সর্বকালের সেরা ফুটবলার কে? এই প্রশ্নের উত্তরে কেউ পেলে বা কেউ ম্যারাডোনাকে বলে বসতেই পারেন, তাতে কিচ্ছু যায় আসবে না। বর্তমানে যারা খেলছেন তাদের মধ্যে কে সেরা? সেই উত্তরে তো যুদ্ধই লেগে যায় মেসি আর রোনালদো ভক্তদের মধ্যে। এতে আসলে দোষের কিছু নেই। কিন্তু যদি প্রশ্ন করা হয় সর্বকালের সেরা গোলরক্ষক কে, তার উত্তরে দ্বিধার কোন স্থান কিন্তু নেই।
সর্বকালের সেরা গোলরক্ষক এমন একজন যার আসলে ফুটবলার হবার কথাও ছিল না, ১৩ বছর বয়সে যেই কিশোর যুদ্ধশ্রমিক হিসাবে কাজ করে অস্ত্রের কারখানায় তাঁর ফুটবলার হবার কোনো কারন আছে কি? আর একটু বলি – এই ব্যক্তি ১৮ বছর বয়সে নার্ভাস ব্রেকডাউনের কবলে পড়ে গিয়েছিলেন! এখান থেকে ভালোমত বেঁচে থাকাটাই তো দুস্কর, সেখানে তিনি হয়ে উঠলেন ব্ল্যাক প্যান্থার!
সবাই সম্ভবত বুঝেই গেছেন কার কথা বলছি। লেভ ইয়াসিন নামের এই ভদ্রলোক কেমন গোলরক্ষক ছিলেন তা বোঝানোর জন্যে একটা তথ্য দিলেও কিন্তু হয়, সেটা হচ্ছে তিনি ‘ব্যালন ডি অর’ জয়ী একমাত্র গোলরক্ষক। গর্ডন ব্যাঙ্কস, সেপ মাইয়ার, জিলমার, দিনো জফ থেকে শুরু করে জিয়ানলুইজি বুফন, আলিভার কান, ম্যানুয়াল নয়াররাও যা পাননি সেই ব্যালন ডি’অর তিনি জিতেছিলেন।
১৯২৯ সালের ২২ অক্টোবর তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমান রাশিয়া) মস্কোতে জন্ম নেন লেভ। এমন এক মাতাল সময় যখন যুদ্ধের দিকে পৃথিবীর অদম্য মোহ। এমন এক শহরে জন্ম নেন তিনি যেই শহর যুদ্ধের এক কেন্দ্র। এমন এক অস্থির সময়ে জন্ম নেয়ায় শৈশবটা ঠিক শিশুদের মত করে কাটতে পারে নি তাঁর। পেটের দায়ে কাজ শুরু করেন কারখানায় যেখানে বানানো হতো গুলি।
সারাদিন হাড় ভাঙা খাটুনির পর একটু ফুটবল খেলেই যা আনন্দ টুকু পেতেন তিনি বা তার বন্ধুরা যাদের নিয়তি একই পথে হাটছিলো। কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে যখন তিনি মাত্র পড়লেন বয়স ১৮, তখন আর ধকল সহ্য করার মত ধৈর্য ধরতে পারলেন না। মানসিক চাপে নার্ভাস ব্রেকডাউন হয় তার। কারখানার কাজ ছেড়ে দেবার জন্যে যোগ দেন সেনাবাহিনীতে।
সেনাবাহিনী তে যোগ দেবার পর ভাগ্য ফিরে যেতে শুরু করে লেভের। সেখানে ফুটবল খেলার সুযোগ ছিলো, লেভ খেলতেন। এভাবেই তিনি চোখে পড়ে যান ফুটবলার ‘আকার্দি চেরনিসেভ’- এর যিনি ডায়নামো মস্কো’র স্কাউট ছিলেন। বছর ঘুরতেই ডায়নামোর ডাক পেয়ে বসলেন তিনি। আর শুরু হলো আরেক গল্পের।
১৯৫০ সালে ডাইনামো মস্কো যুবদলের হয়ে মাঠে নামেন। কোনো ঝলক তো দেখন ই নি বরং পারফরম্যান্স ছিলো বিবর্ণ। দলের সাথে ধীরে ধীরে মানিয়ে নিতে থাকেন। বছর তিনেক যাবার পর তিনি চলে আসেন মূল দলে। কিছুদিনের মধ্যেই দেখা যায় ক্লাবের গোলপোস্টের নিচের জায়গাটা লেভ পাকাপাকিভাবে দখল করে বসেছেন! হ্যা, পাকাপাকি ভাবেই বলা যায় কারণ তাঁর অবসরের আগ পর্যন্ত আর কেউ তাকে সরাতে পারে নি।
ক্লাব পারফর্মেন্সে চলে আসেন জাতীয় দলে। সিডনি অলিম্পিকে সোনা জিতে দল। আর জাতীয় দলে পাকাপাকি বসে যান তিনি। এর পর চারটি বিশ্বকাপে দলে ছিলেন তিনি (শেষ বিশ্বকাপে দলে থাকলেও নামতে পারেননি) ৷ প্রথম দুই বিশ্বকাপ এ দল তেমন ভালো কিছু করতেও পারে নি কিন্তু তার তৃতীয় বিশ্বকাপ ১৯৬৬ সালে রাশিয়া চলে যায় সেমি ফাইনালে, যেখানে অসামান্য অবদান রাখেন লেভ।
