আয়রন গ্লাভস অব অস্ট্রেলিয়া

সেঞ্চুরি থেকে মাত্র ৮ রান দূরে থাকতেই অজি অধিনায়ক বিল লরি ইনিংস ঘোষণা করেন! এতে মিডিয়ায় তুমুল হৈচৈ শুরু হয়। সেঞ্চুরির আক্ষেপের প্রশ্নে রডনি জানান, ‘আমি ৪০ রান বেশি করতে পেরেছি! আমি ভেবেছিলাম লরি আরো ঘন্টাখানেক আগেই ইনিংস ঘোষণা করবে।’

উইকেটের পেছনে দুর্দান্ত ক্যাচ, বল গ্লাভসবন্দি করেই আকাশে ছুঁড়ে মেরে উদযাপন; উইকেটের পেছনে দাঁড়িয়ে পুরো ম্যাচেই সতীর্থদের উজ্জীবিত রাখা, নান্দনিক উইকেটকিপিং – আধুনিক ক্রিকেটের কিপিংটা এসেছিলো রডনি মার্শের হাত ধরেই। অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেটের এই কিংবদন্তি তারকা সত্তরের দশকে কিপিংয়ে এনে দিয়েছিলেন আধুনিকতার ছোঁয়া। ব্যাট হাতে আগ্রাসী ভূমিকা পালন করা রডনি পরবর্তীতে বনে যান সময়ের সেরা উইকেটরক্ষক হিসেবে।

বাড়ির আঙ্গিনায় ভাই গ্রাহাম মার্শের সাথে ক্রিকেট খেলেই রডনির বেড়ে ওঠা। গ্রাহাম ছিলেনে একজন প্রোফেশনাল গলফার। রডনির দাদা ড্যানিয়েল মার্শ অবশ্য এক ব্রিটিশ নাগরিককে খুনের অভিযুক্ত হিসেবে ৫ বছর কারাবাসেও ছিলেন! যদিও তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ হয়নি। রডনি তাঁর দাদার নামেই এক ছেলের নাম রাখেন ড্যানিয়েল মার্শ!

মাত্র আট বছর বয়সে আরম্যাডল অনূর্ধ্ব ১৬ দলের হয়ে প্রথম প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ খেলেন রডনি। ক্যারিয়ারের শুরু থেকে উইকেটকিপিং করলেও মূলত ব্যাটিংটাই ছিলো তাঁর আসল শক্তি। ১৩ বছর বয়সে স্কুল ক্রিকেটে অধিনায়কত্ব করেন তিনি। দুই ভাই স্কুল ক্রিকেটে ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার হয়ে খেলেছেন। পরবর্তীতে ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে যাত্রা শুরু বরেন রডনি।

রডনির মা চেয়েছিলেন ছেলে হবেন একজন পিয়ানোবাদক! কিন্তু রডনির ধ্যান-জ্ঞান ছিলো ক্রিকেটে!

১৯৭০ সালে অ্যাশেজ সিরিজে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয় তাঁর। আর অভিষেক ম্যাচেই একাধিক ক্যাচ ছেড়ে বিতর্কের জন্ম দেন এই উইকেটরক্ষক ব্যাটার। মিডিয়া থেকে আখ্যা পান ‘আয়রন গ্লাভস’ হিসেবে। অবশ্য অভিষেকে প্রথম ইনিংসেই তিনি চারটি ক্যাচ শিকার করেন।

এরপর নিজের পঞ্চম ম্যাচেই প্রথম অস্ট্রেলিয়ান উইকেটকিপার হিসেবে সেঞ্চুরির হাতছানি ছিলো রডের সামনে। কিন্তু সেঞ্চুরি থেকে মাত্র ৮ রান দূরে থাকতেই অজি অধিনায়ক বিল লরি ইনিংস ঘোষণা করেন! এতে মিডিয়ায় তুমুল হৈচৈ শুরু হয়। সেঞ্চুরির আক্ষেপের প্রশ্নে রডনি জানান, ‘আমি ৪০ রান বেশি করতে পেরেছি! আমি ভেবেছিলাম লরি আরো ঘন্টাখানেক আগেই ইনিংস ঘোষণা করবে।’

পরবর্তীতে ১৯৭২ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে অ্যাডিলেডে ১১৮ রানের ইনিংসের মধ্যে দিয়ে প্রথম অস্ট্রেলিয়ান উইকেটকিপার হিসেবে সেঞ্চুরি করেন রডনি। পরবর্তীতে ইংল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজেও ব্যাট হাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তিনি। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৬ টেস্টে ২৬ ক্যাচ ধরে গড়েন বিশ্ব রেকর্ড!

