ভারত-উইন্ডিজ ও একজন ল্যান্স গিবস

গায়ানায় জন্মগ্রহণকারী ল্যান্স গিবস মূলত ডানহাতি অফ স্পিনার হলেও ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন একজন লেগ স্পিনার হিসেবে! তাঁর হাতের আঙুলগুলো ছিল স্বাভাবিকের তুলনায় একটু বেশিই লম্বা। বোলিং অ্যাকশন ছিল ওপেন চেস্টেড, একজন অফ স্পিনারের জন্য যা কিছুটা অস্বাভাবিকই বটে।

শুরুতেই বলে নিচ্ছি, যারা ল্যান্স গিবসকে চেনেন না তাদের উদ্দেশ্যেই এই লেখার অবতারণা। ল্যান্স গিবস হলেন টেস্ট ক্রিকেটে ৩০০ উইকেট নেয়া প্রথম ‘স্পিনার’। গায়ানায় জন্মগ্রহণকারী ল্যান্স গিবস মূলত ডান-হাতি অফ স্পিনার হলেও ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন একজন লেগ স্পিনার হিসেবে! তাঁর হাতের আঙুলগুলো ছিল স্বাভাবিকের তুলনায় একটু বেশিই লম্বা। বোলিং অ্যাকশন ছিল ওপেন চেস্টেড, একজন অফ স্পিনারের জন্য যা কিছুটা অস্বাভাবিকই বটে।

৭৯ টেস্টে তাঁর শিকার ২৯.০ গড়ে ৩০৯ উইকেট। ইকোনমি রেট ১.৯৯! ইনিংসে পাঁচ উইকেট নিয়েছেন ১৮ বার আর ম্যাচে ১০ উইকেট ৩ বার। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তাঁর একটি হ্যাটট্রিকও আছে।

ল্যান্স গিবসের একটি বিখ্যাত স্পেল আছে টেস্টে। সেই গল্পই শোনাব আজকে।

১৯৬২ সালের মার্চ। বার্বাডোজে সিরিজের তৃতীয় টেস্টে মুখোমুখি ভারত এবং স্বাগতিক ওয়েস্ট ইন্ডিজ। প্রথম ইনিংসে ভারত করেছিল ২৫৮ রান। মজার ব্যাপার হল, তাদের ইনিংসে কোন ফিফটি ছিল না।

একটু বলে রাখা ভাল, এই টেস্ট দিয়েই মাত্র ২১ বছর বয়সে ‘ক্যাপ্টেন্সি’র অভিষেক হয়েছিল নবাব মনসুর আলী খান ওরফে ‘টাইগার’ পতৌদির। প্রথম ইনিংসে দলের টপ স্কোরারও ছিলেন তিনিই, ৬ বাউন্ডারিতে করেছিলেন ৪৮ রান। সমপরিমাণ রান অবশ্য করেছিলেন আরও একজন, তিনি হলেন ভারতের ইতিহাসে একমাত্র ‘আফগান’ বংশোদ্ভূত টেস্ট ক্রিকেটার সেলিম দুররানী; নেমেছিলেন ১০ নম্বরে। এছাড়া ওপেনার এম.এল জয়সিমহার ব্যাট থেকে এসেছিল ৪১ রান।

ক্যারিবিয়ানদের পক্ষে সর্বোচ্চ তিনটি উইকেট নিয়েছিলেন স্যার ওয়েস হল; এছাড়া স্যার ফ্র‍্যাঙ্ক ওরেল এবং স্যার গ্যারি সোবার্সের ঝুলিতে ছিল দুটি করে উইকেট।

জবাব দিতে নেমে ৪৭৫ রানের ‘এভারেস্ট’ গড়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ; কোন সেঞ্চুরি ছাড়াই! সর্বোচ্চ ৯৬ রান এসেছিল ৫ নম্বরে নামা জো সলোমনের ব্যাট থেকে; তাঁকে আউট করেছিলেন বাঁ-হাতি স্পিনার সেলিম দুররানী। ৭ নম্বরে নেমে ‘দ্বিতীয়’ সর্বোচ্চ ৭৭ রান করেছিলেন অধিনায়ক ফ্রাঙ্ক ওরেল। এই ‘দুজন’ ছাড়া ফিফটির দেখা পেয়েছিলেন আরও একজন; ওপেনার কনরাড হান্ট (৫৯)।

২১৭ রানে পিছিয়ে থেকে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিংয়ে নামে ভারত। চতুর্থ দিনের খেলা শেষে তাদের সংগ্রহ দাঁড়ায় ১২০ ওভারে ২ উইকেটে ১০৪ রান। না, ভুল পড়েন নি, ঠিকই পড়েছেন। রানের চেয়ে ওভারের সংখ্যাই ছিল বেশি!