ফুটবল বিশ্ব রাশিয়ার স্থান সব সময়ই ছিলো, কিন্ত রাশিয়া কোনো সময়ই পরাশক্তি ছিলো না, সেই রাশিয়ার বিশ্বকাপে সেমিফাইনালিস্ট হওয়া নি:সন্দেহে যথেষ্ট ভালো পারফর্মেন্স যদিওবা ১৯৬০ সালে ইউরোর চাম্পিয়ান হবার মত কীর্তিও রাশিয়ার ছিলো। বলে নিই, লেভ ব্যালন ডি’অর জেতেন তার দ্বিতীয় বিশ্বকাপের পর ১৯৬৩ সালে।
১৯৭১ সালে ক্যারিয়ার শেষ করেন লেভ। তার বিদায়ী ম্যাচে মস্কোতে লাখো মানুষ জড়ো হয়েছিলে। লুঝনিকি স্টেডিয়ামে নেমেছিলেন পেলে, বেকেনবাওয়ার, ইউসেবিওদের মত কিংবদন্তীরা।
পর্তুগীজ কিংবদন্তি ইউসেবিওর মতে লেভের সাথে তুলনীয় কোনো গোলরক্ষক এই গোটা শতাব্দীতে নেই। আরেক কিংবদন্তী গোলরক্ষক গর্ডন ব্যাঙ্কসের মতে লেভ হচ্ছেন গ্রহের একমাত্র সুপার গোলরক্ষক। ইতালিয়ান কিংবদন্তি স্ট্রাইকার ‘সান্দ্রা মজেল্লা’র এক অবিশ্বাস্য পেনাল্টি ফিরিয়ে দেন লেভ, এরপর সান্দ্রা বলেছিলেন, ‘লেভ আমর চাইতেও ভালো ফুটবলার।’
কালো মানিক পেলে নিজেকে সৌভাগ্যবানই ভাবতেন এই জন্যে যে, তাকে মাঠে লেভের মুখোমুখি হতে হয়নি। একজন নিখুত গোলরক্ষকের মধ্যে যা যা থাকা দরকার তার সবই লেভের ছিলো। আসামান্য রিফ্লেক্স, আর অতিমানবীয় পজিশন জ্ঞ্যান তাকে কিংবদন্তি করে ফেলেছে, ১৫০ টি পেনাল্টি সেভ করেই তিনি অমরত্ব পেয়ে যেতে পারতেন, কিন্তু যখন জানবেন লেভ ২৭০ টি ম্যাচে ক্লিন শিট ধরে রেখেছেন তখন চোখ কপালে উঠতে আপনার বাধ্য।
অসম্ভব দ্রুত বল ক্লিয়ার করতে লেভ ছিলেন অতুলনীয়। তার গতিও ছিলো দুর্দান্ত। একজন নিখুঁত গোলরক্ষকের এর বাইরে আর কোনো গুন না থাকলেও চলে। ওহ, আরেকটা কথা তো বলাই হয় নি, লেভ কিন্তু আইস হকিও খেলতেন, যেনতেন নয়, খেলেছেন জাতীয় পর্যায়ে। শুরুতে ‘আকার্দি চেরনিসেভ’ নামের যেই ভদ্রলোকের নাম বলেছিলাম, যিনি প্রথম চোখ রাখেন লেভের উপর, সেই আকার্দিও কিন্তু আইস হকি খেলতেন, এবং ফুটবলও।
গ্রহের একমাত্র সুপার গোলরক্ষক নিজের গ্লাভস আর কালো জার্সি তুলে রেখে কিন্ত ফুটবল থেকে সরে যাননি। এর পর তিনি অনেক প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্বে কাজ করেছেন। ছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়ন ফুটবল ফেডারেশনের সহ সভাপতি। অলংকৃত করেছেন ডায়নামো মস্কো অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদ। মস্কোর লুঝনিকি স্টেডিয়ামের সামনে তাঁর একটি উড়ন্ত ব্রোঞ্জের মুর্তি আছে, এতেই স্পষ্ট বোঝা যায়, তিনি ক্লাবের জন্যে কত বড় সম্পদ ছিলেন।
১৯৯০ সালে ক্যান্সারে মারা যান তিনি। তার শেষকৃত্য রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সম্পন্ন হয়। দেয়া হয় ‘মাস্টার অফ স্পোর্ট’ সম্মাননা।
শেষ করি বর্তমান নিয়ে একটু কথা বলে। ২০১৮ এর রাশিয়া বিশ্বকাপ উপলক্ষে রুশ সরকার ১০০ রুবলের নোট বাজারে ছাড়ে। কিন্ত নিমিষেই শেষ হয়ে যায় সব নোট, বাজার খালি। কিন্তু কেন শেষ? নোটে ছাপানো ছিলো লেভ ইয়াসিনের ছবি ছিলো। ছিলো লেভের দিকে তাকিয়ে থাকা এক শিশুও, যে দেখছে বল ধরার জন্যে গোলপোস্টের দিকে উড়ে যাচ্ছেন লেভ।
লেভ ইয়াসিন যেই রাশিয়ায় খেলেছেন সেই রাশিয়া আর নেই। কয়েক যুগ আগেই ভেঙে গিয়েছে সোভিয়েত সাম্রাজ্য৷ কিন্ত লেভ ইয়েসিন এসব কিছুর ঊর্ধ্বে গিয়ে আজও সবার ভালবাসার কেউ। যার কোনো সীমানা কেউ টানতে পারে না।