জ্যাক লিচের কী মনটা খারাপ?
এই খানিক আগেই পাঁচ উইকেট নিয়েছেন শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। জমে ওঠা গল টেস্টে তিনি অন্যতম নায়ক। তারপরও তার মনটা খারাপ হতে পারে?
পারে। কারণ, সকালেই লিচ খবর পেয়েছেন, মঈন আলী করোনা ভাইরাস থেকে সেরে উঠে দলের সাথে যোগ দিয়েছেন। মঈন যদি পরের টেস্টের আগেই সুস্থ হয়ে ওঠেন, তাহলে হয়তো লিচর সেই টেস্টটা আর খেলা হবে না। ৫ উইকেট নিয়েও পরের টেস্টে বেঞ্চে বসে থাকতে হতে পারে। এটাই জ্যাক লিচের জীবন।
অবশ্য এই সামান্য ক্রিকেট দলে সুযোগ পাওয়া বা না পাওয়া দিয়ে আপনি জ্যাক লিচের জীবন সংগ্রামটা বুঝে উঠতে পারবেন না। লিচের লড়াইটা এই ক্রিকেটের সত্তর গজের মাঠ থেকে অনেক বড়। আর সেই সংগ্রামের শুরু সেই আদিকাল থেকে।
লিচের জীবনে কী গল্প নেই? দফায় দফায় প্রাণঘাতি রোগের সাথে লড়াই করা, হাসপাতালে মাসের পর মাস শুয়ে থাকা, সুপারস্টোরে চাকরি করা এবং বারবার ক্রিকেট থেকে ছিটকে পড়া। লিচ যেনো শরৎচন্দ্রের লিখে যাওয়া কোনো ট্রাজেডি উপন্যাসের চরিত্র।
লিচের জন্ম এক ক্রীড়ামোদী পরিবারে। বাবা ছিলেন সমারসেটের মারাত্মক ভক্ত।
কয়েক দিন বয়সী লিচকে প্রথম সমারসেটের মাঠে নিয়ে গিয়েছিলেন বাবা। একটু বড় হলে বাবা বললেন, ‘তুমি ক্রিকেটার হতে চাও?’
লিকলিকে লিচ খুব আনন্দ পেয়ে বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ, ফাস্ট বোলার হতে চাই।’
বাবা সেটাই মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু ফাস্ট বোলার তো দূরে থাক, লিচের স্বাস্থ্য তো ক্রিকেটার হওয়াকেই সমর্থন করে না। ছোটবেলা থেকেই নিত্যদিন জ্বর, পেটের পীড়ায় ভুগতেন। ডাক্তাররাও বুঝতে পারছিলেন না, লিচের সমস্যা কোথায়। অবশেষে ১৪ বছর বয়সে ধরা পড়লো তিনি ক্রোনস ডিজিস (Crohn’s diseas) নামে একটা বিরল রোগে আক্রান্ত।
এই রোগে মানুষ হয়তো রাতারাতি মরে যায় না; কিন্তু হাসপাতাল তার স্থায়ী ঠিকানা হয়ে ওঠার কথা। লিচের ক্রিকেটার হয়ে ওঠার লড়াইটা এখানেই শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিলো। হয়নি। লিচ এখান থেকে ঘুরে দাড়িয়েছেন।
শরীরের অবস্থা বুঝে নিজেকে স্পিনার করে ফেলেছেন। সমারসেটের কিশোর ক্রিকেটার কার্যক্রমে ছিলেন। জস বাটলারের সাথে অনুর্ধ্ব-১৩ থেকে অনুর্ধ্ব-১৭ পর্যন্ত সমারসেটে একসাথে খেলেছেন। কিন্তু লিচ ঠিক বাটলারের মতো করে নজর কাড়তে পারেননি। ফলে সমারসেট মূল দলে জায়গা হয়নি তাঁর।
পরিবারের অবস্থা খুব ভালো ছিলো না।
সমারসেট দ্বিতীয় দলের হয়ে মাইনর কাউন্টি খেলে যা আয় হতো, তাতে চলা কঠিন হচ্ছিলো। যুক্তরাষ্ট্রের নামকরা চেইন সুপারস্টোর ‘সেইনসবারি’র টনটন শাখায় ট্রলি গোছানোর কাজ করে কিছু হাত খরচ জোগাড় করতেন। এভাবেই জীবনটা হয়তো কেটে যেতো। কিন্তু ২০১০ সালে সমারসেটকে মাইন কাউন্টি জেতানোর পথে বিরাট ভূমিকা রাখলেন। টানা বেশ কিছু সাফল্যে ২০১১ সালের দিকে এসে সমারসেটের মূল দলে প্রথম সুযোগ পেলেন।
তাও সেই একই গল্প।
সমারসেটে তখন রাজ করছেন আরেক বিখ্যাত বাহাতি জর্জ ডকরেল। এখন ডকরেলকে বসিয়ে লিচকে খেলানো বা দু জন বাহাতি স্পিনার খেলানো তো সমারসেটের কৌশলের মধ্যে পড়ে না। তাই লিচকে অপেক্ষা করতে হয়, কবে ডকলের অনুপস্থিত থাকেন; তখন তিনি একটা ম্যাচ পাবেন!
