২০১৫ বিশ্বকাপের গ্রুপপর্বে বাংলাদেশের কাছে হেরে বিদায় নেবার পর বড় পরিবর্তন আসে ইংল্যান্ড ক্রিকেটে। সেকেলে রক্ষণাত্নক মানসিকতার ইংরেজরা খেলতে শুরু করে আক্রমণাত্মক ক্রিকেট। নিজেদের প্রতিষ্ঠা করে ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা আক্রমণাত্নক দল হিসেবে। ফলস্বরূপ ঘরের মাঠে অনুষ্ঠিত হওয়া ক্রিকেট বিশ্বকাপের শিরোপা জিতে নেয় তাঁরা।
কিন্তু, সমস্যা বাঁধে অন্য জায়গায়। টি টোয়েন্টিতে তাঁরা পাচ্ছিলো নাহ প্রত্যাশিত সাফল্য। বিশেষ করে জস বাটলারের ওপেনিং করা এবং মরগ্যান-স্টোকসের অফফর্ম ভাবাচ্ছিল তাদেরকে। ঠিক এমন সময়ই শান্তির পরশ বুলিয়ে ইংলিশ ক্রিকেটে আগমন পোড়খাওয়া এক বিস্ময়বালকের, লিয়াম লিভিংস্টোন তাঁর নাম।
১৯৯৩ সালে ইংল্যান্ডের ক্যামব্রিয়া নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আমাদের গল্পের নায়ক লিভিংস্টোন। প্রথাগত ইংরেজ ক্রিকেটারদের মতো উঠে আসার গল্পটা মসৃণ ছিল না লিভিংস্টোনের। বেশিরভাগ প্রতিভাবান ক্রিকেটাররা যেখানে ১৮-১৯ বছর বয়সেই সুযোগ পেয়ে যান জাতীয় দলে সেখানে লিভিংস্টোনের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে ২৩ বছর বয়সে।
যদিও, অভিষেকের আগে নান্টউইচ নামক ক্লাবের হয়ে ১৩৮ বলে ৩৫০ রানের ইনিংস ইংরেজ মিডিয়াকে তাক লাগিয়ে দেন। এই ইনিংসকে ইংল্যান্ডের ঘরোয়া ক্রিকেটের ইতিহাসের সেরা ইনিংস বলে আখ্যায়িত করেন অনেকে। যদিও ম্যাচটি লিস্ট এ স্বীকৃত ছিল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও কাউন্টির কোনো দলই তাকে দলে নিতে আগ্রহী ছিল না।
অবশেষে ২০১৬ মৌসুমে তাকে দলে টানে ল্যাঙ্কারশায়ার। লিভিংস্টোন নিজেও বুঝেছিলেন এটা তার ক্যারিয়ারের একমাত্র সুযোগ, সফল না হলে আস্তাকুঁড়েতে নিক্ষিপ্ত হতে হবে তাকে। কঠোর পরিশ্রমের ফলাফল কয়েক মাসের মাঝেই পেয়ে যান তিনি, বনে যান ল্যাঙ্কারশায়ার সমর্থকের চোখের মণি।
পরের মৌসুমে অধিনায়কের দায়িত্বও এসে বর্তায় তার কাঁধেই। সে বছরেরই আগস্টে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টি টোয়েন্টি অভিষেক ঘটে লিভিংস্টোনের, যদিও তেমন ভালো করতে পারেননি। ডাক পেয়েছিলেন টেস্ট দলেও কিন্তু মাঠের নামার সুযোগ হয়নি। ইংল্যান্ড দলে ততদিনে জায়গা পাকা করে ফেলেছেন বেন স্টোকস, মঈন আলি, জস বাটলার, স্যাম কারানরা। ফলে দল থেকে ছিটকে যান তিনি।
লিভিংস্টোন একজন প্রকৃত টি টোয়েন্টি ক্রিকেটার। বিধ্বংসী সব শট খেলার পাশাপাশি ইনিংস বড় করতে তিনি সিদ্ধহস্ত। পাশাপাশি ফিল্ডার হিসেবেও তার দক্ষতা প্রশ্নাতীত। বাউন্ডারিতে দাঁড়িয়ে অসাধারণ সব ক্যাচ লুফে নিতে তিনি অদ্বিতীয়। তার এই প্রতিভা চোখ এড়ায়নি ফ্রাঞ্চাইজি দলগুলোর। ফলে জাতীয় দলে নিয়মিত হতে না পারলেও নিয়মিত খেলেছেন বিশ্বজুড়ে টি টোয়েন্টি টুর্নামেন্টগুলোতে। বিগ ব্যাশ, আইপিএল, সুপার লিগ, পিএসএলের মতো টুর্নামেন্টগুলোতে তাঁর চাহিদা ছিল আকাশচুম্বী।
এ বছরের শুরুর দিকে টি টোয়েন্টি দল নিয়ে বিপদে পোরে ইংল্যান্ড দল। জো রুটের ১১০ স্ট্রাইকরেট, বেন স্টোকসের ইনজুরির পাশাপাশি অধিনায়ক মরগ্যান-মঈন আলির ফর্মহীনতা আবারো লিভিংস্টোনের সামনে খুলে দেয় জাতীয় দলের দুয়ার। দ্বিতীয়বারের মতো পাওয়া এই হাতের মুঠো স্বপ্নকে আর দূরে সরাতে পারেননি লিভিংস্টোন। দুহাত ভরে কাজে লাগিয়েছেন সুযোগ।
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রথম সুযোগেই রান করেছেন ৪৩ গড়ে। তবে লিভিংস্টোনের সবচেয়ে বিধ্বংসী রূপ দেখেছে বোধহয় পাকিস্থান। নটিংহ্যামশায়ারে সেদিন পাকিস্তানের শাহীন শাহ আফ্রিদি, ইমাদ ওয়াসিম, শাদাব খান, হাসান আলীদের রীতিমত পাড়ার বোলারদের পর্যায়ে নামিয়ে এনেছিলেন তিনি।
তার ৪৩ বলে ১০৩ রানের ইনিংসে ছিল ছয়টি চারের পাশাপাশি নয়টি ছয়ের মার। সেটি ছিল ইংল্যান্ডের টি টোয়েন্টি ইতিহাসের সবচেয়ে দ্রুততম সেঞ্চুরি। পরের ম্যাচেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে রান আউট হবার আগে খেলেন ঝড়ো এক ইনিংস, ১৩ বলে ৫ ছয়ে করেন ৩৮ রান।
সম্প্রতি মানসিক অবসাদের কারণে ক্রিকেট থেকে সাময়িক বিরতি নিয়েছেন বেন স্টোকস। ইয়ন মরগ্যান-মঈন আলিরা ভালো ইনিংস খেলতে পারছেন না অনেকদিন। সব মিলিয়ে এবারের টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড তাকিয়ে থাকবে তাদের অভিমানী বালকের উপর। ২০১০ বিশ্বকাপের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে পুরো মিডল অর্ডার সামলানোর দায়িত্ব থাকবে তার উপর। লিভিংস্টোনের ব্যাট হাসলেই না কেবল হাসবে পুরো ইংল্যান্ডবাসী।