লিওনেল স্ক্যালোনির মগজ নিয়ে একটা পরীক্ষা চালানো দরকার। কেন? সেটায় আসি একটু। আসলে এই দিনটা, বিশ্বকাপ ফাইনালের দিনটায় আর ঐ স্ট্যাট, মাঠের অ্যানালিসিস, স্ট্রাকচার, ফর্মেশন, সেট আপ, বিল্ড-ফিল্ড নিয়ে কথা বলতেও ভাল লাগে না, শুনতেও না। কোথাও ঘুরতে গিয়ে খুব মজা, খুব চর্চা করার পর যেদিন ট্রেনে ওঠার সময়টা চলে আসে, আলবিদা বলা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না।
স্ক্যালোনি সৌদি আরব ম্যাচটায় লাউটারোকে সিঙ্গল স্ট্রাইকার করে মেসিকে বাঁয়ে ঠেলেছিল। সিঙ্গল স্ট্রাইকার রোল থাকার জন্য রেনার্ড স্কালোনি ক্যাম্পকে যে অফ সাইড ট্র্যাপে ফেলেছিল, সেটাই চেঞ্জ হল মেক্সিকো ম্যাচে। ডিফেন্স শুরুতে নড়বড়ে লাগলেও স্ক্যালোনি যে মাঝ মাঠকে লুকিয়ে মেপে রাখছেন সেটা মেক্সিকো ম্যাচই বুঝিয়েছিল। লো সোলসোর আক্ষেপটা ঘোচাল একজন নয়, দু’জন।
এক, বেনফিকার তরুণ স্টার এঞ্জো ফার্নান্ডেজ এবং দুই, ব্রাইটনের মত ছোট ক্লাবে খেলা অ্যালেক্সিস ম্যাক অলিস্টার। পিভটে এদেরকেই মিড করিডরে নামিয়ে দিলেন স্কালোনি, আর একটু ওপরে মানে মেসির ঠিক নিচেই তুললেন দে পলকে। ব্যস, এক’টা চেঞ্জে খেলা ঘুরে গেল আর্জেন্টিনার। আরও আছে। রোমেরোর বডি ল্যাঙ্গুয়েজ সৌদি ম্যাচে অত্যন্ত নিম্নমানের ছিল।
রিফ্লেকশন টাইমটা এত খেয়ে নিচ্ছিল ফলে ডানদিকে আউট সাইড কাট করে যে বলটা গোল হল আরবের, সেটা প্রথমত পেত না। পেল কারণ রোমেরোর অ্যান্টিসিপেশনে ভুল। সেই রোমেরো নিজের সেরা ম্যাচটা খেলল কোয়ার্টারে। নিকোলাস ওটামেন্ডি সারাজীবন ভক্তদের গালাগাল খেয়ে এসেও, লাস্ট কোপা থেকে প্রায় জীবন ফিরে পেল। কারণ ওটামেন্ডির ভিশন ভাল এবং ফিজিক্যাল।
যেগুলো এতদিন লুকিয়ে ছিল সেগুলো স্ক্যালোনি টেনে বার করলেন এবং নামালেন সেন্ট্রাল ডিফেন্সে। তা’বলে কি ওটামেন্ডি ভুল করেনি? করেছে। কিন্তু সেই ভুল নয় যেখান থেকে গালাগাল খেতে পারে এবং ম্যাচ অপোনেন্টের হাতে তুলে দিতে পারে।
স্ক্যালোনির সবচেয়ে বড় চেঞ্জটা মেসিকে সেকেন্ড স্ট্রাইকার আর হোল্ডারের দায়িত্ব দিয়ে আলভারেজকে তৈরি করে ফলস নাইন খেলানো। আলভারেজ সিটিতেও সেকেন্ড চয়েস, এখানেও লাউটারো সাব হওয়ার আগে তাই ছিল। ৪-৩-৩ এ লাউটারো উইথ দ্য বল একেবারে রাইট চয়েস নয়, আনপ্রেডিক্টবল। তাই সবাই বলছে লাউটারো আবার আর্জেন্টাইনদের পুরনো কাসুন্দি ফিরিয়ে এনেছে, আদতেও সেটা ঠিক নয়।
প্রত্যেকের খেলার নির্দিষ্ট একটা সেট আপ থাকে। ইন্টারের ৩-৫-২তে সেকেন্ড স্ট্রাইকার রোলে যে স্বচ্ছন্দ, সে এখানে ফিট হতে গেলে আরও ম্যাচ প্র্যাকটিস দরকার ছিল যেটা লাউটারো পায়নি। বদলে সুযোগ পেল আলভারেজ এবং পিভট স্ট্রাইকার রোলে জবরদস্ত খেলে কাপ নিয়ে গেল।
অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া – অনেকে নেহায়েৎই সাধারণ ফুটবলার মনে করেন (আর্জেন্টিনা সমর্থক বাদে)। দি মারিয়া যখন বেনফিকায় খেলত, স্বভাবসিদ্ধ ড্রিবলিং ছাড়াও মাঝে মাঝে পজিশন বদল করে খেলার একটা আশ্চর্য প্রবৃত্তি ছিল। হোসে মরিনহোর আমলে মাদ্রিদে এসে যার ঝলক কিছু কিছু ম্যাচে দেখা গেছে। বিশেষ করে, ২০১২-১৩ মাদ্রিদ ডার্বি। এবং আন্সেলোত্তি এসে অন পেপার ৪-২-৩-১ এ ডি মারিয়াকে ডানদিকে নামালেও খেলালেন বাঁয়ে।
তারপর কী হয়েছিল সারা দুনিয়াই জানেন। এই সহজাত প্রবৃত্তি বজায় থেকেছে এখনও কিন্তু এই ডি মারিয়া আগের থেকে অনেকটাই স্লথ, বয়স গতি কমিয়েছে, ট্র্যাকব্যাকিং কমিয়েছে যেটা আগে ভালই ছিল, ডিপে গিয়ে ট্যাকল করতেও দেখা গেছে। কাল তাই প্রথম ৬০ মিনিটই ওর খেলা ছিল। ওয়ান অন ওয়ানে বরাবরই ভরসার নাম, আর টাচলাইন থেকে একটা ইনসাইড কাটে স্পেসে ঢুকে পড়ার পর ডেম্বেলের কাছে উপায় ছিল না ফাউল করা ছাড়া।
আর যতক্ষণে সেটা করেছে, ততক্ষণে ডি মারিয়া বক্সে ঢুকে গেছে। সেকেন্ড গোলের সময় ওভারলোড পেরিয়ে মেসি, আলভারেজের ওয়াল থেকে যখন কাউন্টার শুরু হচ্ছে, কে বলবে ওটা ২০১৩-১৪-র ডি মারিয়া নয়! কোথায় নিচে নেমেছিল, সেখান থেকে আউট অফ পজিশন দৌড় শুরু করল। আলভারেজ থেকে ম্যাক অলিস্টার, মাঝে বড় গ্যাপ, সেখানে অলিস্টারের মাইনাস এবং ডি মারিয়ার হার্ট সাইন!
এই ডি মারিয়া রয়ে গেল আর্জেন্টিনার তাবড়দের ভীড়ে এক নিশ্চুপ সেনানী হয়ে। ২০০৮ বেজিং, ২০২১ রিও, ২০২২ ফিনালিসিমা এবং ২০২২ দোহা— আর্জেন্টিনা শেষ যে ক’টা ফাইনাল জিতেছে তাতে অ্যাঞ্জেল রয়ে গেছে। শুধু রয়ে গেছে বললে অনেকটা ক্লিশে শোনাবে, রয়ে গেছে সোনার তুলিতে আঁকা ছবির মত। যেখানে দরকার পড়েছে লোকটা সেখানে খেলেছে। আজ সমগ্র বিশ্ব ওকে নিয়ে কিছু হলেও তো কথা বলছে। এর চেয়ে বড় পুরস্কার আর কিই বা হতে পারতো? আজ আর চিপে গোল আসেনি। আর তার দরকারও নেই।
এই স্ক্যালোনি চোখের সামনে দেখেছিলেন জার্মানির মাঠ থেকে ১-০ অবস্থায় রিংমাস্টার রিকেলমেকে তুলে নিচ্ছেন পেকারম্যান। প্লেয়ার হিসেবে তরুণ মেসির সাথে সেবার আর বিশ্বকাপে এগোনো সম্ভবপর হয়নি। এই স্ক্যালোনি যখন কোচ হয়ে আলবিসেলেস্তে ডাগ আউটে ফিরলেন তখন দেখলেন মারাদোনা নিন্দা করেছেন। এই স্ক্যালোনিকে কোপার ট্যাকটিক্স নিয়ে শুনতে হয়েছিল বিদ্রূপ।
আর আজকে কাপে হাত বুলিয়ে কেঁদে ফেললেন তিনি। প্রথম ম্যাচ থেকে শিক্ষা নিয়ে অপোনেন্ট অ্যানালিসিস করে করে ম্যাচ বাই ম্যাচ ফর্ম পাল্টেছেন। নেদারল্যান্ডসের চালের পাল্টা তিন ব্যাক হোক কিংবা ক্রোয়েশিয়ার মিড করিডর আটকাতে চারটে মিড নামিয়ে দেওয়াই হোক। কালকেও গ্রিজম্যানকে হাতে গোনা বল ছুঁতে দিয়েছেন, ডেঞ্জার জোনে আসার আগেই মেসিকে দিয়ে ফাউল পর্যন্ত করিয়েছেন। এই লিওনেল স্ক্যালোনিকে ভুলবে ফুটবল ফ্যানরা?
টেক আ বাও। আমি তোমাদের রাইভ্যাল জনাব, কিন্তু তা’বলে ফুটবলবোধ এবং সহজাত প্রতিভাদের অস্বীকার করলে আমায় এনকাউন্টার করে দেওয়াই বাঞ্ছনীয়!