সারা বিশ্বের হিসাব বাদ দিন। এক ইংল্যান্ডেই যে সব কিংবদন্তি ক্রিকেটার জন্মেছেন, তাঁর পাশে মার্ক রামপ্রকাশের নাম উচ্চারণ করা অসম্ভব। অথচ এই মানুষটিই ইংল্যান্ডের কাউন্টি ক্রিকেটের একজন সত্যিকারের কিংবদন্তি। তার কাউন্টি ও জাতীয় দলের পারফরম্যান্স পাশাপাশি রাখলে চোখ বড় বড় হয়ে যায় বিস্ময়ে। আর এই বিস্ময়টুকুই রামপ্রকাশের ক্যারিয়ারের পরিচয়।
মার্ক রামপ্রকাশের জন্ম ৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৬৯ সালে। ঘরোয়া ক্রিকেটে একজন ধারাবাহিক রান সংগ্রাহক। তাঁর কাউন্টি ক্যারিয়ারের সেই ফর্ম কখনো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিয়ে আসতে পারেননি। জাতীয় দলে আসার আগে কাউন্টি ক্রিকেটে থাকাকালীন সময়ে বিবেচনা করা হত, তিনি হবেন ইংল্যান্ডের ব্যাটিং লাইন আপের একজন কাণ্ডারি। কিন্তু সেটা আর হয়ে ওঠা হয়নি মার্ক রামপ্রকাশের পক্ষে।
২০১২ সালের জুলাই মাসে লন্ডনে বসেছিল গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকের আসর। ঠিক সেই সময়ে লন্ডন থেকে দক্ষিণের এক কোণায় নিজের ক্যারিয়ারের বিদায় জানান মার্ক রামপ্রকাশ। তাঁর বিদায়ে বৃটিশ গণমাধ্যম এবং তাঁর সতীর্থরা কিছুটা হলেও সাড়া জাগানিয়া কথা বলেন। কিন্তু সেটি সবার আড়ালেই থেকে গিয়েছিল। অলিম্পিকের ডামাডোলে চাপা পড়ে গিয়েছিলেন রামপ্রকাশ।
খালি চোখে তাঁর আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের দিকে তাকালে কখনোই তাকে খুব ভালো মানের ক্রিকেটার বলে মনে হবে না। মনে হবে এই রকম কত ক্রিকেটারই এলো গেলো। কিন্তু এক দিক একটু বেশিই বিশেষ অবস্থানে আছেন মার্ক রামপ্রকাশ।
টেস্ট ক্রিকেটে মাত্র ২৭.৩২ গড়ে দুই সেঞ্চুরিতে রান করেছেন মাত্র ২৩৫০ রান। এই রান করতে খেলেছেন ৫২ টেস্ট। কোনো রকমে হয়তো ৫০ টির বেশি টেস্ট খেলতে পেরেছেন। ওয়ানডে ক্রিকেটে অবস্থাটা আরও যাচ্ছেতাই; ইংলিশদের হয়ে মাঠে নামতে পেরেছেন মাত্র ১৮ ওয়ানডেতে। এতে ২৬.৮৫ গড়ে এক হাফ-সেঞ্চুরিতে করেছেন মাত্র ৩৭৬ রান।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দূর অবস্থা সম্পন্ন এই লোক ঘরোয়া ক্রিকেটে কিনা করেছেন রানের পর রান। ক্যারিয়ারে খেলেছেন ৪৬১ টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ। আর এতে রান করেছেন ৩৫ হাজারের উপর । সাথে আছে ১১৪টি প্রথম শ্রেণির সেঞ্চুরি। এই পরিসংখ্যানের পর আপনি তাকে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অন্যতম সেরা ক্রিকেটার হিসেবে তাকে গন্য করতেই পারেন।