হানিফ মোহাম্মদ ও ল্যান্স গিবস

ইনিংস পরাজয় এড়াতে তখনও লাগে ১১৩ রান। আর জয়ের জন্য উইন্ডিজের দরকার ৮ উইকেট। একটি রোমাঞ্চকর পঞ্চম দিনের খেলা যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছিল।

২৩ মার্চ, ১৯৬২। বার্বাডোজ টেস্টের পঞ্চম দিন। আমাদের গল্পের নায়কের আবির্ভাবও ঠিক এই দিনেই।

পঞ্চম দিন সকালের সেশনটা দুর্দান্ত কেটেছিল ভারতের। আগের দিনের অপরাজিত দুই ব্যাটসম্যান বিজয় মাঞ্জারেকার এবং দিলীপ সারদেশাই খেলছিলেন দাপটের সঙ্গে। ব্যাট হাতে অবিশ্বাস্য দৃঢ়তা দেখিয়ে কোন উইকেট না হারিয়েই তাঁরা পার করে দিলেন পুরো সেশন। ইনিংস পরাজয়ের দুশ্চিন্তা কাটিয়ে উঠে ভারতীয় শিবির তখন ড্রয়ের স্বপ্ন দেখছে।

এদিকে ফ্রাঙ্ক ওরেলের কপালে চিন্তার ভাঁজ। নিশ্চিত জেতা ম্যাচটা কি শেষ পর্যন্ত হাতছাড়া হয়ে যাবে?

লাঞ্চের পর আবার শুরু হল খেলা। ভারতের স্কোর তখন ১৫৪ ওভারে ১৫৮/২। সেঞ্চুরি পার্টনারশিপ থেকে মাত্র ২ রান দূরে মাঞ্জারেকার-সারদেশাই জুটি। ঠিক এই মুহূর্তে দৃশ্যপটে আবির্ভূত হলেন টল, ল্যাঙ্কি অফ স্পিনার ল্যান্স গিবস। যিনি ইতিমধ্যেই ৩৮ ওভার বোলিং করে ফেলেছেন, কোন উইকেট না পেলেও রান দিয়েছেন মাত্র ৩২!

অ্যান্ড দেন সামথিং ম্যাজিকাল হ্যাপেন্স!

হঠাৎ করেই ভয়ঙ্কর টার্ন এবং বাউন্স পেতে আরম্ভ করলেন গিবস। লেন্থে পড়ে একেকটা বল যেন সাপের মত ছোবল দিচ্ছিল। উইজডেনের ভাষায়, ‘He was spinning the ball like a top.’

দিলীপ সারদেশাইকে (৬০) লেগ স্লিপে সোবার্সের দুর্দান্ত ক্যাচে পরিণত করে ৯২ ওভারে ৯৮ রানের ‘ম্যারাথন’ জুটিটা ভাঙলেন গিবস। এরপর ফ্লাইটের বৈচিত্র‍্যে বোকা বানালেন ‘ওয়েল সেট’ বিজয় মাঞ্জারেকারকেও (৫১)। অন ড্রাইভ খেলতে চেয়েছিলেন বিজয়, কিন্তু ইনসাইড এজ হয়ে ধরা পড়লেন সিলি মিড অনে ওঁত পেতে থাকা ফিল্ডার ফ্রাঙ্ক ওরেলের হাতে।

