‘লর্ড’ ব্যান্টনার, পাগলাটে এক ক্যারিয়ার

২০১২ সালের ইউরো টুর্নামেন্টের আসরে মুখোমুখি হয়েছিল পর্তুগাল এবং ডেনমার্ক। ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর দলের কাছে ৩-২ গোলে হারলেও ডেনিশরা লড়াই করেছিল সমানে সমানে। একটা সময় ২-০ গোলে পিছিয়ে থাকা ডেনমার্ক সমতায় ফিরেছিল এক পর্যায়ে। তাদের হয়ে জোড়া গোল করেছিলেন স্ট্রাইকার নিকোলাস ব্যান্টনার।

তবে এই পারফরম্যান্সের চেয়ে বেশি নজর কেড়েছিল দ্বিতীয় গোল করার পর ব্যান্টনারের সেলিব্রেশন। দারুণ এক হেডে দ্বিতীয় গোল করার পর নিজের শর্টস অল্প একটু নিচে নামিয়ে আন্ডারওয়্যারের ব্যান্ডের নামটি ক্যামেরাতে দেখান তিনি। এমন সেলিব্রেশনের জন্য এরপর জরিমানা দিতে হয়েছিল তাকে, এছাড়া নিষেধাজ্ঞার শাস্তিও পেয়েছিলেন। 

ঠিক এতটুকুই আসলে নিকলাস ব্যান্টনারের ক্যারিয়ারের হাইলাইটস হয়ে আছে। যতটা পারফর্ম করে খবরের শিরোনাম হয়েছেন তার চেয়ে বেশি হয়েছেন বিতর্ক আর বিব্রতকর পরিস্থিতিতে জড়িয়ে। 

অথচ একটা সময় তরুণ ব্যান্টনারকে ভাবা হতো পরবর্তী সুপারস্টার। আর্সেনালের অ্যাকাডেমিতে বেড়ে উঠা বেন্ডনার ক্লাবটির ২০০৭/০৮ মৌসুমে মূল দলে প্রথম সুযোগ পান। এরপর অনেকটা সময় গানার্সদের হয়েই খেলেছিলেন তিনি।

২০০৯ সালে তাঁর হ্যাটট্রিকেই পোর্তোকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমিফাইনালে জায়গা পেয়েছিল আর্সেনাল। খুব আহামরি না হলেও, মোটামুটি পারফরম্যান্স করতে থাকা নিকলাস ব্যান্টনারের আর্সেনাল অধ্যায়ে বিতর্কের জন্ম হয়েছে বারবার৷ 

ক্লাব সতীর্থ ইমানুয়েল আদেবেয়োরের সঙ্গে মাঠেই তর্কাতর্কিতে জড়িয়ে প্রথমবার কোচ আর্সেন ওয়েঙ্গারের চোখে অপরাধী হন নিকলাস। এছাড়া ২০০৯ সালে প্রতিদ্বন্দ্বী ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে পরাজয়ের দিন তাকে নাইটক্লাব থেকে বেরুতে দেখা যায়। শুধু তাই নয়, সেসময় তার ট্রাউজার গোড়ালিতে ঝুলানো ছিল। 

মাঠের বাইরের এসব বিতর্কে অতিষ্ঠ হয়ে শেষপর্যন্ত সান্ডারল্যান্ড এবং জুভেন্টাসে ধারে পাঠানো হয় এই সেন্টার ফরোয়ার্ডকে। জুভেন্টাসের হয়ে লিগ শিরোপা জিতলেও ব্যক্তিগতভাবে খুব একটা ভাল করতে পারেননি তিনি। 

২০১৩ সালে নিকলাস ব্যান্টনারের ক্রিস্টাল প্যালেস ক্লাবে যাওয়া ভন্ডুল হয়ে যায়। মূলত নতুন স্ট্রাইকার কিনতে না পারায় বেন্ডনারকে ব্যাকআপ স্ট্রাইকার হিসেবে রেখে দিতে চেয়েছিলেন ওয়েঙ্গার। কিন্তু চরম ক্ষিপ্ত ব্যান্টনার স্বয়ং ওয়েঙ্গারের সাথে গালিগালাজ করেন, যার ফলে গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক পুরোপুরি শেষ হয়ে যায়। পরের বছরই ফ্রি এজেন্ট হিসেবে ক্লাব ছেড়ে চলে যান এই ড্যানিশ। 