রামপ্রকাশ ক্রিকেটের এক অভিজাত ক্লাবের সদস্য। সেখানে আছে শুধুমাত্র প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে শতাধিক সেঞ্চুরি করা ক্রিকেটাররা। মাত্র ২৫ জন ক্রিকেটার এখন পর্যন্ত প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে শতাধিক সেঞ্চুরি করতে পেরেছেন। এই অভিজাত ক্লাবের সর্বশেষ সদস্য ছিলেন মার্ক রামপ্রকাশ। তাঁর এই রেকর্ড স্যার ডন ব্রডম্যান, শচীন রমেশ টেন্ডুলকার, জহির আব্বাসের মত কিংবদন্তীদের পাশাপাশি উচ্চারিত হবে।
২৫ বছরের প্রথম শ্রেণির ক্যারিয়ারে ২০ মৌসুমে এক হাজার রান করার রেকর্ড আছে রামপ্রকাশের। এছাড়াও এক মৌসুমে দুই হাজার রান করেছিলেন তিন বার। এর মধ্যে দুই মৌসুমে ব্যাটিং গড় ছিল ১০০ এর উপরে। ২০০৬ সালে মাত্র ২০ ইনিংসে দুই হাজার রানের মাইলফলক স্পর্শ করেন তিনি। একই মৌসুমে টানা পাঁচ ম্যাচে ১৫০ রান বা ততোধিক রানের ইনিংস খেলেন মার্ক রামপ্রকাশ। কিন্তু রামপ্রকাশের জন্য এগুলো শুধু একটি সংখ্যা মাত্র।
মার্ক রামপ্রকাশের ব্যাটিং ছিল বেশ দুর্দান্ত। যদি এমসিসির ক্রিকেট ব্যাটিং ম্যানুয়ালকে কখনো জীবন্ত করা সম্ভব হয় তাহলে সেটা হবে মার্ক রামপ্রকাশের ব্যাটিং। তাঁর ব্যাটিং দেখলে মনে হবে এমসিসির ব্যাটিং ম্যানুয়াল সরাসরি ব্যাটিং করছে। তাঁর ব্যাটিংয়ের সবচেয়ে কার্যকরী দিক ছিল কাভার ড্রাইভ। যাতে এক শতাংশও ভুল নেই।
মার্ক রামপ্রকাশের শরীরে বইছে ক্যারিবিয়ান রক্ত। বিশেষ করে বললে গায়ানার রক্ত। এই গায়ানা থেকে উঠে এসেছে কিছু বিখ্যাত ক্রিকেটার। ক্লাইভ লয়েড, রোহান কানহাই, শিব নারায়ণ চন্দরপলদের মত ক্রিকেটার এসেছেন গায়ানা থেকে। মাত্র ছয় বছর বয়সে নিজের নতুন ব্যাটটি দিয়ে খেলার জন্য ক্রিসমাসের রাতের বাবা ঘরের বাইরে নিয়ে আসেন মার্ক রামপ্রকাশ। মাত্র ১০ বছর বয়সে যোগ দেন বেসবোরোহ ক্রিকেট ক্লাবে। সেখান থেকে মিডলসেক্স কাউন্টি ক্লাবে অনূর্ধ্ব- ১১ দলে সুযোগ পান মার্ক রামপ্রকাশ।
মাত্র ১৫ বছর বয়সে মিডলসেক্স যুব দলে সুযোগ পান। যেখানে তাঁর সঙ্গী ছিলেন মাইক আথারটন এবং নাসের হুসেইন। যদিও তাঁরা রামপ্রকাশের থেকে বয়সে বড় ছিলেন। তাও একই দলে খেলতেন তাঁরা। যুব দলের পাশাপাশি মিডলসেক্সের দ্বিতীয় একাদশের সাথে অনুশীলন করতেন। সেখান থেকেই পেশাদার ক্রিকেটার হবার সিদ্ধান্ত নেন মার্ক রামপ্রকাশ। ক্রিকেটের পাশাপাশি ওয়াটফোর্ড ফুটবল ক্লাবে ফুটবল খেলতেন রামপ্রকাশ।
১৮ বছর বয়সের আগেই ইংল্যান্ড যুব দলে সুযোগ পান মার্ক রামপ্রকাশ। যুব দলের হয়ে শ্রীলংকা যুব দলের এই সিরিজে প্রায় ৬০০ রান । এরপরই সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে রামপ্রকাশের জীবনে। এই সিরিজের পরই মাত্র ১৭ বছর বয়সে ১৯৮৭ সালের এপ্রিলে মিডলসেক্স দলের সাথে চুক্তি করেন এবং প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে।
