লারা বনাম গাঙ্গুলি, বাঁ-হাতের খেল

অনেকেই আমাকে সৌরভ গাঙ্গুলির কট্টর সমালোচক বলে জানেন। এটা নিয়ে ভাবতে বসে দেখলাম, সত্যি ই গাঙ্গুলিকে নিয়ে সেভাবে কখনো কিছু লেখা হয়নি। তার প্রধান কারণ হলো বাঙালি বলে অনেকেই তাঁকে নিয়ে অনেক কিছু লিখে বা বলে দিয়েছেন, তাই নতুন করে লেখার মতো কিছু পাইনি।

কিন্তু, আজকে হঠাৎ একটা বিষয় মাথায় এলো। দুজন শ্রেষ্ঠ বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যান, ওয়ানডে তে, তাঁদের ক্যারিয়ার নিয়ে কোনোদিন সেভাবে তুলনা হতে দেখিনি। কেননা একজন তাঁর দেশের সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে স্বীকৃত, অন্তত প্রথম দুইয়ে তো থাকবেনই, আরেকজন, নিজের দেশের সর্বকালের সেরা দশ ব্যাটসম্যানের মধ্যে আসবেন কিনা সেই নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে বিতর্ক আছে।

হ্যাঁ, দ্বিতীয়জন সৌরভ গাঙ্গুলি, আর প্রথমজন? হ্যাঁ, অবাক লাগলেও, ব্রায়ান চার্লস লারা। লারা আর শচীনের তুলনা দেখে দেখে সবাই নিশ্চই ক্লান্ত, কেননা সে বিতর্কের কোনো শেষ নেই, কিন্তু লারা বনাম গাঙ্গুলি? সেটা কেমন? আদৌ সম্ভব কি এই তুলনা? আজকে আমি শুধু দুজনের ওয়ান ডে পারফরমেন্স নিয়ে কিছু কথা বলবো। কেননা টেস্ট ব্যাটসম্যান হিসেবে গাঙ্গুলির অতি বড়ো সমর্থক ও আশা করি মেনে নেবেন যে লারা অনেক এগিয়ে।

ইন্টারেষ্টিং বিষয় হলো, দুজনের ওয়ানডে ব্যাটিং স্ট্যাট, খুবই কাছাকাছি। লারা খেলেছেন ২৯৯ টি ওয়ান ডে, রান করেছেন ১০৪০৫, গড় ৪০.৫ এবং ১৯ টি সেঞ্চুরি, সর্বোচ্চ ১৬৯। গাঙ্গুলি সেখানে খেলেছেন ৩১১ টি ম্যাচ, রান করেছেন ১১৩৬৩, গড় ৪১, ২২ টি সেঞ্চুরি, সর্বোচ্চ ১৮৩। স্ট্যাট এর বিচারে তুল্যমূল্য, এবং কোনো ক্ষেত্রেই লারা কে এগিয়ে রাখা যাবেনা।

লারা ওপেনার এবং ৩/৪ নম্বর ব্যাটসম্যান হিসেবে অধিকাংশ ওয়ানডে খেলেছেন, গাঙ্গুলিও মূলত ওপেনার হিসেবেই খেলেছেন, তাই ব্যাটিং পসিশন নিয়ে কেউ সুবিধা পেয়েছেন সেটা বলা যায়না।

এখানে একটা উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, লারা যখন ৪ নম্বর এ নেমেছেন, তার ব্যাটিং গড় ৮৪ ম্যাচে ৩৩.৫, একদমই লারাচিত নয়, যেটা তার কেরিয়ার গড় কে ৪৪ এর আশেপাশে থেকে ৪০ এর আশেপাশে নামিয়ে এনেছে। অন্যদিকে গাঙ্গুলি ওপেনিং এবং ৩ নম্বর এ দুর্দান্ত গড় রেখে রান করেছেন, বাকি পসিশন এ তার তেমন ভূমিকা নেই তাই সেগুলো উপেক্ষা করা যায়।

