চোয়ালবদ্ধ জেদে স্বপ্ন পূরণ

ক্রিকেট, ফুটবল কিংবা যেকোনো বিষয়ে আদিকাল থেকেই ইংলিশদের দম্ভ অনেক বেশি। ভদ্রলোকের খেলা ক্রিকেট। অনেকের কাছে ক্রিকেট আবার বড়লোকের খেলা। অবশ্য কথাটা অনেকাংশেই সত্যি। ক্রিকেটের সরঞ্জাম কিনতে যে খরচের প্রয়োজন – সেটা আর্থিকভাবে স্বচ্ছল ছাড়া ক’জনই বা খরচ করতে পারবে। তবে যুগে যুগে বহু ক্রিকেটার নিম্নবিত্ত কিংবা নিন্মমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে এসেছেন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। শূন্য থেকে বনে গেছেন ক্রিকেটের তারকা।

এমনই এক নিম্নবিত্ত ক্রিকেট পাগল মানবের স্বপ্ন ছিল ছেলেকে ক্রিকেটার বানাবেন। জন্ম ইংল্যান্ডে হলেও পাকিস্তানি বংশদ্ভূত ছিলেন। আর্থিক দুরবস্থায় অনেকটা কষ্ট করে ছেলেদেরকে বড় করছিলেন। স্বপ্ন দেখছিলেন এদের একজন বড় ক্রিকেটার হবেন। কিন্তু তাঁর আশেপাশের ব্রিটিশদের একাংশ বলতে লাগলেন, ‘ক্রিকেট তোমাদের জন্য না। এশিয়ার গরীবরা কখনোই পেশাদার খেলা খেলতে পারবে না।’

এই কথাগুলো সেসময় হজম করে নিয়েছিলেন মুনির আলী। তবে, মনে মনে জেদ চেপেছিলেন ছেলেদের একজনকে পেশাদার ক্রিকেটার বানাবেন। আর সেই স্বপ্নকে একটা সময়ে বাস্তবে রূপও দিয়েছেন তিনি। এখন সেই মুনির আলী ইংল্যান্ডের অন্যতম সেরা এক অলরাউন্ডারের বাবা হিসেবেই পরিচিত।

‘তুমি শুধু তোমার জীবনের দু’টো বছর আমাকে দাও। এই দু’বছর ক্রিকেটে পড়ে থাকো। এরপর তোমার যা খুশি তুমি করো।’ – ১১ বছর বয়সী মঈন আলীকে এভাবেই বলেছিলেন বাবা মুনির আলী। ছেলের ক্রিকেটীয় প্রতিভা আর কেউ না দেখলেও মুনির ঠিকই দেখতে পেয়েছিলেন। তাই ছেলের কাছে জীবন থেকে দু’বছর চেয়ে বসলেন। বাবার এই ইচ্ছা অপূর্ণ রাখতে চাননি মঈনও। ছোটবেলা থেকেই বাবার কষ্ট দেখে এসেছেন। তাই বাবার ইচ্ছে পূরণ করতে মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক সম্মতি দিয়ে দিলেন মঈন।

মঈনের বাবা মুনির আলী জন্মগ্রহণ করেন বার্মিংহামে। মুনিরের বাবা ছিলেন কাশ্মীরের আর মা ইংল্যান্ডের। অল্প বয়সেই পড়াশোনার জন্য মুনিরকে পাঠানো হল কাশ্মীরে। এরপর সেখান থেকে ১১ বছরের আগে আর দেশে ফিরতে পারলেন না মুনির। বাবা-মায়ের বিবাহবিচ্ছেদ হওয়ায় দু’জনের কাউকেই তিনি কাছে পেলেন না। এক চাচার কাছে থেকেই বড় হন তিনি। কোনো রকমে খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকা আর কি।

অনেক কষ্ট করে ফিরে গিয়েছিলেন জন্মভূমিতে। মাথা গোজার ঠাঁই মেলাতেই হিমসিম খাচ্ছিলেন। মনে মনে তখনই  প্রতিজ্ঞা করে ফেলেছিলেন নিজের ছেলেদের কখনোই কষ্ট করতে দিবেন না। নিজের সামর্থ্যের সেরাটাই তাদের দেওয়ার পণ করে ফেলেছিলেন মুনির।

মুনির বিভিন্ন ছোট ছোট লিগ গুলোতে ক্রিকেট খেলতেন। তাঁর ভাইও ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলেছেন। মুনিরের ঘর আলোকিত করে আসে চার সন্তান। এই চারজনের তিনজনই  ক্রিকেটার হিসেবে পরবর্তীতে পরিচিতি পান। এই তিন  ভাইয়ের একজন কাদির আলী, একজন ওমর আলী ও আরেকজন ইংলিশ তারকা অলরাউন্ডার মঈন আলী।

