Social Media

Light
Dark

দ্য গ্রেটেস্ট মোহাম্মদ আলী

তিনি নিছকই এক ক্রিড়াবিদ নন। মোহাম্মদ আলী একটা পরিবর্তনের নাম। তিনি একটা বিপ্লব। ইতিহাসের রঙিন খামে মোড়ানো অবিস্মরণীয় এক অধ্যায় তিনি।

জনতা এবং বার্তা সংস্থা বিবিসির বিচারে গত শতাব্দীর সেরা অ্যাথলেট হিসেবে বিবেচিত বক্সার মোহাম্মদ আলী। জুন ৩, ২০১৬ তে সবাইকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান বক্সিং রিংয়ের ভয়ংকর মৌমাছি । ১৯৭৮ সালে ক্যারিয়ারের পড়ন্তবেলায় বাংলাদেশে আসেন তিনি। আমেরিকা থেকে সুদূর বঙ্গদেশেও কৃষ্ণাঙ্গ মহাতারার জনপ্রিয়তা কোন অংশে কম নয়।

১৯৪২ সালের ১৭ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের কেন্টাকি রাজ্যের লুইসভিলে জন্মগ্রহণ করেন ‘ক্যাসিয়াস মার্কেলাস ক্লে জুনিয়র’। দাসপ্রথা বিরোধী রিপাবলিক রাজনৈতিক নেতা ক্যাসিয়াস ক্লে’র নামানুসারে এই নাম রাখা হয়।

মোহাম্মদ আলীর বক্সার হবার গল্পটা বেশ চমকপ্রদ। ১৯৫৪ সালে একবার তাঁর সাইকেল চুরি যায়। পুলিশের হাতে চোর ধরা পড়ার পর ইন্সপেক্টর মার্টিনকে অদ্ভুত এক অনুরোধ করে ১২ বছর বয়সী আলী। সে জানায়, চোরকে পেটানোর ইচ্ছার কথা। তখন মার্টিন বলেন, এর জন্য তোমাকে লড়াই করা জানতে হবে। পুলিশের পাশাপাশি মার্টিনের আরো একটি পরিচয় ছিল। বক্সিং কোচ! তার অধীনেই বক্সিংয়ে হাতেখড়ি আলীর।

১৯৬৪ সালে তিনি ইসলামী সংগঠন ‘নেশন্স অব ইসলাম’-এ যোগ দেন। নাম বদলে রাখেন মোহাম্মদ আলী। ১৯৭৫ সালে পূর্ণাঙ্গভাবে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। ১৯৭২ এবং ১৯৮৮ সালে দু’বার হজ্জ পালন করেন হাজী আলী। ইসলাম ধর্ম কেন গ্রহণ করেছিলেন? আলীর ব্যাখ্যাটা খুবই মোক্ষম।

তিনি বলেন, ‘আমি ইসলাম গ্রহন করেছি, কারণ অন্য কোনো ধর্মে আমি দেখিনি মানুষের মধ্যে এ্যাতো প্রেম ভালবাসা। একে অন্যকে কোলাকুলি করা, সালাম বিনিময়, এক সঙ্গে প্রার্থনা করা। ভাই বোন বাবা মা, পারিবারিক শিক্ষা মূল্যবোধ ইসলামেই সবেচেয়ে শক্ত। তাই ইসলাম ধর্ম নিয়েছি।’

আলী তাঁর বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে মোট ৬১ ম্যাচে খেলেন। জয় ৫৬, পরাজয় ৫। ৫৬ জয়ের ৩৭ টিই নকআউট! ২৯ অক্টোবর ১৯৬০ সালে পেশাদার বক্সিংয়ে প্রথম জয় পান আলী। তারপর ১৯৬৩ পর্যন্ত খেলা ১৯ ম্যাচের সবকটিতে জয়লাভ করেন, যার ১৫ টিতেই নকডআউড হয় প্রতিপক্ষ।

১৯৬০ সালের গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে স্বর্ণ জেতা আলী খেলার সময় কখনোই বাকীদের মতোন মুখের সামনে হাত রাখত না। তার একেকটি পাঞ্চে মনে হত মৌমাছি হুল ফুটাচ্ছে। ‘উড়বে যখন প্রজাপতি, হুল ফোটাবে বোলতা’ -আলী সম্পর্কে জনপ্রিয় বাক্য।

