সঞ্জয় ব্যাঙ্গার, হেলায় হারানো সম্ভাবনা

ক্রিকেটের প্রতি তাঁর আগ্রহটা জন্মায় ১৯৮৩ বিশ্বকাপের ফাইনালের পর। সেদিনের ফাইনালটা দেখেছিলেন প্রতিবেশির বাড়ির সিঁড়িতে বসে। সেই সময়ে মনের মধ্যে স্বপ্নের বীজ বুনেন কপিল দেব, সুনীল গাভাস্কারদের উত্তরসূরি হওয়ার।

এ প্রজন্মের ক্রিকেটপ্রেমীরা তাঁকে চেনে ক্রিকেট কোচ হিসেবেই। অথচ ভুলে যায় ক্রিকেটার হিসেবে তাঁর সব্যসাচী ভূমিকার কথা। দলের প্রয়োজনে সব সময় দাঁড়িয়েছেন ঢাল হয়ে। ব্যাটিং অর্ডারে নেমেছেন ওপেনিং থেকে একদম লেট মিডল অর্ডার পর্যন্ত সব পজিশনেই।

নিজের ক্যারিয়ারের কথা না ভেবে সব সময় প্রাধান্য দিয়ে গিয়েছেন দলকেই। আর বোলিংটা ছিল তাঁর মজ্জাগত, দলের জরুরি সময়ে গুরুত্বপূর্ণ বেকথ্রু এনে দিতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। তিনি সঞ্জয় ব্যাঙ্গার, ভারতের ব্যাটিং কোচ ছিলেন এক সময়। বড় তারকাও হতে পারতেন, পারেননি কপাল দোষে।

সঞ্জয় বাঙ্গারের জন্ম মহারাষ্ট্রের বেদ জেলার প্রত্যন্ত এক গ্রামে। কৃষক পরিবারের সন্তান সঞ্জয়কে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশায় পড়ালেখার জন্য পাঠিয়ে দেন আওরঙ্গোবাদে। সেখানেই স্কুলের পড়ার পাট চুকান তিনি।

ক্রিকেটের প্রতি তাঁর আগ্রহটা জন্মায় ১৯৮৩ বিশ্বকাপের ফাইনালের পর। সেদিনের ফাইনালটা দেখেছিলেন প্রতিবেশির বাড়ির সিঁড়িতে বসে। সেই সময়ে মনের মধ্যে স্বপ্নের বীজ বুনেন কপিল দেব, সুনীল গাভাস্কারদের উত্তরসূরি হওয়ার। নিজের একাগ্রতা ,পরিশ্রম আর ক্রিকেটীয় দক্ষতা দিয়ে খুব সুযোগ পেয়ে যান মহারাষ্ট্র অনূর্ধব ১৫ দলে।

যদিও সেই দলের হয়ে মাঠে নামেন মাত্র এক ম্যাচেই। আসলে মহারাষ্ট্রে সে সময় ক্রিকেটটা খুব গুরুত্বের সাথে খেলা হত না। ফলে অল্প বয়সেই ব্যাঙ্গার নিয়ে নেন কঠিন এক সিদ্ধান্ত, চলে আসেন মুম্বাইতে। শুরু হয়ে তাঁর জীবনের নতুন এক অধ্যায়। 

১৫ বছর বয়সের এক কিশোরের জন্য মুম্বাই মোটেই সহজ জায়গা ছিল না। মুম্বাইতে তখন প্রতিভাবান ক্রিকেটারের ছড়াছড়ি। চারিদিকে মাঠ মাতাচ্ছেন শচীন টেন্ডুলকার, বিনোদ কাম্বলির মত উঠতি তরুণরা।

ফলশ্রুতিতে প্রথম দুই-তিন বছর তেমন ম্যাচ খেলার সুযোগ পাননি। এদিকে ঝাঁকিয়ে বসেছে অর্থাভাব, ফলে জীবিকার তাড়নায় চাকরি নেন ভারতীয় রেলওয়েতে। পাশাপাশি চলতে থাকে ক্রিকেট সাধনা। অবশেষে ভাগ্যবিধাতা মুখ তুলে তাকান তাঁর দিকে। ১৯৯৩-৯৪ মৌসুমে রেলওয়ের হয়ে বিদর্ভের বিপক্ষে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে তাঁর।

ব্যাট হাতে দুই ইনিংসে যথাক্রমে ৪৫ এবং ১৬ রান করলেও বল হাতে ছিলেন উইকেটশূন্য। প্রথম মৌসুমে কেবল একটি ম্যাচ খেললেও সবাই বুঝতে পেরেছিলেন হারিয়ে যেতে আসেনি এই ছেলে। ক্রমেই পরিণত হন রেলওয়ের মূল খেলোয়াড়দের একজন হিসেবে। 

ক্যারিয়ারের প্রতিটা পর্যায়ে হোঁচট খেয়েছেন, কিন্তু কখনও হাল ছাড়েননি ব্যাঙ্গার। ঘরোয়া ক্রিকেটে নিয়মিত পারফর্ম করলেও তারকাবহুল জাতীয় দলে ডাক পাচ্ছিলেন না। এভাবে কেটে যায় আটটি মৌসুম। বাঙ্গার কিন্তু হাল ছাড়েননি, প্রতিটি মৌসুমকে ভেবেছেন নতুন শুরু হিসেবে।

নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন নিজের স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে। ২০০১-০২ মৌসুমে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচের দ্বিতীয় ইনিংসে সাত উইকেট তুলে নিলে জাতীয় দলের দরজা খুলে যায় তাঁর জন্য। মোহালিতে প্রথম টেস্টে টিনো ইয়োহান এবং ইকবাল সিদ্দিকির সাথে অভিষেক ঘটে তাঁরও।