সেঞ্চুরির ক্ষেত্রে, লারার ১৯ টি সেঞ্চুরির মধ্যে ১৬ টায় দল জিতেছে, অর্থাৎ উইনিং পার্সেন্টেজ ৮৪ এর বেশি। অন্যদিকে গাঙ্গুলির ২২ টি সেঞ্চুরির মধ্যে দল জিতেছে ১৮ টি তে, অর্থাৎ এখানেও পার্সেন্টেজ ৮২, প্রায় কাছাকাছি। এর মধ্যে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি ফাইনালের ১১৭ এর ইনিংস আছে, যে ম্যাচ টা হারার জন্যে সৌরভ কোনোভাবেই দায়ী নন।
সৌরভের সেঞ্চুরিগুলির মধ্যে বিদেশের মাঠে ১৮ টি, এখানেও পার্সেন্টেজ ৮২, যা ওয়ানডে তে দারুণ বলা চলে, অন্যদিকে লারা দেশের মাঠে ৬ টি ও বিদেশে ১৩ টি সেঞ্চুরি করেন। এখানে লারা একটু হলেও পিছিয়ে।

ওয়ানডের একটা বড়ো ফ্যাক্টর হলো ব্যাটসম্যানের স্ট্রাইক রেট, যেটা গোটা ক্যারিয়ার ধরলে গাঙ্গুলির ৭৩.৭ এবং লারার প্রায় ৮০। এখানে লারা একটু হলেও এগিয়ে, কেননা তিনি গাঙ্গুলির বেশ কয়েক বছর আগে খেলা শুরু করেন যখন ওয়ান ডে তে রান একটু কম উঠতো, যদিও রিটায়ারমেন্ট এর সময়কাল প্রায় একইসাথে। দুজনের ম্যান অফ দা ম্যাচ এর সংখ্যা সৌরভের ৩২ এবং লারার ৩০।

এখনো অবধি যা স্ট্যাট দেখা গেছে, তাতে কেউ কারুর থেকে অনেক এগিয়ে এমন বলা যাচ্ছে না, তবুও, ওয়ান ডে তে কার্যকরী ক্রিকেটার হিসেবে আমি সৌরভ কে লারার থেকে এগিয়ে রাখবো, প্রশ্ন হচ্ছে কেন?

কারণটা আমার যেটা মনে হয়, সৌরভ এর ইম্প্যাক্টফুল ইনিংস গুলো অধিকাংশ এসেছে ওয়ার্ল্ড কাপ, আইসিসি টুর্নামেন্ট বা ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্ট এর গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ এ। ঢাকার ফাইনাল, নাইরোবির ফাইনাল, ২০০৩ বিশ্বকাপ এর ৩ টি সেঞ্চুরি, ৯৯ বিশ্বকাপ এর বাঁচা-মরার ম্যাচে মহাকাব্যিক ১৮৩ (হ্যাঁ, সেঞ্চুরির আগে স্লো খেলেছিলেন বলে আমি বলে থাকি, কিন্তু পরের ২৮ বলে সেটা মেকআপ করেও আরো বেশি কিছু করেছিলেন, বরং আজহার আর জাদেজার হিরোগিরি না থাকলে প্রথম ওয়ান ডে ২০০ র মালিক শচীন টেন্ডুলকার হতেন কিনা সেটা তর্কসাপেক্ষ)।

লারার ৯৬ বিশ্বকাপ এর কোয়ার্টার ফাইনাল এর ১১১ আর ২০০৩ এর প্রথম ম্যাচে ১১১ আছে, যে দু ক্ষেত্রেই দক্ষিণ আফ্রিকা কে হারায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ, কিন্তু লারা নিজের দেশ কে কোনো বড়ো ট্রফি দিতে পারেন নি। সবসময় যে তিনি দুর্বল দলের হয়ে খেলেছেন সেই যুক্তি মানা যায়না, কেননা অন্তত নব্বই এর দশকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ যথেষ্ট শক্তিশালী দল ছিল।