মাত্র কয়েক বলের ব্যবধানে দুই সেট ব্যাটসম্যানকে হারিয়ে ভারতীয় ড্রেসিংরুমে তখন আতঙ্ক বিরাজ করছে। ক্রিজে আসলেন প্রথম ইনিংসের টপ স্কোরার টাইগার পতৌদি। সবার মনে একটাই প্রশ্ন, দলের এই ঘোর বিপদের মুহূর্তে তিনি কি পারবেন আরও একটা ক্যাপ্টেন্স নক উপহার দিতে? কিন্তু না, তিনি টিকলেন মোটে ২ বল! গিবসের অনেক খানি বাঁক খেয়ে ভেতরে ঢোকা একটা ডেলিভারিতে ক্যাচ দিলেন ব্যাকওয়ার্ড স্কয়ার লেগে, সোবার্সের বিশ্বস্ত হাতে।

১৫৮/২ থেকে মুহূর্তের মধ্যে ভারতের স্কোর গিয়ে দাঁড়াল ১৫৯/৫! ‘গিবস ঘূর্ণি’ সামাল দিয়ে ভারত কি পারবে ম্যাচ বাঁচাতে? সেই চেষ্টাটাই করলেন স্পিনের বিপক্ষে সর্বকালের সেরাদের একজন বলে স্বীকৃত ব্যাটসম্যান পলি উমরিগড় এবং চান্দু বোর্দে। প্রায় ১০ ওভার টিকে থেকে দুজন মিলে স্কোরটাকে নিয়ে গেলেন ১৭৪ রানে। কিন্তু আবারও সেই গিবসের আঘাত।

গিবসের দুর্দান্ত এক আর্মারে ধরাশায়ী হলেন উমরিগড় (১০)। ব্যাটের বাইরের কিনারা ছুঁয়ে ধরা পড়লেন উইকেটকিপার ডেভিড অ্যালেনের গ্লাভসে।

ভারতের স্কোর তখন ১৭৭/৬। স্ট্রাইকে আছেন চান্দু বোর্দে। গিবসের কিছুটা শর্ট অব লেন্থের ডেলিভারি। টার্ন করে লেগ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল। সজোরে পুল করলেন চান্দু। কিন্তু স্কয়ার লেগে শূন্যে লাফিয়ে অবিশ্বাস্য এক ক্যাচ লুফে নিলেন ফ্রাঙ্ক ওরেল। নিজের চোখকে যেন কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না তিনি।

চান্দু বোর্দের (৮) বিদায়ে ক্রিজে এলেন উইকেটরক্ষক ফারুক ইঞ্জিনিয়ার। ‘সোয়াশবাকলার’ হিসেবে বরাবরই সুখ্যাতি ছিল তাঁর। গিবসকে সামলানোর উপায় হিসেবে তিনি বেছে নিলেন প্রতি আক্রমণকে। কিন্তু লাভ হল না। তেড়েফুঁড়ে মারতে গিয়ে বিভ্রান্ত হলেন বলের ফ্লাইটে; উইকেটের পেছনে সহজ স্টাম্পিংয়ের শিকার হয়ে ফিরলেন খালি হাতে।

ইঞ্জিনিয়ারের বিদায়ে ভারতের ম্যাচ বাঁচানোর শেষ আশাটুকুও নিভে গেল দপ করে। শেষমেশ ইনিংস ব্যবধানেই হারতে হল তাদের। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই সেলিম দুররানী (৫) ও রমাকান্ত দেশাইয়ের (১) উইকেট দুটো তুলে নিয়ে ভারতীয় ইনিংসের লেজটাও মুড়ে দিলেন গিবস।

সফরকারী ভারতের ১৮৫.৩ ওভারের প্রতিরোধ সেদিন থেমে গিয়েছিল ল্যান্স গিবসের ৯৩ বলের অতিমানবীয় এক স্পেলে। লাঞ্চের পর টানা ১৫.৩ ওভারের বিধ্বংসী সেই স্পেলে মাত্র ৬ রানের বিনিময়ে যিনি তুলে নিয়েছিলেন ৮ উইকেট! যার ১৪টাই ছিল মেডেন ওভার! ইনিংস শেষে গিবসের বোলিং ফিগারটা দেখাচ্ছিল এরকম, ৫৩.৩-৩৭-৩৮-৮!

গিবসের অবিশ্বাস্য সেই স্পেল সম্পর্কে উইজডেন লিখেছিল, ‘Single handedly, Lancelot Richard Gibbs, bowling the spell of his life that came out of the blue, hands an innings defeat to a team consisting of some of the best players of spin at that time.’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link