মূলত বোলার হিসেবে সুযোগ পেলেও তিনি চেয়েছিলেন ওপেন করতে। যদিও ভারতের সে সময়ের অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলি তাঁকে ওপেন করবার সুযোগ দেননি। তাঁর বদলে ওপেনিং করতে নামা দ্বীপ দাশগুপ্ত সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছিলেন সে ম্যাচে। আট নম্বরে নেমে ৩৬ রান করলেও বল হাতে কোনো উইকেট নিতে পারেননি ব্যাঙ্গার।  যদিও ভারত সে ম্যাচ জিতে নিয়েছিল ১০ উইকেটের বড় ব্যবধানেই। 

তবে মোহালি বরাবরই ব্যাঙ্গারের জন্য পয়মন্ত, তাঁকে কখনোই খালি হাতে ফেরায়নি এই স্টেডিয়াম। আট মৌসুম আগে এই মাঠে করেছিলেন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের নিজের প্রথম সেঞ্চুরি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের প্রথম সেঞ্চুরিও পান এখানেই, দ্বিতীয় টেস্টেই সাত নম্বরে নেমে খেলেন অপরাজিত ১০০ রানের ইনিংস।

ভারত সে ম্যাচটাও জিতেছিল হেসেখেলেই, ইনিংস ব্যবধানে। তবে তাঁর ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরানো ইনিংস খেলেন হেডিংলিতে, সেবার নিজের পছন্দের পজিশন ওপেনিং এ নামার সুযোগ পান। নিজে ৬৮ রান করার পাশাপাশি দ্বিতীয় উইকেটে ১৭০ রান যোগ করেন রাহুল দ্রাবিড়ের সাথে।

তাঁদের এই জুটিই ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল ভারতের ইনিংসের, যার উপর দাঁড়িয়ে ম্যাচ জয়ের পথ সুগম করেন শচীন টেন্ডুলকাররা। ভারতের ইতিহাসের অন্যতম সেরা জয় বিবেচনা করা হয় হেডিংলির এই টেস্টকে, আর বাঙ্গার ছিলেন সেই টেস্টের অন্যতম নায়ক। এরপর আর পেছন ফিরে তাঁকাতে হয়নি। 

লাল বলের ক্রিকেটে দারুণ পারফর্ম করার সুবাদে একদিনের ক্রিকেটে ডাক পেতে খুব বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি। যদিও এই ফরম্যাটে তেমন আলো ছড়াতে পারেননি, ১৫ ম্যাচে এক ফিফটিতে সংগ্রহ মোটে ১৮০ রান। বলে হাতেও অনুজ্জ্বল, নিয়েছেন মাত্র সাত উইকেট।

যদিও ২০০৩ বিশ্বকাপে রানার্স আপ ভারত দলের স্কোয়াডে ছিলেন। কিন্তু কোনো ম্যাচে মাঠে নামার সুযোগ হয়নি। তবে টেস্টে ধারবাহিকতা বজায় রেখেছিলেন ব্যাট হাতে, ক্যারিবীয়দের বিপক্ষে টানা দুই ম্যাচে ফিফটি হাঁকান। কিন্তু, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে মাত্র দুই টেস্টে খারাপ করায় দল থেকে বাদ পড়ে যান।

নির্বাচকদের এমন সিদ্ধান্তে সবাই বেশ অবাক হয়েছিলেন। এর চেয়েও বাজে পারফরম্যান্স করে দলে টিকে গিয়েছিলেন অনেকেই। পরাজয়ের খড়গটা কেবল নেমে এসেছিল তাঁর উপরেই। ভাগ্য বিধাতার বিরূপ এই আচরণে বাঙ্গারের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে দাঁড়ি পড়ে যায় মাত্র ১২ টেস্টেই। 

জাতীয় দল থেকে বাদ পড়লেও ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলা চালিয়ে গিয়েছেন ব্যাঙ্গার। বিজয় হাজারের পর মাত্র দ্বিতীয় ক্রিকেটার হিসেবে রঞ্জি ট্রফিতে ছয় হাজার রান এবং দুইশ উইকেট নেবার বিরল রেকর্ড তাঁর দখলে। তাঁর সময়ে রেলওয়েকে রঞ্জি ট্রফি এবং ইরানি ট্রফি জিতিয়েছেন দু’বার করে। বাইশ গজ থেকে বিদায়ের পর ক্যারিয়ার শুরু করেন কোচ হিসেবে।  

আইপিএলে ডেকান চাঞ্জার্স, কলকাতা নাইট রাইডার্সের সহকারী কোচের দায়িত্ব পালনের পর ২০১৪ নিযুক্ত হন পাঞ্জাবের প্রধান কোচ হিসেবে। প্রথম মৌসুমেই দলকে নিয়ে যান ফাইনালে, যদিও সেবার হাত-ছোঁয়া দূরত্বে থেকে শিরোপা বঞ্চিত হয় পাঞ্জাব। ঘরোয়া ক্রিকেটের দারুণ সাফল্যের পরই নিযুক্ত হন জাতীয় দলের সহকারি কোচ হিসেবে। ভারত জাতীয় দলের ব্যাটিং কোচের দায়িত্বও পালন করেছেন তিনি।

ক্রিকেটার কিংবা কোচ হিসেবে খ্যাতি পেলেও বাঙ্গার ভুলে যাননি নিজের শিকড়কে। পূর্বপুরুষের পেশা কৃষিকে আজও সমান ভালোবাসেন। মুম্বাই আর আওরংগাবাদে নিজের ফার্মে প্রায়ই নেমে পড়েন চাষবাসের কাজে সাহায্য করতে। হয়তো ক্রিকেট বিধাতার বিরূপতা ভুলে থাকতে চান তাঁর সৃষ্টিতে ডুবে থেকে। 

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...