লিওনেল মেসি ও ‘দ্য ট্রিপল ক্রাউন ক্লাব’

ফুটবলে সর্বজয়ীদের ছোট্ট তালিকাটায় তাঁর নাম ছিল না। কিন্তু ২০২২ সালের ১৮ ডিসেম্বরের পর সেই ইতিহাসটা পাল্টে গেছে। লুসাইলের ফাইনালে লিখেছেন নতুন এক ইতিহাস। ৩৬ বছর পর আর্জেন্টিনাকে এনে দিয়েছেন অধরা সেই বিশ্বকাপ ট্রফিটি। একই সাথে নিজেকে সর্বজয়ীদের তালিকাতে নিয়ে গেছেন দ্য এল এম টেন- লিওনেল মেসি।

বিশ্বকাপ জেতার পর মেসি এখন ‘ট্রিপল ক্রাউন’ ক্লাবের সদস্য বনে গিয়েছেন। ট্রিপল ক্রাউন ক্লাবে তারাই যুক্ত হতে পারেন, যাদের বিশ্বকাপ, ব্যালন ডি অর এবং চ্যাম্পিয়ন লিগ(ইউরোপিয়ান কাপ) শিরোপা রয়েছে। এই তিন অর্জনের চক্র পূরণ হলেই একজন ফুটবলার ট্রিপল ক্রাউন ক্লাবে ঢুকতে পারেন। মেসির আগে যে কীর্তি ছিল আরো আটজনের। এদের মধ্যে ব্রাজিল ও এসি মিলানের সাবেক তারকা কাকাও রয়েছেন। আর তিনিই প্রথম মেসিকে আনুষ্ঠানিকভাবে এই ক্লাবে স্বাগত জানিয়েছেন।

ক্লাবের নতুন সদস্য মেসিকে স্বাগত জানিয়ে তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছেন, ‘ক্লাবে স্বাগত মেসি’। একই সাথে তিনি এই এলিট ক্লাবে বাকি আটজনের নাম সম্বলিত একটি স্ক্রিণশটও শেয়ার করেছেন।

নয় জনের ট্রিপল ক্রাউনে অবশ্য সবার মাঝেই দারুণ একটি মিল রয়েছে।এই ক্লাবে থাকা কেউই একাধিক বিশ্বকাপ শিরোপা জেতেননি। আবার উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের ক্ষেত্রে মেসি, ফ্রাঞ্জ বেকেবাওয়ার আর জার্ড মুলার বাদে কেউই একাধিকবার এ শিরোপা জেতেননি। ট্রিপল ক্রাউন ক্লাবে বর্তমানে সর্বোচ্চ তিনজন রয়েছেন ব্রাজিল থেকে, দুইজন আছেন জার্মানি, একজন করে আছেন ইংল্যান্ড, ইতালি, ফ্রান্স আর আর্জেন্টিনা থেকে। ৯ সদস্যের ট্রিপল ক্রাউন ক্লাবটায় আপাতত একটু ঘুরে আসা যাক।

  • স্যার ববি চার্লটন (ইংল্যান্ড) 

ট্রিপল ক্রাউন ক্লাবের ইতিহাসে প্রথম সদস্য হলেন স্যার ববি চার্লটন। একই সাথে তিনি এই তালিকায় একমাত্র ইংলিশ ফুটবলারও। ১৯৬৬ সালে বিশ্বকাপ জিতেছিল ইংল্যান্ড। সে বিশ্বকাপের ইংল্যান্ড দলে অন্যতম সদস্য ছিলেন ববি চার্লটন।

সেই একই বছরে তিনি ব্যালন ডি অর জিতেছিলেন। আর দুই বছর বাদে, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে তিনি ইউরোপিয়ান কাপ জিতেছিলেন। এর মধ্য দিয়ে প্রথম ফুটবলার হিসেবে ট্রিপল ক্রাউন ক্লাবে ঢোকার কীর্তি গড়েছিলেন স্যার ববি চার্লটন।

  • ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার (জার্মানি) 

