একজন নি:সঙ্গ শেরপা

ভাবলেশহীন বিষণ্ণ কিলিয়ান এমবাপ্পে বিধ্বস্ত অবস্থা নিয়ে বসে আছেন ডাগ আউটে। মাঠ জুড়ে যখন আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়রা উচ্ছ্বাসে মেতে উঠেছিল; এক কোণায় তখন বিপর্যস্ত এমবাপ্পে শূণ্যের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। একটা সময় নিজের দশ নাম্বার জার্সি মুখের উপর টেনে নেন তিনি, হয়তো গড়িয়ে পড়া চোখের পানি সামলানোর বৃথা চেষ্টাই করেছিলেন চব্বিশ বছর বয়য়ী এই তারকা।

ভাবলেশহীন বিষণ্ণ কিলিয়ান এমবাপ্পে বিধ্বস্ত অবস্থা নিয়ে বসে আছেন ডাগ আউটে। মাঠ জুড়ে যখন আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়রা উচ্ছ্বাসে মেতে উঠেছিল; এক কোণায় তখন বিপর্যস্ত এমবাপ্পে শূণ্যের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। একটা সময় নিজের দশ নাম্বার জার্সি মুখের উপর টেনে নেন তিনি, হয়তো গড়িয়ে পড়া চোখের পানি সামলানোর বৃথা চেষ্টাই করেছিলেন চব্বিশ বছর বয়সী এই তারকা।

আর্জেন্টিনার বিপক্ষে পরাজয়ের পর কিলিয়ান এমবাপ্পের কথা ভেবে মন খারাপ হয়নি এমন ফুটবল ভক্ত নেই বললে বোধহয় ভুল হবে না। লিওনেল মেসি আর আর্জেন্টিনাকে নিয়েই এখন যত আলোচনা অথচ ফুটবল ইতিহাসের মাত্র দ্বিতীয় খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বকাপের ফাইনালে গোল করেছেন এমবাপ্পে। বারবার পিছিয়ে পড়া ফরাসিদের সমতায় ফেরানোর কাজটাও করেছিলেন তিনি। কিন্তু দিনের শেষে ট্র্যাজিক হিরো হয়েই রইলেন।

২৪তম জন্মদিন পালনের আগেই দ্বিতীয় বারের মত বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হতে পারতেন কিলিয়ান এমবাপ্পে। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে ফিরতে হয়েছে খালি হাতেই; কে জানে আরেকটি সুযোগের জন্য কতটা সময় অপেক্ষা করতে হবে এই তরুণকে। তীরে এসে তরী ডোবার ব্যাপারটি ভুলে যাওয়া সহজ হবে না তাঁর জন্য; যতবারই এই ফাইনালের কথা মনে পড়বে ততবারই হয়তো নিজেকেই দুর্ভাগা ভেবে বসবেন ফরাসি ফরোয়ার্ড।

ফ্রান্সের বিশ্বকাপজয়ী কোচ দিদিয়ের দেশ্যম বলেন, ‘শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত আমাদের বিশ্বকাপ ধরে রাখার দারুণ সুযোগ ছিল, কিন্তু এটা আর হয়নি। দেখুন দল যখন ২-০ গোলে হারবে তখন তাদের প্রশংসা করার মধ্যেই অনুভূতি সীমাবদ্ধ থাকে। আর্জেন্টিনাকে কৃতিত্ব দিতেই হবে কিন্তু আমরা যেভাবে কাছে এসে হেরেছি, যেভাবে হাত ছোঁয়া দূরত্ব থেকে ব্যর্থ হয়েছি সেটি খুবই বেদনাময়।’

পুরো বিশ্বকাপ জুড়ে দারুণ খেলতে থাকা আঁতোয়ান গ্রিজম্যান ফাইনালে ছিলেন ম্লান, একই কথা বলা যায় স্ট্রাইকার অলিভার জিরুডের জন্যও। আক্রমণভাগে নিজের ইন ফর্ম দুই সঙ্গীকে হারিয়ে কিলিয়ান এমবাপ্পে তখন ছিলেন খোলসবন্দী। অন্যদিকে, ফরাসি দুর্গে ততক্ষণে দুইবার ঢুকে পড়েছিল আর্জেন্টাইনরা, ম্যাচের স্কোরলাইন ২-০।