১৯৭৭ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১১০ রানের ইনিংসের মধ্যে দিয়ে প্রথম অস্ট্রেলিয়ান উইকেটকিপার হিসেবে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেঞ্চুরির কীর্তি গড়েন রডনি। একই ম্যাচে সাবেক অস্ট্রেলিয়ান উইকেটকিপার ওয়ালি গ্রুটের ১৮৭ টেস্ট ডিসমিসালের রেকর্ড ভাঙেন তিনি। পরবর্তীতে আলোচিত ক্যারি প্যাকার সিরিজেও খেলেন তিনি।

১৯৮১ সালে ইংল্যান্ড সফরে ২৩ ডিসমিসাল করার সাথে সাথে প্রথম উইকেটরক্ষক হিসেবে অ্যাশেজে ১০০ ডিসমিসালের রেকর্ড গড়েন। তবে ব্যাট হাতে হতাশাজনক পারফরম্যান্সই পরবর্তীতে ক্যারিয়ার থমকে দেয় রডনির। ক্যারিয়ারের প্রথম ভাগে ৩৩ গড়ে ব্যাটিং করলেও শেষ ২২ টেস্টে মাত্র ২০ গড়ে করেন ৫৮৯ রান!

কোনো নির্দিষ্ট বোলারের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারের পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখা উইকেটকিপার রডনি মার্শ। অস্ট্রেলিয়ান কিংবদন্তি পেসার ডেনিস লিলির ক্যারিয়ারের ৯৫ উইকেটেই অবদান আছে রডনির। মার্শ কট, লিলি বোল্ড – এটি ছিলো অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেটের তখনকার এক জনপ্রিয় জুটি। ক্রিকেট ইতিহাসে লিলি-রডনি জুটি বেশ জনপ্রিয়। লিলি সম্পর্কে এক সাক্ষাৎকারে রডনি বলেছিলেন, ‘লিলি বল করার আগেই আমি প্রায়সই বুঝতে পারতাম সে বলটা কোথায় এবং কেমন ধরনের করবে।’

৯৬ টেস্টে ৩৫৫ ডিসমিসাল করেন রডনি মার্শ; যা ছিলো ওই সময়ের বিশ্বরেকর্ড। কাকতালীয়ভাবে রডনির সবচেয়ে ভালো বন্ধু লিলির টেস্ট উইকেট সংখ্যাও ৩৫৫!

১৪ বছরের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে ৯৬ টেস্টে ২৭ গড়ে ৩৬৩৩ রান করেছেন রডনি। ৩ সেঞ্চুরি ও ১৬ ফিফটি আছে মার্শের নামে। অপরদিকে রঙিন জার্সিতে ৯২ ম্যাচে ২০ গড়ে ৮২ স্ট্রাইক রেটে করেছেন ১২২৫ রান, আছে ৪ ফিফটি। এছাড়া ঘরোয়া ক্রিকেটে ৩৯৭ ম্যাচে করেছেন ১৩ হাজারেরও বেশি রান।

ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর পর লম্বা সময় ধরে চ্যালেন নাইনের ধারাভাষ্যকার হিসেবে কাজ করেন রডনি। এরপর অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে কোচ হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন এই কিংবদন্তি। পরবর্তীতে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার প্রধান নির্বাচক ও ম্যানেজার হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৫ সালে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার হল অব ফেইমে অন্তর্ভুক্ত হন তিনি। এবং ২০০৯ সালে আইসিসির হল হব ফেইমে জায়গা পান এই অস্ট্রেলিয়ান তারকা।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...