১৯৭৪ সালে পশ্চিম জার্মানির হয়ে বিশ্বকাপ শিরোপা জিতেছিলেন ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার। বিশ্বকাপ শিরোপার আগে ১৯৭২ সালে ব্যালন ডি অর পুরস্কার জিতেছিলেন তিনি। অবশ্য এর পরেও তিনি ১৯৭৬ সালে আরও একবার ব্যালন ডি অর জেতেন।

আর ১৯৭৪ সাল থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত টানা তিনবার ইউরোপিয়ান কাপ শিরোপা জিতেছিল বেকেনবাওয়ারের বায়ার্ন মিউনিখ। ট্রিপল ক্রাউন ক্লাবে মেসি ছাড়া বেকেনবাওয়ারই একমাত্র ফুটবলার যার দুটি ব্যালন ডি অর রয়েছে।

  • জার্ড মুলার (জার্মানি)

বেকেনবাওয়ার আর জার্ড মুলার বলতে গেলে একই সাথে সর্বজয়ীদের ক্লাবে প্রবেশ করেছেন। কারণ বেকেনবাওয়ারের মতোই তিনিও ১৯৭৪ বিশ্বকাপে শিরোপা জিতেছিলেন।

আর তিনিও বায়ার্ন মিউনিখের হয়ে ঐ ১৯৭৪ সাল থেকে ১৯৭৬ পর্যন্ত টানা তিনবার ইউরোপিয়ান কাপের শিরোপা জিতেছিলেন। সামান্য পার্থক্য বলতে, বেকেনবাওয়ার ১৯৭২ সালে প্রথম ব্যালন ডি অর জিতেছিলেন। আর জার্ড মুলার তাঁর একমাত্র ব্যালন ডি অরটি পেয়েছিলেন ১৯৭০ সালে।

  • পাওলো রসি (ইতালি) 

১৯৮২ বিশ্বকাপে গোল্ডেন বুট আর গোল্ডেন বল- দুটিই জিতেছিলেন ইতালির পাওলো রসি। একই সাথে সেবার তিনি বিশ্বকাপ শিরোপাও উঁচিয়ে ধরেছিলেন। ব্যক্তিগত আর দলগত অর্জনের সুবাদে সেই বছরই তিনি ব্যালন ডি আর পুরস্কার জিতেন।

তবে, ট্রিপল ক্রাউন ক্লাবে প্রবেশের জন্য তখন পর্যন্ত একটি ইউরোপিয়ান কাপ শিরোপা তাঁর জন্য আরাধ্য হয়ে ছিল। তবে বছর তিন পরে, সেই আক্ষেপও তিনি ঘুচিয়ে ফেলেন। জুভেন্টাসের হয়ে জেতেন ইউরোপিয়ান কাপ শিরোপা। এর মধ্য দিয়ে প্রথম এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র ইতালিয়ান হিসেবে তিনি ট্রিপল ক্রাউন ক্লাবে নিজের নাম লিখিয়ে ফেলেন।

  • জিনেদিন জিদান (ফ্রান্স) 

১৯৯৮ সালে বিশ্বকাপে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিলকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় ফ্রান্স। আর সে ফাইনালের মহানায়ক ছিলেন জিনেদিন জিদান। মূলত সে ম্যাচে তাঁর হেড থেকে হওয়া দুই গোলেই ছিটকে যায় ব্রাজিল।

এমন দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের কারণে সে বছরই বর্ষ সেরা ফুটবলারের পুরস্কার হিসেবে তিনি ব্যালন ডি অর জেতেন। তবে চ্যাম্পিয়ন লিগ শিরোপার জন্য তাঁকে অপেক্ষা করতে হয় আরো চার বছর। ২০০২ সালে রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা জিতে তিনি ট্রিপল ক্রাউনের চক্র পূরণ করে ফেলেন।

 

  • রিভালদো (ব্রাজিল) 

১৯৯৮ বিশ্বকাপ ফাইনালে ব্রাজিল ফ্রান্সের কাছে হেরে বিশ্বকাপ শিরোপা খোয়ালেও পরের বছর ১৯৯৯ সালে ব্যালন ডি অর জিতেছিলেন রিভালদো। তবে দলগত অর্জন তো সব কিছুর ঊর্ধ্বে। অবশ্য রিভালদোর আগের বিশ্বকাপের সেই আক্ষেপ ঘুচে যায় ২০০২ বিশ্বকাপেই।