বাবার কথাতে ক্রিকেটেই মনোযোগী হন মঈন। পাড়ার ক্রিকেটে ভাইদের সাথে খেলতেন। বড় বড় ছক্কা হাঁকানোর প্রয়াস ছিল শুরু থেকে। রাস্তায় খেলে প্রায়ই বল হারিয়ে ফেলতেন । সেখান থেকে উঠে আসেন কাউন্টি ক্রিকেটে। ওয়ারউইকশায়ারের হয়ে বয়সভিত্তিক দলে তিনি সুযোগ পান। স্কুল ক্রিকেটে পাওয়ার হিটিংয়ের জন্য বেশ পরিচিতি পেয়েছিলেন তিনি। অনূর্ধ্ব-১৩ দলে ব্যাট হাতে নামলেই যেন ছক্কাবৃষ্টি দেখত সতীর্থরা। তখন থেকেই আগ্রাসী ব্যাটিং করতেন তিনি।

বয়সভিত্তিক দল থেকেই মঈনের স্বপ্ন ছিল ক্রিকেটের সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলবেন তিনি। বাবার স্বপ্নই তখন মঈনের স্বপ্ন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মাঠে নামবেন, হাজার হাজার দর্শকের সামনে ব্যাট করবেন; বড় ইনিংস খেলবেন, ছক্কা হাঁকাবেন। স্টেডিয়ামের সামনে গিয়ে  ভাই-বন্ধুদের বলতেন, ‘একদিন এখানেই আমি খেলবো।’ মঈনের সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে ঠিকই। এগারো-বারো বছরের সেই ছোট্ট ছেলেটি এখন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ২২ গজ মাতিয়ে বেড়াচ্ছেন।

১৫ বছর বয়সে ওয়ারউইকশায়ারের হয়ে চুক্তিবদ্ধ হলেন তিনি। দ্বিতীয় একাদশের হয়ে পঞ্চাশোর্ধ এক ইনিংস খেলে নজরকাঁড়তে খুব বেশি সময়ও নিলেন না। সেখান থেকে সুযোগ পেয়ে গেলেন ইংল্যান্ড অনূর্ধ্ব ১৯ দলে।

২০০৫ সালে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক হয় মঈন আলীর। সেবার অনূর্ধ্ব ১৯ দল ও ঘরোয়া ক্রিকেটে বেশ কিছুর ঝড়ো ইনিংস খেলে নির্বাচকদের নজরে আসেন তিনি। সুযোগ পান ২০০৬ যুব বিশ্বকাপেও। অধিনায়কের টুপিটাও তাঁর মাথায় তুলে দিলেন কোচ অ্যান্ডি পিক। ওই টুর্নামেন্টে ফিফটি করেন তিনি।

এরপর ওয়ারউইকশায়ার থেকে যোগ দেন উস্টারশায়ারে। এই দলের হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্যারিয়ারের ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ ২১৯ রানের ইনিংস খেলেন মঈন। ২০১০ সালে উস্টারশায়ারের হয়ে খেলার সুযোগ পান বাংলাদেশি তারকা সাকিব আল হাসান। সেখানেই সাকিবের সাথে সখ্যতা গড়ে উঠে মঈনের। এরপর ওই মৌসুমে বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলতে আসেন মঈন। প্রিমিয়ার ডিভিশন লিগে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে খেলেন তিনি।

ব্যাটে বলে সমানতালে পারফর্ম করে যাচ্ছিলেন। ওই মৌসুমে কাউন্টিতে দলের হয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ছিলেন তিনি। এরপর ২০১১ সালে ইংল্যান্ডের গেম ডেভেলপমেন্ট স্কোয়াডে জায়গা পান মঈন। মাঝে কাউন্টি খেলতে যান সাবেক পাকিস্তানি স্পিনার সাঈদ আজমল। সেখানে আজমলের কাছ থেকে দুসরা ডেলিভারি আয়ত্ত করেন মঈন।

পরের বছর উস্টারশায়ারের হয়ে টানা পাঁচ পঞ্চাশোর্ধ ইনিংস খেলে ডাক পান ইংল্যান্ড লায়ন্সে। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচে খেলেন ৬১ রানের অসাধারণ এক ইনিংস। সেবার প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ওই মৌসুমের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ছিলেন মঈন। ব্যাস, নিজের স্বপ্নের আরও এক ধাপ এগিয়ে যান মঈন।

২০১৪ আইসিসি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের হয়ে ডাক পান তিনি। অবশ্য এর আগের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজে ওয়ানডেতে অভিষেক হয় মঈনের।

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জার্নিটা মোটেও ভাল হয়নি মঈনের ৪ ম্যাচে ব্যাট হাতে মাত্র ৪৯ রান আর বল হাতে ছিলেন উইকেটশূন্য। ওই বছরই সাদা পোশাকে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে অভিষেক। আর অভিষেক সিরিজেই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে তুলে নেন মেইডেন টেস্ট সেঞ্চুরি। লঙ্কানদের বিপক্ষে ওই সিরিজে মেইডেন ওয়ানডে সেঞ্চুরি তুলে নেন মঈন।

সেই যে শুরু আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি এই ইংলিশ তারকাকে। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল) সহ পাকিস্তান সুপার লিগ (পিএসএল), ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল) সহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে খেলে বেড়িয়েছেন তিনি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মিডল অর্ডারে বনে যান ইংলিশদের অন্যতম ভরসা। ব্যাটে-বলে দলকে বহু ম্যাচে জয়ের ভীত গড়ে দিয়েছেন তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link