এরপর দুই বছর উলফসবার্গের হয়ে বুন্দেসলিগায় খেলেছেন নিকোলাস ব্যান্টনার। তাদের হয়ে মোট ৪৭ ম্যাচে ৯ গোল করার পর তিনি চলে আসেন একসময়ের ঐতিহ্যবাহী ক্লাব নটিংহ্যাম ফরেস্টে। যদিও সতেরো ম্যাচ খেলে মাত্র দুই গোল করে নিজেকে সেখানে ব্যর্থ হিসেবেই প্রমাণ করেন এই ফুটবলার। 

তবে নরওয়ের রোজেনবর্গ ক্লাবে ক্যারিয়ারের সবচেয়ে উজ্জ্বল মুহূর্তগুলো কাটিয়েছেন নিকলাস ব্যান্টনার। দলটিকে টানা দুইবার লিগ শিরোপা জিতিয়েছেন, দুইবারই লিগের বর্ষসেরা ফুটবলার হয়েছিলেন। এছাড়া নরওয়েতে প্রথম মৌসুমে ৪৪ ম্যাচে ২৩ গোল করেছিলেন যা তাঁর ক্যারিয়ারে এক মৌসুমে সবচেয়ে বেশি গোল করার রেকর্ড। 

এমন উত্থান-পতনের মাঝেও অবশ্য থেমে থাকেনি নিকলাস ব্যান্টনারের বিতর্কিত সব কার্যক্রম। এমনকি একবার ট্যাক্সি ড্রাইভারের চোয়াল ভেঙে দেয়ার অপরাধে ৫০ দিন জেলে কাটাতে হয়েছিল তাকে। 

ক্যারিয়ারের শেষদিকে স্বদেশী ক্লাব এফসি কোপেনহেগেনের হয়ে কিছু সময় খেলার পর ২০২০ সাল থেকেই ফ্রি এজেন্ট হয়ে ছিলেন নিকলাস ব্যান্টনার। শেষ পর্যন্ত ২০২২ সালের ৩ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে নিজের ফুটবল ক্যারিয়ারের ইতি টানার ঘোষনা দেন ৩৩ বছর বয়সী খেলোয়াড়। 

জাতীয় দল ডেনমার্কের জার্সিতেও বেশ কার্যকর ছিলেন নিকলাস ব্যান্টনার। ২০০৬ সালে অভিষেক হওয়ার পর থেকে ডেনিশদের হয়ে ৮১ ম্যাচ খেলেছেন তিনি। এর মাঝে ৩০টি গোল করেছিলেন। তাছাড়া ২০১০ বিশ্বকাপ এবং ২০১২ সালে ইউরোতেও খেলার অভিজ্ঞতা হয়েছে তাঁর। 

লম্বা, শক্তিশালী, ভার্সেটাইল, হেডিংয়ে দক্ষ, শট নিতে পারদর্শী, পরিশ্রমী ক্রীড়াবিদ এবং একজন নিখুঁত ফিনিশার – সবমিলিয়ে ব্যান্টনার ছিলেন একজন প্রতিভাবান ফুটবলার। কিন্তু বিশৃঙ্খল জীবনযাপনের জেরে সেই প্রতিভার পুরোপুরি প্রতিফলন ঘটেনি তাঁর ক্যারিয়ারে।

তাই এক যুগের বেশি সময় ফুটবল খেলার পরেও বেশকিছু বিতর্কিত ঘটনা ছাড়া স্মরণীয় কোন মুহূর্তের জন্ম দিতে পারেননি তিনি। তবে এসব বিব্রতকর ব্যাপারগুলোর জন্য কেউ ‘লর্ড ব্যান্টনার’-কে মনে রাখলেও রাখতে পারে।  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link