১০ সেকেন্ডে বদলে যাওয়া জীবন!

অলিম্পিকের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ইভেন্ট অ্যাথলেটিক। আরো নির্দিষ্ট করে বললে ১০০ মিটার স্প্রিন্ট। মাত্র ১০ সেকেন্ডের জন্য যেন থেমে যায় পৃথিবীর ঘড়ির কাঁটা। দুনিয়া জোড়া সবার চোখ নিবদ্ধ হয় ট্র‍্যাকের মাঝে। এবারের ফাইনালটা জিতে বিশ্বের দ্রুততম মানবের খেতাবটা নিজের করে নিলেন ইতালির ল্যামন্ট মার্সেল জ্যাকবস। তার চেয়ে কম সময়ে ৯.৮০ সেকেন্ড দৌড় শেষ করতে পারেননি কোনো ইউরোপীয়।

করোনার কারণে এক বছর পিছিয়ে জাপানে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এবারের অলিম্পিক। কিন্তু শুরুর আগেই খানিকটা রঙ হারায় এবারের আসর, এবার যে ছিলেন না ট্র‍্যাকের রাজা উসাইন বোল্ট। আর কখনো দেখা যাবে না দৌড় শেষ করে দুহাত ছড়িয়ে সেই ট্রেডমার্ক সেলিব্রেশন। কিন্তু প্রকৃতির অমোঘ নিয়ম মেনেই সরে যেতে হয়, নতুন কেউ এসে পুরোনো জায়গা দখল করে। এবারের আসর ছিল তাই সবার জন্য বোল্টের ছায়া থেকে বেরোনোর। সেই সুযোগটা কি দারুণভাবেই না কাজে লাগালেন জ্যাকবস!

ট্র‍্যাকের রাজত্ব বহুদিন যাবত জ্যামাইকানদের হাতেই। এবারো ফেবারিট হয়েই এসেছিলেন বোল্টের সতীর্থ ২০১২ লন্ডন অলিম্পিকের রুপাজয়ী ইয়োহান ব্লেক। সারাজীবন ছিলেম বোল্টের রাজত্বের অংশ হয়ে, এবার তার সামনে সুযোগ ছিল নিজের সাম্রাজ্য বাড়ানোর। একই সুযোগ ছিল কানাডার আন্দ্রে ডি গ্রাসের সামনেও, রিওতে ২০১৬ অলিম্পিকে উসাইন বোল্ট আর জাস্টিন গ্যাটলিনদের চোখে চোখ রেখে লড়াই করে জিতেছিলেন ব্রোঞ্জ।

প্রতিপক্ষ বদলালেও এবারও ভাগ্য বদলাতে পারলেন না ডি গ্রাস। সর্বশেষ ২০০৪ এথেন্স অলিম্পিকে কোনো আমেরিকান সোনা জিতেছিলেন এই ইভেন্টে, তিনি জাস্টিন গ্যাটলিন। বোল্টের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী এই দৌড়বিদকে ছোঁয়ার সুযোগ ছিল ফ্রেড কার্লির। কিন্তু সুযোগ হারালেন তিনিও, ৯.৮৪ সেকেন্ডে শেষ করে সন্তুষ্ট থাকলেন সিলভার জিতেই। সুযোগ ছিল সেমিফাইনালে সবচেয়ে ভালো টাইমিং করা বিসুং থিয়েনের কাছেও।

ইতিহাসে এখনো পর্যন্ত কখনো সেরা স্প্রিন্টারের খেতাব জিততে পারেননি কোনো এশিয়ান। সেমিতে সবার সেরা ৯.৮৩ সেকেন্ডে দৌড় শেষ করে পুরো বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ঘন্টাদুয়েক পরের ফাইনালে ধরে রাখতে পারলেন না সেমির চমক। অথচ সেমির পুনরাবৃত্তি করতে পারলেই নিদেনপক্ষে সিলভার জিতলেন। কিন্তু হতাশাপূর্ণ এগারো সেকেন্ড কাটানোর পর তার সৌভাগ্য হয়নি পোডিয়ামে উঠার।

