কিং ব্যাক অব বেঙ্গল

২০১৫ সালের জুন মাস; বঙ্কিমচন্দ্র স্ট্রিট, কলকাতা।

খা খা রোদের মধ্যে বই ঘুটছিলাম দে’জ পাবলিশিংয়ের বিশাল শো রুমে। এক বিক্রয়কর্মীকে বললাম, খেলাধুলার বইগুলো কোন দিকে? পাশ থেকে কাচা-পাকা চুলের এক ভদ্রলোক নিজের হাতে ধরা বইয়ের চোখ রেখে বললেন, ‘দাদা, বাংলাদেশ থেকে এসেছেন?’

আমার উচ্চারণে এমন সিদ্ধান্তে পৌছে যাওয়ায় ভুল কিছু নেই। সম্মতি দিতেই পরিচিত হওয়ার চেষ্টা করলেন। ক্রীড়া সাংবাদিক শুনেই চোখ বড় বড় করে বললেন, ‘মুন্নাকে চিনতেন?’

আমি হঠাৎ মালুম করতে পারিনি। পাল্টা প্রশ্ন করলাম, ‘কোন মুন্না!’

উনি আকাশ থেকে পড়লেন। আমার দিকে চোখ বড় বড় করে বললেন, ‘ক্রীড়া সাংবাদিক মানুষ। আপনার কাছে মুন্না আবার দু জন আছে নাকি? মুন্না তো একজনই।’

ততোক্ষনে নিজেকে সামলে নিয়েছি, ‘হ্যাঁ। মোনেম মুন্না।’

উনি এবার হেসে বললেন, ‘ঠিক। আমাদের ইস্ট বেঙ্গলের কিং মুন্না।’

হ্যা, তিনি ইস্ট বেঙ্গলের মুন্না, আবাহনীর মুন্না। আমাদের বাংলাদেশের মুন্না, কলকাতার মুন্না। লোকেদের ভালোবাসার কিং ব্যাক মুন্না। তিনি এক ও অদ্বিতীয় মোনেম মুন্না।

প্রখ্যাত ক্রীড়া সাংবাদিক উৎপল শুভ্র বললেন-মাস্তান অব ফুটবল।

বাংলাদেশের অন্যতম প্রফিলিক গোলস্কোরার শেখ মোহাম্মদ আসলাম বললেন-টাফেস্ট গাই অন দ্য পিচ; নাইস ফ্রেন্ড অফ দ্য পিচ!

এই আমাদের মোনেম মুন্না।

উৎপল শুভ্রই লিখেছেন, বাংলাদেশের ফুটবলের শেষ মেগাস্টার মোনেম মুন্না। আর এ দেশের ফুটবল ইতিহাসে মুন্নার সাথে তুলনা করার মতো একমাত্র স্টার হলেন কাজী সালাউদ্দিন। এর আগেও কিছু নেই, পরেও না। মুন্না অনেকটা এই দেশের রক্ষন তারকার শেষ কথা।

মুন্না কিংবদন্তী হয়েছেন ঢাকার ফুটবলে, কলকাতার ফুটবলে। কিছুটা জাতীয় দলেও। কিন্তু ঢাকার বাইরে বসে এই উত্তাপ টের পাওয়া কঠিন ছিলো। তারপরও নব্বইয়ের শুরুতে একেবারে সুন্দরবনের কোলের গ্রামে বসেও আমরা মুন্নার নাম শুনতাম। আমাদের বড় ভাইয়েরা বলতেন, এশিয়ার সেরা ডিফেন্ডার হলেন মুন্না।

এটা সত্যি কি না, আমি জানি না। এই বয়সে এসে মুন্না ইতিহাস হয়ে যাওয়ার পর এ নিয়ে আর জানার দরকার বলেও মনে করি না। একটা কথাই কেবল বুঝতে পারি, আমাদের দেশে ফুটবল জোয়ারের যে ইতিহাস ছিলো, তার সবচেয়ে বড় অংশীদার ছিলেন এই মোনেম মুন্না।

তারকা ফুটবলারদের জন্ম দেওয়ার জন্য বিখ্যাত নারায়নগঞ্জের ছেলে মুন্না। ১৯৮১ সালে পাইওনিয়ার ফুটবল দিয়ে ঢাকায় পথচলা শুরু করেন। পরের বছর শান্তিনগরের হয়ে দ্বিতীয় বিভাগে খেলেন। বলা হয়, এই সময়ে তিনি নারায়নগঞ্জ জেলা দলের হয়ে এক প্রদর্শনী ম্যাচে জাতীয় দলের বিপক্ষে খেলে বাজিমাত করে দিয়েছিলেন। যার ফলে ১৯৮৩ সালে তাকে দলে ভেড়ায় মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধার হয়েই প্রমোটেড হন প্রথম বিভাগে; তখনকার সর্বোচ্চ লিগ।