তবে ফাইনালের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে না পারার গ্রিজম্যান, জিরুডদের উঠিয়ে মার্কাস থুরাম, এদুয়ার্দো কামাভিঙ্গা, কিংসলে কোম্যানকে মাঠে নামতেই বদলে যায় দৃশ্যপট। আর্জেন্টিনার ডিফেন্ডারদের একের পর এক পরীক্ষা নিতে শুরু করে ফরাসি আক্রমণভাগ ৷ যদিও কাঙ্খিত গোল আসেনি তখনও।

একটা সময় ঘড়ির কাঁটা পেরিয়ে গিয়েছিল ৭৫ মিনিটের ঘর, আর্জেন্টিনার ভক্ত-সমর্থকরা প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছিল উদযাপনের। কিন্তু তারুণ্যের উদ্দীপনায় ভরা কিলিয়ান এমবাপ্পে বিনা যুদ্ধে হাল ছাড়তে রাজি হননি। স্রেফ হার না মানার এই মানসিকতার জোরেই হয়তো মাত্র ৯৭ সেকেন্ডের ব্যবধানে জোড়া গোল করে দলকে ম্যাচে ফেরান এই পিএসজি ফরোয়ার্ড।

উজ্জীবিত আর্জেন্টিনা অতিরিক্ত সময়ের দ্বিতীয়ার্ধে লিওনেল মেসির কল্যাণে লিড পেয়ে যায় আবারও; কিন্তু এরপর আবার এমবাপ্পের গোল। দুই সুপারস্টার, দুই সতীর্থ, দুই প্রতিদ্বন্দ্বী – মেসি আর এমবাপ্পের বিস্ময়কর পারফরম্যান্সে ফাইনালে কমতি ছিল না রোমাঞ্চের। তাঁরা দুজনেই এদিন দলকে এগিয়ে নিতে নিজের সবটুকু নিংড়ে দিয়েছিলেন।

২০১৮ বিশ্বকাপে চার গোল করে সেরা উদীয়মান ফুটবলার হয়েছিলেন কিলিয়ান এমবাপ্পে। চার বছর পর আট গোল করে গোল্ডেন বুট নিজের করে নিয়েছেন। ১৯ বছরের এমবাপ্পে পরিপূর্ণ ছিলেন প্রতিভা এবং সম্ভাবনায়; আর ২৩ বছরের এমবাপ্পে এখন বিশ্বের বর্তমান সময়ের সবচেয়ে সেরা খেলোয়াড়দের একজন। এমন উন্নতির ধারাবাহিকতা ধরে রাখলে আগামী চার বছর পর কেমন করবেন তিনি, সেটি ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠবে ফুটবলপ্রেমীদের।

নি:সন্দেহে কিলিয়ান এমবাপ্পের ভান্ডারের বড় অস্ত্র তাঁর গতি; তবে এটিই তাঁর একমাত্র অস্ত্র নয়। ড্রিবলিং আর শুটিং, ফিনিশিংয়ের ক্ষেত্রেও অসামান্য পারদর্শীতা রয়েছে এই স্ট্রাইকারের। আর্জেন্টিনার বিপক্ষে দ্বিতীয় গোলটি দেখলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে এই ধারনা।

ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর সময় প্রায় শেষ, লিওনেল মেসিও এগিয়ে যাচ্ছেন শেষের পথে। প্রজন্মের দুই শ্রেষ্ঠ ফুটবলারের শূণ্যস্থান দখল সবটুকু সম্ভাবনাই রয়েছে কিলিয়ান এমবাপ্পের। ২০১৮ সালের বিশ্বকাপে তাঁর মোহনীয় পারফরম্যান্স অঘটন ছিল না, তিনি হারিয়েও যাননি। আগামী এক দশক কিংবা তারও বেশি সময় হয়তো এই তারকাকেই দেখে মুগ্ধ হবেন ফুটবল সমর্থকেরা৷

ফাইনালে হেরে যাওয়ার মাঝে দুঃখবোধ আছে কিন্তু জয়ের কাছাকাছি এসেও হেরে যাওয়া তার চেয়েও যন্ত্রণাময়। কেননা পূর্বেরটা শুধু দুঃখই দেয়, আর পরেরটা দুঃখের পাশাপাশি উপহার দেয় অসহনীয় আক্ষেপ। এই পরাজয় মেনে নেওয়া নি:সন্দেহে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে এসেছে কিলিয়ান এমবাপ্পের ক্যারিয়ারে; নিশ্চিতভাবেই ফ্রান্স চাইবে হৃদয় ভাঙ্গার এই মুহূর্ত আরো শক্তিশালী করে তুলুক তাদের পোস্টার বয়কে।

 

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...