হ্যাঁ, ২০০৪ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি লারার অধিনায়কত্বে জেতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, কিন্তু গোটা টুর্নামেন্টে ৪ ম্যাচে ১১৪ রান ও একটিও হাফ সেঞ্চুরি না থাকা লারাকে এই জয়ের প্রধান কারিগর মানা সম্ভব হচ্ছে না। অন্যদিকে সৌরভ অনেকগুলি ফাইনালে হারলেও, নিজের পারফরমেন্স দিয়ে দলকে বিভিন্ন প্রতিযোগিতার ফাইনাল বা সেমিফাইনালে তুলেছেন।

ঢাকা এবং ন্যাটওয়েস্ট জয়ে তাঁর ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ, অন্যদিকে অধিনায়ক হিসেবে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি ফাইনালে তোলা, যুগ্মজয়ী হওয়া, বিশ্বকাপ ফাইনালে ওঠা ইত্যাদি আছেই, এবং প্রতি ক্ষেত্রেই নিজের ব্যাটিং ও অনেকক্ষেত্রে বোলিং পারফরমেন্স দিয়ে তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। ১৯৯৭ এর সাহারা কাপ, আলাদা করে কিছু বলার নেই, একটি সিরিজে যেকোনো ভারতীয় ক্রিকেটারের অলরাউন্ড পারফরমেন্সের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন ওটা।

অতি বড়ো সৌরভ সমালোচক ও অস্বীকার করতে পারবেন না, পিক ফর্মের সৌরভ যখন ওয়ানডে তে ব্যাট করতেন, সচিন তেন্ডুলকারকেও তার পাশে অনেকসময় ফিকে লাগতো। অথচ, আমরা তুলনা সবসময় করি লারার সাথে সচিনের, গাঙ্গুলি একটু ব্রাত্যই থেকে যান, অথচ ওয়ানডে তে তিনি ভারতের সর্বকালের সেরা তিন ব্যাটসম্যানের মধ্যে অবশ্যই আসবেন ( বাকি দুজন আমার মতে সচিন আর কোহলি)।

তাহলে কি সৌরভ সেঞ্চুরির আগে স্লো খেলতেন না? খেলতেন, কিছু ম্যাচে তার প্রমাণিত পরিসংখ্যান আছে, কিন্তু এটাও অস্বীকার করা যাবেনা, ইনিংস এর শুরুতে বাউন্ডারি মারা, বা সেঞ্চুরি হয়ে গেলে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠা, এগুলো ও তার মধ্যে ছিল। অফসাইডে তাকে আটকানোর জন্যে ৭-২ ফিল্ড ও বিপক্ষকে করতে দেখা গেছে।

সব ক্রিকেটারের দুর্বল দিক থাকে, সৌরভেরও আছে, কিন্তু সেটা তাকে সর্বকালের অন্যতম সেরা ওয়ানডে ব্যাটসম্যান হওয়া থেকে আটকায়নি। আমার (যাদের লাইভ দেখেছি) প্রিয় সেরা দশ ক্রীড়াবিদ ( শুধুই ক্রিকেটার নয়) এর তালিকায় সৌরভ আসেন, বাকিরা হলেন ফেদেরার, শচীন, লিয়েন্ডার পেজ, যুবরাজ সিং, লিওনেল মেসি, রাহুল দ্রাবিড়, অভিনব বিন্দ্রা, রোনালদিনহো এবং বিরাট কোহলি।

মতানৈক্য থাকতেই পারে, অনেকে হয়তো লারাকে অনেক বড়ো ব্যাটসম্যান বলবেন, কিন্তু সেই জন্যেই আমি টেস্ট ম্যাচ কে এই তুলনার বাইরে রেখেছি। ওয়ান ডে তে অন্তত স্ট্যাট এবং ইমপ্যাক্ট এবং দলগত জয়ে ভূমিকা নেবার ক্ষেত্রে সৌরভ লারার থেকে এগিয়ে। কয়েক যোজন হয়তো নয়, কিন্তু এগিয়ে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link