সে বার ব্রাজিলের পঞ্চম শিরোপা জয়ের পথযাত্রায় অন্যতম সদস্য ছিলেন রিভালদো। নিজের সুসময়ের রেশটা টেনে নেন ক্লাব পর্যায়েও। পরের বছরই এসি মিলানে হয়ে জেতেন চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা। এর মধ্য দিয়ে প্রথম ব্রাজিলিয়ান হিসেবে ট্রিপল ক্রাউনের এলিট ক্লাবে নিজের নাম লেখান রিভালদো।

  • রোনালদিনহো (ব্রাজিল) 

তাঁকে চাইলে একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকের সেরা ফুটবলার বলেও আখ্যায়িত করা যায়। তর্কযোগ্যভাবে যে টুকু বিতর্ক হতে পারে, সেটাও তাঁর দলগত ও ব্যাক্তিগত অর্জনের ভীড়ে উড়িয়ে দেওয়া যায়।

২০০২ বিশ্বকাপে ব্রাজিলের হয়ে জিতেছিলেন বিশ্বকাপ শিরোপা। এরপর ২০০৬ সালে বার্সেলোনার হয়ে জিতেছিলেন চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা। আর তার আগের বছর ২০০৫ সালে ফুটবলারদের ব্যক্তিগত অর্জনের সর্বোচ্চ অ্যাওয়ার্ড ব্যালন ডি অর জিতেছিলেন রোনালদিনহো।

  • কাকা (ব্রাজিল) 

রিভালদো, রোনালদিনহোর পর ট্রিপল ক্রাউনের পরের নামটাও একজন ব্রাজিলিয়ানের। রিভালদো, রোনালদিনহোর মতো তিনিও ২০০২ বিশ্বকাপ শিরোপাজয়ী ব্রাজিল দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন।

আর ২০০৭ সালে এসি মিলানে হয়ে জিতেছিলেন চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা। দুর্দান্ত মৌসুম কাটানোর সুবাদে ঐ বছরেই তিনি ব্যালন ডি আর জেতেন।

  • লিওনেল মেসি (আর্জেন্টিনা) 

ট্রিপল ক্রাউন ক্লাবের সর্বশেষ সদস্য। তবে ছোট্ট এই তালিকাটায় নাম লেখাতে মেসিকে কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। বিশ্বকাপ শিরোপা জেতার আগেই মেসির ঝুলিতে চার চ্যাম্পিয়নস ট্রফি আর সাতটি ব্যালন ডি অর ছিল। কিন্তু অনুপস্থিতি ছিল ঐ পরম আরাধ্য সোনালি ট্রফিটির। অবশেষে ২০২২ বিশ্বকাপে এসে দীর্ঘ প্রতিক্ষার অবসান ঘটলো। মেসি পেলেন বিশ্বকাপ ট্রফি ছোঁয়া। একই সাথে সর্বজয়ীদের দলেও জায়গা পেয়ে গেলেন তিনি। তবে মেসির এই ট্রিপল ক্রাউনের পথযাত্রাটা ছিল এক যুগ পেরিয়ে ১৬ বছরের।

২০০৬ সালে বার্সেলোনার হয়ে চ্যাম্পিয়নস ট্রফির শিরোপা জিতে শুরু করেছিলেন। অবশেষে ১৬ বছর পর, আর্জেন্টিনার হয়ে বিশ্বকাপ জিতে তিনি এই দৌড়ের শেষ লাইনটা অতিক্রম করতে সক্ষম হলেন। মাঝখানে সাতবার পেয়েছেন ব্যালন ডি অর পুরস্কার। ২০০৯ থেকে ২০১২ টানা চারবার। এরপর দুই বছর বাদে ২০১৫ তে একবার। আর ২০১৯ ও ২০২১ মিলিয়ে সর্বোচ্চ সাত বার এই অ্যাওয়ার্ড জিতেছেন দ্য এলএমটেন।

লেখক পরিচিতি

বাইশ গজ ব্যাসার্ধ নিয়ে একটি বৃত্ত অঙ্কন করার চেষ্টা করি...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link