২০২১ সালটা পয়মন্ত ইতালিয়ানদের জন্য। করোনা ভাইরাস সর্বপ্রথম ভয়াল থাবা বাড়িয়েছিল তাদের দিকেই। কেড়ে নিয়েছে ইতালিয়ানদের জীবনীশক্তি। কিন্তু ২০২১ যেন সব সুদে আসলে ফিরিয়ে দিচ্ছে তাদের। প্রায় পাঁচ দশকের হতাশা কাটিয়ে ইউরো জিতেছে ইতালি ফুটবল দল। এবার যেন ট্র‍্যাক এন্ড ফিল্ডে রাজত্ব ছিল ইতালিয়ানদেরই। লংজাম্পে যৌথভাবে সোনা জিতেছেন জিয়ানমার্কো তামবেরি।

কিন্তু ১০০ মিটার স্প্রিন্টে সোনা জয়ের কথা বোধহয় ভাবতে পারেননি কট্টর ইতালি সমর্থকও। সর্বশেষ ১৯৬০ অলিম্পিকে ট্র‍্যাকের কোনো ইভেন্টে পদক জিতেছিল, সেটাও মেয়েদের দলগত ৪০০ মিটারে ব্রোঞ্জ। কিন্তু মাঠে নামার পর কি আর এসব পরিসংখ্যানের কচলানি কাজে লাগে, নির্দিষ্ট দশ সেকেন্ডে যিনি সবচেয়ে দ্রুত দৌড়াবেন তিনিই পড়বেন বিজয়ের বরমাল্য।

সেখানেই সফল জ্যাকবস, ক্যারিয়ারসেরা ৯.৮০ সেকেন্ডে দৌড় শেষ করে গড়েছেন ইতিহাস। প্রথম ইউরোপীয় হিসেবে এই ইভেন্টে জিতেছেন সোনার পদক। অথচ ফাইনালের শুরুটা হয়েছিল ফলস স্টার্স্ট দিয়ে, বন্দুকের গুলি ছোঁড়ার আগেই দৌড় শুরু করে ডিসকোয়ালিফাইড হন ব্রিটেনের জেড হিউজ। ইনজুরিতে দৌড় শেষ করতে পারেননি নাইজেরিয়ার অ্যাডেগোক। কিন্তু ইভেন্ট শেষে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিলেন সবাই, সব আলো যে কেড়ে নিয়েছেন জ্যাকবস।

অথচ, এবারের অলিম্পিক শুরুর আগে পাঁড় অ্যাথলেটিক ভক্তও বোধহয় বাজি রাখতেন না জ্যাকবসের উপর। ইতালিয়ান মা এবং আফ্রো আমেরিকার বাবার পুত্র জ্যাকবস দশ বছর বয়সেই নাম লেখান ট্র‍্যাক এন্ড ফিল্ডে। হাইজাম্প দিয়ে ক্যারিয়ার শুরু করলেও দ্রুতই বুঝতে পারেন নিজের শক্তির জায়গা। শুরু করেন ১০০ মিটার এবং ৬০ মিটার দৌড়। দৈর্ঘ্য এবং সময় যত কমে আসে ততই যেন বাড়ে জ্যাকবসের ক্যারিশমা।

এবারের অলিম্পিকের আগে তেমন সাফল্য পাননি, তার ফাইনালে উঠাটাও অনেকের কাছে ছিল বিস্ময়ের। এর আগে সাফল্য বলতে এবছরের শুরুতে বিশ্ব রিলেতে দলগতভাবে ব্রোঞ্জ জয়। কিন্তু এখন সেসব ভাবতে বয়েই গেছে জ্যাকবসের, স্বপ্নের এক দৌড় শেষ করে তিনি এখন ভাসছেন উল্লাসের ভেলায়। মাত্র দশ সেকেন্ড বদলে দিয়েছে তাঁর জীবন, তিনি হয়ে উঠেছেন বিশ্বের ক্রীড়ামোদি মানুষদের আগ্রহের কেন্দ্রস্থল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link