আজকাল যেমন মঈনের অনুপস্থিতির জন্য অপেক্ষা করেন ইংল্যান্ড দলে।
২০১৩ সাল থেকে লিচ একটু একটু করে পায়ের নিচে মাটিটা শক্ত করতে থাকেন। এর মধ্যে ব্রিজবেনে গিয়ে উইন্টার ক্রিকেট খেলে নিজেকে বেশ প্রমাণ করে এসেছেন। তার চেয়ে ‘সুখবর’ হলো ডকরেল ইনজুরিতে পড়ে লম্বা সময়ের জন্য মাঠের বাইরে চলে গেলেন।
সমারসেটেই নিজেকে প্রমাণ করে ২০১৮ সালে দিব্যি টেস্ট দলেও ডাক পেয়ে গেলেন। কিন্তু সেখানে একজন নয়, দু’জন ডকরেল হাজির-মঈন আলী ও আদিল রশিদ। এই দু’জনকে টপকে স্পিনার হিসেবে একাদশে জায়গা করে নেওয়াটা তো স্বপ্নের মতো একটা ব্যাপার। ইংল্যান্ড তো আর বাংলাদেশ বা ভারত নয় যে, তিন স্পিনার একাদশে খেলাবে!
অনেক অপেক্ষার পর ২০১৮ সালে মার্চে জাতীয় দলে প্রথম ডাক পেলেন। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচ খেলার পর অপেক্ষা করতে হলো আবার নভেম্বর পর্যন্ত। সে বছর এই শ্রীলঙ্কা সফরেই থাকতে পারলেন না মঈন। সুযোগটা দু হাত ভরে নিলেন। টেস্ট সিরিজে তুলে নিলেন ১৮ উইটে; একবার ৫ উইকেট, একবার ৪ উইকেট।
তারপরও লিচ নিয়মিত হতে পারেন না।
লিচকে সবাই প্রথম নজরে আনলো সেদিন চশমা কাণ্ডের পর। হ্যা, এর মধ্যে অনেক আগেই লিচের চোখে চশমা উঠে গেছে। আর এই চশমা মুছতে গিয়েই সারা বিশ্বের নজরে পড়লেন।
হ্যাঁ, বিখ্যাত হেডিংলি টেস্টের কথা বলছিলাম।
অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে এক উইকেটের মহাকাব্যিক জয় এনে দিয়েছিলেন বেন স্টোকস। স্টোকস ১৩৫ রানের ইনিংস খেলেছিলেন। ৭৬ রানের জুটি হয়েছিলো শেষ উইকেটে। আর সেই জুটিতে ১ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেছিলেন লিচ।
আগেই ব্যাটিং টুকটাক করেছেন। আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ৯২ রানের ইনিংসও খেলেছেন। কিন্তু হেডিংলির এক রান সবাইকে ছাড়িয়ে গেলো। ওই ১ রান করার পথে দরদর করে ঘামছিলেন। চুল থেকে হেলমেটের কার্নিশ বেয়ে চোখে চলে আসছিলো ঘাম, নিজের উত্তপ্ত নিশ্বাসে ঘোলা হয়ে যাচ্ছিলো কাচ। বারবার চশমা খুলে কাচ আর চোখ মুছে নিচ্ছিলেন।
লিচের এই ইনোসেন্ট, ঘাবড়ানো চেহারা দেখে প্রেমে পড়ে গেলো ইংলিশরা। দেশটির বড় একটা চশমা নির্মাতা প্রতিষ্ঠান, স্পেকসেভারস ঘোষনা দিলো তারা বাকীটা জীবন ধরে লিচকে বিনামূল্যে তার প্রয়োজনীয় সব ধরণের চশমা সরবরাহ করবে।
এতোক্ষন অনেক রোমান্টিক গল্প শুনেছেন। এবার লিচের রোগব্যধির গল্প শুনুন। একটা তো ছোটবেলায় সেই ক্রোনস ডিজিস ছিলোই। সেই জের এখনও টেনে বেড়াচ্ছেন। আরেকটা হলো গত বছরের ঘটনা।
শুরুটা হলো করোনার সন্দেহ দিয়ে। করোনার মতোই সর্দি, কাশির মতো উপসর্গ নিয়ে আইসোলেশনে গিয়েছিলেন। ক্রোনস ডিজিসের ফলে তার ইমিউন সিস্টেমে আগে থেকেই দুর্বলতা ছিলো। ফলে দ্রুত তাকে হাসপাতাল নেওয়া হলো। না, করোনা নয়।
পাওয়া গেলো প্রথমে পরিপাকতন্ত্রের একটা রোগ। সেটার চিকিৎসা চলা অবস্থায় সেপসিস হয়ে গেলো। প্রাণ যায় যায় অবস্থা। ওখান থেকে লিচ ফিরে আসবেন, সেটা অনেকেই কল্পনা করেননি। লিচ ফিরে এসেছেন। লড়াই করে বেরিয়ে এসেছেন।
স্কাই স্পোর্টসকে ক’দিন আগে বলছিলেন, ‘এটা ঠিক যে, আমাকে হাসপাতালে অনেক সময় কাটাতে হয়েছে। আমার জীবনে উত্থান-পতনটা অনেক বেশি। কিন্তু ক্রিকেটও তো তাই। জীবন আর ক্রিকেট আমার কাছে তাই একইরকম।’
এ জন্যই লিচদের লড়াইটা পরিসংখ্যান বইয়ে নয়, মানুষের হৃদয়ে লেখা থাকে।