কেবলই মিথ নন তিনি

‘বুড়িগঙ্গার ওইদিকে বাবু বাজারে একটা ব্রিজ হলে মানুষের যাতায়াতে অনেক সুবিধা হতো’, সরাসরি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বলে ফেলেছিলেন তিনি। ক্রিকেট খেলে যে আয় করেছেন, তা দিয়ে বানিয়েছেন স্কুল। সরকারের কাছ থেকে পাওয়া জমি চক্ষু হাসপাতাল নির্মান খাতে দান করেছেন।

১৯৯৫ সালের পাঁচ এপ্রিল। শারজাহ চলছে এশিয়া কাপের ম্যাচ। বাংলাদেশের করা ১৬৩ রানের লক্ষ্যে ঝড় তুলছেন স্বয়ং শচীন টেন্ডুলকার। মাত্র ৩০ বল খেলেই হাফ সেঞ্চুরি থেকে মাত্র দুই রান দূরে তিনি।

এমন সময় আচমকা এক আর্ম ডেলিভারি। বিভ্রান্ত হয়ে বোল্ড শচীন। শারজাহতে তখন পিনপতন নীরবতা। লিটল মাস্টারের দীর্ঘশ্বাসটাও যেন শোনা যাচ্ছে।

ড্রেসিংরুমে ফিরে শচীন বললেন, ‘আর্ম বলটা খুবই ভালো দেয় ছেলেটা, সবাই ওকে সোজা ব্যাটে খেলবে!’ ক্যারিয়ারের প্রথম ম্যাচ বলেই ছেলেটার নাম হয়তো শচীন সেদিন জানতেন না। তবে, কালক্রমে মোহাম্মদ রফিককে পুরো বিশ্বই চিনেছে।

ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট ইনিংসে কোনো রান পাননি। ওয়ানডের শেষ ইনিংসেও তাই। তবে, এর আগের সময়টা খুবই বর্ণাঢ্য। আইসিসি ট্রফির জমানা থেকে দেশকে টেস্ট ক্রিকেটের আঙিনায় পা রাখতে দেখেছেন তিনি।

অনেক লড়াই দেখেছেন, লড়াই করেছেন তাঁর চেয়েও অনেক বেশি। তিনি বাংলাদেশের বাঁ-হাতি স্পিন বোলিংয়ের পথিকৃত। তাঁর হাত ধরেই আব্দুর রাজ্জাক, সাকিব আল হাসান কিংবা এনামুল হক জুনিয়র বা তাইজুল ইসলামরা এসেছেন।

কিন্তু, মোহাম্মদ রফিক আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে রফিক আসলে কত বড় তারকা ছিলেন? ১২৫ ওয়ানডেতে ১২৫ উইকেট তাঁর। ৩৩ টেস্টে ১০০ টি উইকেট। এই অর্জনটা দিয়ে ঠিক তাকে খুব আহামরী করে দেখার সুযোগ নেই। তবে, মোহাম্মদ রফিকের প্রভাবটা ঠিক মিথ নয় বাংলাদেশ ক্রিকেটে, কিংবা আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটেও নয়।

বয়সের কোঠা ৩০-এর ঘরে যাওয়ার পর টেস্ট ক্রিকেটে ১০০ উইকেট পেয়েছেন – এই তালিকাটা খুব দীর্ঘ নয়। এখানে মোহাম্মদ রফিকের সাথে আছেন মাত্র চারজন। তারা হলেন – ক্ল্যারি গ্রিমেট (অস্ট্রেলিয়া), দিলীপ যোশি (ভারত), ব্রুস ইয়ার্ডলি (অস্ট্রেলিয়া) ও রায়ান হ্যারিস (অস্ট্রেলিয়া)।

