কাতার বিশ্বকাপের পর ফুটবলটা না ছাড়লেও এবারের বিশ্বকাপই হতে যাচ্ছে লিওনেল মেসির ক্যারিয়ারের শেষ বিশ্বকাপ। স্বয়ং মেসি নিজেই স্বীকার করে নিয়েছেন সেটা, কাতার বিশ্বকাপের দিনগুলো ফুরোনোর সাথে সাথেই ফুরোচ্ছে বিশ্ব আসরে ক্ষুদে জাদুকরের জাদু দেখানোর দিনগুলো।
এবারের বিশ্বকাপ নিয়ে মেসির উচ্ছ্বাস অবশ্যই অনুমেয়। স্মরণকালের সবচেয়ে শক্তিশালী দল নিয়ে এসেছে তাঁরা, টানা তিন বছর কোনো ম্যাচ হারেনি লিওনেল স্কালোনির দল। গত বছরই ব্রাজিলকে হারিয়ে কোপা আমেরিকার শিরোপা জিতে ২৮ বছরের শিরোপা খরা কাটিয়েছে তাঁরা। কোপা আমেরিকার সেই আসর মেসির জন্যও ছিল স্বস্তির, জাতীয় দলের হয়ে ট্রফি না জেতার অপবাদ যে ঘুচে গিয়েছিল সেবারই।
সেবারের ফাইনাল জয়ের পর মারাকানার সবুজ ঘাসে মেসির আনন্দ অশ্রু তাই বাঁধ মানেনি। সেদিনের ফাইনালে কোনো গোল করেননি মেসি, তবে টুর্নামেন্টে দলের ১২ গোলের মাঝে নয়টিতেই ছিল তাঁর অবদান। গোল্ডেন বুটের পাশাপাশি টুর্নামেন্ট সেরার পুরষ্কার সেবার গিয়েছিল মেসির ঘরেই।
পিএসজির হয়ে প্রথম মৌসুমটা ভাল না কাটলেও এবারের মৌসুমে ফিরে এসেছেন পুরনো রূপে। বিশ্বকাপ এক্ষেত্রে বড় একটা ভূমিকা রেখেছে, মাসের পর মাস তিনি নিজেকে তৈরি করেছেন বৈশ্বিক আসরের জন্য। মেসি নিজেও বুঝতে পারছেন বিশ্বকাপ জেতার চাপ, ফেবারিট হয়ে বিশ্বকাপ শুরু করার চাপ। বিশ্বকাপ শুরুর আগে শেষ সংবাদ সম্মেলনে মেসি স্বীকার করে নিয়েছেন সেটা। বলেন, “কিছুটা দুশ্চিন্তা এবং চাপ রয়েছে। শেষ বিশ্বকাপে কেমন করব আমরা? হ্যাঁ, একদিকে বিশ্বকাপ শুরুর জন্য তর সইছে না। অন্যদিকে চাইছি যেন আরও দেরি হয়, কারণ আমরা ভালভাবে বিশ্বকাপটা শেষ করতে চাই।”
নিজের শেষ বিশ্বকাপটা নিশ্চিতভাবেই জিতেই রাঙিয়ে তুলতে চাইবেন ক্ষুদে জাদুকর। ২০১০ বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার অধীনে আর্জেন্টিনা ছিল মানসিকভাবে ভঙ্গুর এক দল, জার্মানির বিপক্ষে ৪-০ গোলে বিধবস্ত হয়ে শেষ আট থেকে বিদায় আলবিসেলেস্তেদের।
চার বছর পরও প্রতিপক্ষ দলটার নাম একই, কেবল মঞ্চটা ভিন্ন। মারাকানার ফাইনালে সেদিন অতিরিক্ত সময়ে মারিও গোটজের গোলে স্বপ্নভঙ্গ হয় মেসিদের। ২০১৮ বিশ্বকাপে তো ফ্রান্সের কাছে হেরে শেষ ষোল থেকেই বিদায় তাঁদের। সাবেক আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ড হারনান ক্রেসপো তো বলেই বসেন, ‘মেসি কখনোই ম্যারাডোনা হতে পারবেন না।’
যদিও ম্যারাডোনারই সতীর্থ হোর্হে ভালদানো সে সময় মেসির পক্ষে কথা বলেছিলেন। ১৯৮৬ বিশ্বকাপ জয়ী এই তারকা বলেন, ‘ম্যারাডোনাকে ছাপিয়ে যেতে মেসির বিশ্বকাপ জেতার প্রয়োজন হবে না। ম্যারাডোনা নিজের ভাল দিনে যেটা করতে পারতেন, মেসি সেটা প্রতিদিনই করেন।’
তাছাড়া ১৯৮৬ বিশ্বকাপ ম্যারাডোনা একা হাতে জিতিয়েছেন এমন গল্পের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি, কারণ সেবারের বিশ্বকাপে ম্যারাডোনা ছাড়াও বেশ কয়েকজন তারকা ফুটবলার ছিল আর্জেন্টিনার।
তবে এরপরই ধীরে ধীরে দল গুছিয়ে নিয়েছেন লিওনেল স্কালোনি। হয়তো তারকাসমৃদ্ধ কোনো দল নয়, তবে অভিজ্ঞতা এবং সামর্থ্যে পরিপূর্ণ এবারের দলটি। তাছাড়া তাঁরা কেবল দল কিংবা নিজের জন্য নয়, তাঁরা লিওনেল মেসির জন্য খেলেন। দলনেতার জন্য নিজের জীবন বিসর্জন দিতেও কুন্ঠাবোধ করেন না। মাঠে তাঁর উপস্থিতি বাড়তি অনুপ্রেরণা দেয় দলকে। কোপা ফাইনালেসিমা জেতার পর এমি মার্টিনেজ বলেছিলেন, ‘আমরা একদল সিংহ যারা মেসির জন্য লড়ে।’
এবারের বিশ্বকাপ জিততে না পারার কোনো কারণই নেই আর্জেন্টিনার কাছে। যোগ্য এক নেতার অধীনে লড়াকু এক দল রয়েছে তাঁদের যারা কিনা নিজেদের শেষবিন্দু দিয়ে লড়ে যায়। স্কালোনি অবশ্য বলেই দিয়েছেন, ‘মেসি বিশ্বকাপ জিতুক কিংবা না-ই জিতুক, সে ইতিমধ্যেই সর্বকালের সেরাদের একজন। তাঁর প্রতিপক্ষরাও সেটা স্বীকার করে নিয়েছে।’
তবে সময় যত গড়াচ্ছে, ক্ষুদে তারকার প্রস্থানের সময়ও এগিয়ে আসছে। সর্বকালের সেরার বিদায়টা শিরোপা দিয়েই হোক এই আশাতেই বুক বাঁধছে বিশ্বব্যাপী ফুটবল সমর্থকরা।