১৯৬৫ সালে  প্রথম চ্যাম্পিয়নওশপ জেতার সময় আলীর বয়স ছিল মাত্র ২২ বছর। যা তাকে এনে দিয়েছিল তৎকালীন সর্বকনিষ্ঠ চ্যাম্পিয়নের খেতাব।

আমেরিকান আর্মির পক্ষ থেকে দেয়া ভিয়েতনাম যুদ্ধে যাবার নির্দেশ প্রত্যাখান করায় ১৯৬৭ সালে বক্সিং থেকে ৩ বছর নিষিদ্ধ হন এবং ৫ বছরের জন্য জেল হয় আলীর। অবশ্য ১৯৭০ সালে চার বছর পরই মুক্তি পান এবং খেলায় ফিরেন।

১৯৭১ সালের ৮ মার্চ নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ারে অনুষ্ঠিত হয় জো ফ্রেজিয়ার বনাম মোহাম্মদ আলীর ম্যাচ। শতাব্দীর সেরা ম্যাচ হিসেবে স্বীকৃত সেই ম্যাচে ফ্রেজিয়ারের কাছে পরাজিত হন আলী। ফ্রেজিয়ারের বিপক্ষে সেটি ছিল তাঁর প্রথম ম্যাচ।

১৯৮১ সালে অবসর নেওয়া মোহাম্মদ আলী তিনটে হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়নশিপ, একটি অলিম্পিক স্বর্ণপদকসহ মোট ৩১ টি মেজর ট্রফি জিতেন।

১৯৭৮ সালে বাংলাদেশে আসেন সর্বকালের সেরা এই অ্যাথলেট। তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার তাঁকে সম্মানসূচক নাগরিকত্ব প্রদান করেন। বাংলাদেশে বসে তিনি বলেন, ‘যদি স্বর্গ দেখতে চাও, তাহলে বাংলাদেশে এসো। বাংলাদেশ আমার দ্বিতীয় বাড়ি।’

সাত কন্যা ও দুই পুত্র সন্তানের জনক মোহাম্মদ আলী বিয়ে করেছেন চারটি। মজার ব্যাপার হল, মোহাম্মদ আলী একজন অভিনেতাও বটে। জীবনের বিভিন্ন সময়ে অভিনয় করেছেন বেশকিছু ফিল্ম, ডকুমেন্টারিতে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘বাক হোয়াইট (১৯৬৯), ব্ল্যাক রোডিও (১৯৭২), দি গ্রেটেস্ট (১৯৭৫, আলীর আত্মজীবনী), ফ্রিডম রোড (১৯৭৮)।

বর্ণবাদের বিরুদ্ধে জীবনভর সোচ্চার থেকেছেন আলী। তাঁর আত্মজীবনী থেকে জানা যায় যে, একটি রেস্টুরেন্টে কৃষ্ণাঙ্গদের খাবার পরিবেশনে সেখানকার ওয়েটাররা অসম্মতি জানালে রাগে ক্ষোভে নিজের একমাত্র অলিম্পিক পদকটি ওহিয়ো নদীতে ফেলে দেন তিনি!

খেলা ছাড়ার আগ থেকেই নানান চ্যারিটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আলী। যা অব্যাহত রেখেছেন আমৃত্যু। ২০০৫ সালের ১৯শে নভেম্বর চতুর্থ বিয়ের ১৯ তম বার্ষিকীতে জন্মস্থান লুইস ভিলে আলী উদ্বোধন করেন চ্যারিটি ট্রাস্ট ‘মোহাম্মদ আলী সেন্টার’ এর।

১৯৯৯ সালে সর্বকালের সেরা অ্যাথলেট নির্বাচিত হওয়া আলী ১৯৮৪ সাল থেকে দীর্ঘদিন ভুগেছেন পারকিনসন রোগে। এটি একধরণের মানসিক রোগ। পরবর্তীতে ১৯৯৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনায় নিজের নামে ‘মোহাম্মদ আলী পারকিনসন সেন্টার’ হাসপাতাল তৈরি করেন আলী।

২০১৪ সাল থেকে আলীর শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। নিয়মিতই যাতায়াত শুরু হয় হাসপাতালে। ২০১৬ সালের ২রা জুনও অসুস্থবোধ করলে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। পরদিন ৩ জুন ‘সেফটিক শকের’ ফলে ৭৪ বয়সে মৃত্যুবরণ করেন এই কিংবদন্তি। আলোচিত ও রঙিন এক অধ্যায়ের ইতি ঘটে ক্রীড়া বিশ্বে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link