয় তুলে নেয় আইরিশরা। সেই ম্যাচে ৫০ বলে সেঞ্চুরি করে বিশ্বকাপে দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ড গড়া কেভিন ও’ব্রায়ান ওয়ানডে ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন।

আচ্ছা ২০১১ বিশ্বকাপের আগে কি কেভিন ও’ব্রায়েনকে সবাই চিনতেন? একটু ফ্ল্যাশব্যাকে গেলে ২০০৭ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে আইরিশদের একটা ম্যাচের কথা মনে আসে! যেদিনটি এখনো পাকিস্তানের ক্রিকেট ইতিহাসে ‘ব্ল্যাক ডে’ হিসেবেই পরিচিত!

পাকিস্তানকে তিন উইকেটে হারিয়ে ক্রিকেটে নতুন পথচলা নব্য আইরিশরা সেদিন নিজেদেরকে জানান দিয়েছিল। সেই ম্যাচের নায়ক যদিও ছিলেন তার বড় ভাই নিল ও’ব্রায়ান! তবে শেষ মুহূর্তে চাপের কেভিন ও’ব্রায়েনের ৫২ বলে অপরাজিত ১৬ রানের ইনিংসেই হারতে হারতে পাকিস্তান বধের রচনা লিখেছিল আইরিশরা।

২০১৩ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডেতে ডাবলিনে ব্যাট হাতে তাণ্ডব চালিয়েছিলেন কেভিন ও’ব্রায়েন। বৃষ্টি বিঘ্নিত কার্টেল ওভারের ম্যাচে শেষ বলে আইরিশদের জিততে প্রয়োজন ছিল ৬ রান, আর টাই করতে প্রয়োজন ৪ রান! সাইদ আজমলের করা শেষ বল বাউন্ডারি ছাড়া করে ম্যাচ টাই করেছিলেন এই আইরিশ অলরাউন্ডার। সেদিন বৃষ্টি বাগরা না দিলে কেভিনের ৪৭ বলে অপরাজিত ৮৪ আর পল স্টার্লিংয়ের সেঞ্চুরি বৃথা যেত না!

আইরিশ অলরাউন্ডার কেভিন ও’ব্রায়েনের কথা মনে আসলে আপনার এই তিনটা ম্যাচের কথা মনে পড়ার কথা। যদিও ২০১১ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেই মহাকাব্যিক ইনিংস দিয়েই সবার নজর কেড়েছিলেন! আইরিশ ক্রিকেটের আজকের পর্যায়ে আসার পেছনে তার অবদান কিন্তু কোনো অংশেই কম নয়। তার অলরাউন্ড পারফরম্যান্স আইরিশ দলকে সব সময় বাড়তি শক্তি যোগাতো।

তবে এই আইরিশ তারকার মনের কোনে কোথাও হয়তো ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল) না খেলতে পারার আক্ষেপটা থেকে যাবে। আয়ারল্যান্ড জাতীয় দল ছাড়া বেশ কয়েকটা ফ্র‍্যাঞ্চাইজি লিগে খেলেছেন এই আইরিশ তারকা। তবে একবার এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন আইপিএল খেলার বেশ ইচ্ছে ছিল তাঁর।

কিন্তু ৬/৭ আসরে নিলামে নাম উঠলেও কোনো ফ্র‍্যাঞ্চাইজি তাকে দলে নেয়নি। ২০১১ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেই ইনিংসের পর অনেক ক্রিকেট বিশ্লেষক টুইট করে বলেছিলেন আইপিএলে দল পাবে কেভিন ও’ব্রায়েন! কিন্তু আইপিএল খেলার ইচ্ছেটা তার আর পূরণ হয়নি। যদিও, ভারতের মাটিতে বিশ্বকাপের সবচেয়ে বড় ঝড় বলতে আজো সেই ব্যাঙ্গালুরুর তাণ্ডবের কথাই বলেন সবাই।

পুরো নাম কেভিন জোসেফ ও’ব্রায়েন। জন্ম চার মার্চ, ১৯৮৪! বাবা ব্রেন্ডন ও’ব্রায়েনও আয়ারল্যান্ডের হয়ে খেলেছেন অনেক দিন। আয়ারল্যান্ডের হয়ে ৫২ ম্যাচ খেলেছেন ব্রেন্ডন ও’ব্রায়েন। আর বড় ভাই নিল ও’ব্রায়েন আইরিশ ইতিহাসের অন্যতম সেরা উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

ক্রিকেট পরিবার থেকে আসায় কেভিন ও’ব্রায়েনের জন্য সবকিছু বেশ সহজ হয়েছিল। মজার ব্যাপার হচ্ছে, বাবা আর দুই ভাই তিনজনই খেলেছেন আইরিশ ক্লাব রেলওয়ে ইউনিয়নের হয়ে। ব্রায়েন ভাইদ্বয়ের বোন কিয়ারা উইমেন্স হকি দলের হয়ে খেলেন! তাদের পুরো ফ্যামিলিটাই মূলত পেশাদার খেলোয়াড়দের আস্তানা বলা চলে।

২০০৪ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে আয়ারল্যান্ডের হয়ে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করে নজর কাড়েন কেভিন ও’ব্রায়েন। তার ঠিক দুই বছর পর আয়ারল্যান্ডের ইতিহাসের প্রথম ওয়ানডেতেই অভিষিক্ত হন কেভিন। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বেলফাস্টে সেই ম্যাচে বল হাতে ৪৭ রানে ১ উইকেট আর ব্যাট হাতে ৪৮ বলে ৩৫ রান করেন কেভিন। তাও কিনা নিজের করা প্রথম বলেই উইকেট শিকার করেন তিনি! ইংলিশ ওপেনার অ্যান্ড্রু স্ট্রাউসকে ফেরান কেভিন। অবশ্য সেই ম্যাচে ৩৮ রানে হেরে যায় আইরিশরা।

আইরিশ জার্সিতে ১৫৩ টি ওয়ানডে খেলেছেন এই অলরাউন্ডার। যেখানে ২৯.৪২ গড়ে ৩৬১৯ রান করেছে! আছে ২ সেঞ্চুরি আর ১৮ ফিফটি। সেই সাথে বল হাতে নিয়েছেন ১১৪টি উইকেট! সেরা ১৩ রানে ৪ উইকেট।

৩৭ বছর বয়সে এসে ওয়ানডে ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়েছেন আইরিশ ক্রিকেটের এই আলোকিত নক্ষত্র। তবে চালিয়ে যাবেন টি-টোয়েন্টি ও টেস্ট! সামনেই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, তার আগে আইরিশদের পেরোতে হবে বাছাই পর্ব। ক্রিকেট ক্যারিয়ারের একদম শেষ দিকেই আছেন কেভিন ও’ব্রায়েন। আইরিশদের বিশ্বকাপের মূল আসরে নিতে পারলে সেটাই হয়তো হবে ক্যারিয়ারের শেষ আশা পূরণ।

আইসিসির সহযোগী দেশের (এখন পূর্ণ সদস্য) হয়ে খেলতেন বিধায় কখনোই বেশি ম্যাচ পাননি, পাননি বড় বড় দলের সাথে খেলার খুব বেশি সুযোগ। তবু নিজের সামর্থ্যের জানান দিয়ে গেছেন যেখানেই সুযোগ পেয়েছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link