রামপ্রকাশের দুর্দান্ত কিছু ইনিংসের কারণে জাতীয় দলে নজর টানতে শুরু করেন। তাঁর এই দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের কারণে তিনি সুযোগ পান। কিন্তু কাউন্টি ক্রিকেটের এই ফর্ম কখনও জাতীয় দলে টানতে পারেননি তিনি। রামপ্রকাশ যখন জাতীয় দলে প্রথম ডাক পান, তখন তাকে বিবেচনা করা হয়েছে তিনি হবেন প্রতিপক্ষ বোলারদের জন্য ভয়ংকর। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে তিনি খুব বদ-রাগী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এই পরিচিতি থেকে সরে আসতে শুরু করেন তিনি।
২০০১ সালে ওভালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম সেঞ্চুরি করেন। ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরির দেখা পেতে ২২ ম্যাচ খেলতে হয়েছিল মার্ক রামপ্রকাশকে। এরপর ক্যারিয়ারে দ্বিতীয় সেঞ্চুরি করেন বার্বাডোজে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে করেন ১৫৪ রান। এরপরেও জাতীয় দলের নির্বাচকরা তাঁর উপর আস্থা রেখেছিলেন। কিন্তু সেই আস্থার প্রতিদান দিতে পারেননি মার্ক রামপ্রকাশ।
২০০১ সালে ছোটোবেলার দল মিডলসেক্স ছাড়েন মার্ক রামপ্রকাশ। কারণ ২০০১ মৌসুমে মিডলসেক্স কাউন্টি ক্রিকেটে প্রথম বিভাগ থেকে নেমে যায়। তখন নিজের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেকে বাঁচিয়ে রাখতে মিডলসেক্স ছেড়ে যোগ দেন আরেক কাউন্টি ক্লাব সারেতে। কিন্তু কাউন্টি ক্রিকেটে দল ছেড়েও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজের ছাপ রেখে যেতে পারেননি।
সারেতে যোগ দেয়ার পরের বছরই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজের শেষ ম্যাচ খেলে ফেলেন। ৩২ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সমাপ্তি ঘটে। এরপর অনেক বারই দুর্দান্ত খেলার পর তাকে জাতীয় দলে ফেরানোর জন্য অনেক আলোচনা হয়েছিল। কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আর ফিরতে পারেননি তিনি।
মার্ক রামপ্রকাশ সারেতে যোগ দেয়ার পরও নিজের সেই দুর্দান্ত পারফর্ম করতে শুরু করেন। সারের ১১ বছরের ক্যারিয়ারে প্রতি বছরে প্রায় ৫০ গড়ে রান করেন। সারের হয়ে পারফর্ম করার পরও যখনও জাতীয় দলে সুযোগ পাননি তখন ভেঙ্গে পড়েননি। জাতীয় দলে মার্কোস ট্রেসকোথিক, নাসের হুসাইনদের মত ক্রিকেটার জাতীয় দলের দুর্দান্ত পারফর্মেন্স তাকে জাতীয় দলে ডাকার সুযোগ পাননি।
২০০৬ সালে মধ্য ৩০ বছর বয়সেও দুর্দান্ত ফুটওয়ার্ক এবং স্কিল তাকে অনেক রান করতে সাহায্য করে। ২০০৬ সাল ছিল রামপ্রকাশের জন্য দুর্দান্ত একটা বছর। এই সময়ে জিতেছিলেন উইজডেন বর্ষসেরা ক্রিকেটারের পুরস্কার।