১৯৮৬ সালে খেলেন ব্রাদার্স ইউনিয়নের হয়ে। আর এই ব্রাদার্সের হয়ে মোটামুটি ঢাকায় আলোড়ন তৈরী করে ফেলেন। চোখ পড়ে যায় আবাহনী কর্মকর্তাদের। তারকাখচিত আবাহনী দলে নাম লেখান তিনি; তৈরী হয় এক আমৃত্যু বন্ধন। চিরবিদায়ের জানাজাটাও এই আবাহনী ক্লাবে হয়েছে।

এখারেন মুন্নাকে সতীর্থ হিসেবে পেয়েছেন শেখ মোহাম্মদ আসলাম; পরে জাতীয় দলেও একসাথে খেলেছেন তারা। তিনি কথা বলতে গিয়ে গলাটা একটু ধরে এলো। সেই সময়ের কথা বলতে গিয়ে আসলাম বলছিলেন, ‘পেছনে মুন্না থাকা মানে অ্যাটাকের খেলোয়াড়দের একটা অসীম আত্মবিশ্বাস থাকতো। আমরা জানতাম, আমরা ইচ্ছেমত খেলতে পারি। কারণ, নিচে মুন্না আছে। ও সব সামলে নেবে। বল সামনে বাড়িয়ে বলতো-বড় ভাই, গোল করেন। পেছন থেকে চিৎকার করে বলতো-বড় ভাই, আমি আছি। এই বিশ্বাস আর কোনোদিন জীবনে কেউ দেবে না। মুন্না ছিলো ফুটবল মাঠে একটা আস্থা ব্যাপার।’

আবার মুন্নাকে প্রতিপক্ষ হিসেবেও পেয়েছেন আসলাম। যখন আসলাম মোহামেডানে, মুন্না তখনও আবাহনীতে। প্রতিপক্ষ মুন্নার কথা বলতে গিয়ে সে সময়ের সেরা আক্রমণভাগের খেলোয়াড় আসলাম বলছিলেন, ‘টাফ, ভেরি টাফ। এরকম শক্ত আর কনফিডেন্ট ডিফেন্ডার আমি খুব দেখিনি। ওকে পার করে গোল করাটা কঠিন একটা কাজ ছিলো। ওর বিপক্ষে গোল করতে পারলে আমাদের সেটা ডাবল আনন্দের ব্যাপার ছিলো।’

আবাহনীতে খেলা অবস্থায়ই মুন্না ডাক পান ইস্ট বেঙ্গলে।

ইস্ট বেঙ্গল ঢাকায় এসেছিলো আবাহনীর বিপক্ষে একটা ফ্রেন্ডলি ম্যাচ খেলতে। সেখানে আসলামের গোলেই হেরে যায় তারা। কলকাতার ক্লাবটির পছন্দ হয়ে যায় তিন জন ফুটবলারকে। আসলাম, রুমি ও মুন্নাকে নিয়ে যায় তারা। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত মুন্না ইস্ট বেঙ্গলে খেলেন। সেখানে অর্জন করেন অসম্ভব জনপ্রিয়তা।

কলকাতারার লোকেদের কাছে মুন্না এক ভালোবাসার নাম হয়ে ওঠেন। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান লড়াইকে পাশ কাটিয়ে তিনি পুরো কলকাতার ফুটবলের প্রতীক হয়ে ওঠেন। আসলাম নিজে সেই সময়টা কাছ থেকে দেখেছেন, ‘ইস্টবেঙ্গল আমাদের নিয়ে গেলো একসাথে। মুন্না দারুন ক্লিক করলো। ও খুব জনপ্রিয় হয়ে গেলো ওখানে। ওর প্র্যাকটিস দেখতে ভিড় জমে যেতো।’