তারপরও এদের থেকে এগিয়ে মোহাম্মদ রফিক। কারণ, এর সাথে তার এক হাজার টেস্ট রানও আছে যা আর বাকি চারজনের কারোই নেই। ফলে, তাঁকে স্রেফ একটা মিথ বলে চালিয়ে দেওয়ার কোনো উপায় নেই। ক্রিকেট পরিসংখ্যানই ‘সেলফ মেড’ এই তারকাকে সর্বোচ্চ আসনে ঠাঁই দিয়েছে। আর এক সেঞ্চুরি, কিংবা চারটি ফিফটি নয় – মোহাম্মদ রফিক যদি ম্যাচে পাঁচটা বা দশটা বলও ব্যাটিং করে থাকেন – সেটাই ছিল দর্শকদের জন্য সবচেয়ে বড় বিনোদন।

রফিক টেস্ট ক্যারিয়ারের বড় একটা সময় দ্বিতীয় ইনিংসে বোলিং করারই সুযোগ পেতেন। বারবার বলায় কথাটা খুব ক্লিশে শোনালেও এই বাস্তবতাটাকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আর ওই সময়ে তিনি এতটাই প্রভাবশালী ছিলেন যে, সমসাময়িক বিশ্বসেরা বাঁ-হাতি স্পিনার ড্যানিয়েল ভেট্টোরির সাথে তুলনা হত হরহামেশাই।

এশিয়া একাদশে খেলতেন নিয়মিত। আফ্রো-এশিয়া কাপটা তখন নিয়মিতই হত। কেবল খেলা নয়, নিয়মিত পারফরম করতেন। কি একটা রোম্যান্টিক ব্যাপার ছিল! দলে মুত্তিয়া মুরালিধরণ কিংবা হরভজন সিং থাকার পরও উইকেট নিতে কার্পণ্য করছেন না মোহাম্মদ রফিক। ওয়ানডেতে ১০০ উইকেট ও এক হাজার রানের মাইলফলকে পৌঁছানো প্রথম বাংলাদেশি তিনি।

তাঁর জীবনটাও খুব বর্ণাঢ্য বলা যায়। ইতিহাসের মহানায়কদের তুলনায় তাঁর সংগ্রামটা নেহায়েৎ কম নয়। বুড়িগঙ্গা তীরের জিঞ্জিরা বস্তি থেকে উঠে এসে তিনি তারকা বনেছেন। মাছ ধরে, গরু চড়িয়ে কেটেছে শৈশব। মাত্র ১৫ বছর বয়সে শুরু করেন পেশাদার ক্রিকেট। ছিলেন পেসার, হয়ে গেছেন স্পিনার। বাকিটা ইতিহাস!

পেলে-ম্যারাডোনাদের নিয়ে কাব্য হয়, রফিককে নিয়েও হওয়া দরকার। যদিও, রফিক নিজের অতীত জীবন নিয়ে কথা বলেন খুব কমই। নিজেও নিভৃতে থাকার জীবনই বেছে নিয়েছেন খেলোয়াড়ী জীবন শেষ করার পর। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডও (বিসিবি) তাঁকে কাজে লাগানোর চেষ্টা সামান্যই করেছে।

‘বুড়িগঙ্গার ওইদিকে বাবু বাজারে একটা ব্রিজ হলে মানুষের যাতায়াতে অনেক সুবিধা হতো’, সরাসরি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বলে ফেলেছিলেন তিনি। ক্রিকেট খেলে যে আয় করেছেন, তা দিয়ে বানিয়েছেন স্কুল। সরকারের কাছ থেকে পাওয়া জমি চক্ষু হাসপাতাল নির্মান খাতে দান করেছেন।

একটা কাকতালীয় তথ্য দিয়ে ইতি টানি। ওয়ানডেতে বোলার রফিকের ক্যারিয়ার সেরা র‌্যাংকিং ১৯। টেস্টেও তাই। এই মানের খেলোয়াড়কে তবুও ক্রিকেট মনে রাখতে বাধ্য। তিনি কখনোই মিথ ছিলেন না, না খেলোয়াড়ী জীবনে না ব্যক্তি জীবনে। তবে, আক্ষরিক অর্থেই তিনি রহস্য ছিলেন, আছেন ও থাকবেনও হয়তো!

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...