এর মাঝে ১৯৮৬ সালে জাতীয় দলের হয়ে অভিষেক হয় মুন্নার। খুব দ্রুতই হয়ে ওঠেন জাতীয় দলের নেতা। অধিনায়ক হিসেবে মায়নমারে অনুষ্ঠিত চারজাতি টুর্নামেন্টের শিরোপা জিতে আনেন। উৎপল শুভ্র বলছিলেন, ‘মুন্নার লিডারশিপ ছিলো উল্লেখ করার মতো ব্যাপার। ঘরোয়া ফুটবলে পিছিয়ে থাকা আবাহনীকে জেতানোর জন্য সে যে জোশ আনার চেষ্টা করতো, সেটা খুব নজরকাড়া ছিলো। কিছু কিছু ব্যাপারে আমি তাকে মাশরাফির সাথে তুলনীয় মনে করি।’

এই প্রসঙ্গেই মুন্নার মারাত্মক জনপ্রিয়তার কথা এলো। ডিফেন্সে খেলে একজন ফুটবলারের পক্ষে এতো জনপ্রিয় হয়ে ওঠাটা বিষ্ময়কর। এই ব্যাপারটা নিয়েই উৎপল শুভ্র সালাউদ্দিনের সাথে তুলনা করে তার একটা লেখায় লিখেছেন,

‘বাংলাদেশের ফুটবলে সুপারস্টার বললে মুন্না ছাড়া আর একটি নামই আসে। কাজী সালাউদ্দিন। তবে একটা বিবেচনায় সালাউদ্দিনও মুন্নার কাছে কিছুটা ম্লান হয়ে যান। সালাউদ্দিন ছিলেন স্ট্রাইকার, ফুটবলের সবচেয়ে গ্ল্যামারাস পজিশনে খেলার সুবিধাটা ছিল তাঁর পক্ষে। ফুটবল গোলের খেলা, আর গোল যিনি করেন, দর্শক-সমর্থকদের হৃদয়ে ঢুকে যাওয়ার অর্ধেক পথ তো তিনি আগেই পেরিয়ে থাকেন। ডিফেন্ডারের কাজটা সে তুলনায় অনেক কঠিন। এটা তো সূষ্টিশীলতার কাজ নয়, বরং এখানে সাফল্য লুকিয়ে সৃষ্টিশীলতাকে ব্যর্থ করে দেওয়ায়। তার পরও মুন্নার এমন দর্শকপ্রিয় হতে পারাটাই বুঝিয়ে দিচ্ছে, তাঁর মধ্যে খেলার বাইরেও ‘কিছু একটা’ ছিল।’

জাতীয় দলে খেলেছেন ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত। আর পরের বছর শেষ খেলেছেন ক্লাব ফুটবলে; অবশ্যই আবাহনীর জার্সি গায়ে। খেলা ছাড়ার পরও ফুটবল বা আবাহনীকে ছেড়ে যাননি। আবাহনীর ম্যানেজার ছিলেন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে যাওয়ার আগ পর্যন্ত।

১৯৯৯ সালে প্রথম অসুস্থতা ধরা পড়ে। ২০০০ সালে তার কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়। তারপরও কখনো পুরো সুস্থ হয়ে উঠতে পারেননি। ২০০৫ সালে প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে হাসপাতালেই ছিলেন। তারপর ঠিক এই ১২ ফেব্রুয়ারি ভোর বেলায় এই ফুটবলের, খেলাধুলার নশ্বর দুনিয়া ছেড়ে চলে যান তিনি।

বাংলাদেশের ফুটবল হারিয়ে ফেলে তার এক নয়ন জোড়ানো প্রেমকে। বাংলাদেশের ফুটবলাররা হারিয়ে ফেলেন তাদের অকৃত্রিম বন্ধুকে। আজও তার কথা বলতে গিয়ে আবেগাক্রান্ত হন আসলামরা। তিনি ধরা গলায়ই বলছিলেন, ‘একসাথে খেলেছি বলে বলছি না, ও আমার ছোট ভাইয়ের মতো ছিলো। আমার পরিবারের বন্ধু ছিলো। আসলে মুন্নার সাথে মিশেছে, কিন্তু ওর সাথে বন্ধুত্ব হয়নি; এমন কাউকে আপনি খুজে পাবেন না। মাঠের বাইরে ও এতো মিশুক ছেলে ছিলো, সেটা বলে বোঝানো যাবে না। একটা আড্ডা জমিয়ে ফেলতো। আমার বাসায় আসতো, আমরা দল বেঁধে নারায়নগঞ্জে যেতাম। ওর কাছে থাকাটাই একটা প্রানের উৎসবের মতো ছিলো। উই মিস হিম আ লট।’

হ্যাঁ, মুন্না ভাই। আমরা সবাই আপনাকে মিস করি। বাংলাদেশ আপনাকে মিস করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link