চিত্রপট এক। ২০১৮ এর ১২ অক্টোবর, হায়দ্রাবাদের রাজীব গান্ধী আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে মুখোমুখি সিরিজের দ্বিতীয় তথা শেষ টেস্টে মুখোমুখি ভারত ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ২৬ বছরের মুম্বাইকর পেসার-অলরাউন্ডার শার্দুল ঠাকুরের স্বপ্নপূরণ হতে চলেছে,যে স্বপ্ন থাকে প্রত্যেক তরুণ অ্যামেচার ক্রিকেটারের ক্যারিয়ারের শুরুতে, তেমনই।
ভারতীয় দল টানা ৬টি টেস্ট খেলা শামিকে বিশ্রাম দেওয়ায়, খেলা শুরুর আধঘণ্টা আগে ভারতীয় কোচ রবি শাস্ত্রীর কাছ থেকে ২৯৪ তম ভারতীয় টেস্ট ক্রিকেটার হিসেবে ক্যাপ পাওয়া শার্দুল ঠাকুর তখনও জানতো না খেলা শুরুর মিনিট ১৫ এর মধ্যেই বিষাদ নেমে আসবে। মাত্র ১০ টি বল করবার পরেই কুঁচকির চোট তাকে ওই টেস্টে আর বল করবার অবস্থায় থাকতে দেয়নি।
উমেশ যাদব ও তিন স্পিনারের বদান্যতায় ভারত ১০ উইকেটে জয় লাভ করেছিল।।এরপর অন্যান্য পেসারদের অগ্রগতি ও অন্তর্ভুক্তির সাথে ভারতীয় পেস বিভাগের অন্যতম সেরা সময় দেখে আমরা অনেকেই ভেবেছিলাম আর হয়তো বড়ো মঞ্চে ফেরা হবেনা শার্দুলের।
চিত্রপট দুই। কোভিড কাল পেরিয়ে ১৫ জানুয়ারি, ২০২১। এই কয়েক মাস আগের কথা। অস্ট্রেলিয়ার গাব্যা যার পোশাকি নাম ব্রিসবেন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে গুরুত্বপূর্ণ সিরিজ জেতার লড়াইয়ে টিম পেইনের অস্ট্রেলিয়ার মুখোমুখি রাহানের নেতৃত্বাধীন ভারত।
এমনিতেই কোহলি নেই, তার উপর ভারতীয় দল যেনো একটি ছোটোখাটো হাসপাতাল। ভারতীয় দলে দুই তরুণ স্পিনার অলরাউন্ডার ওয়াশিংটন সুন্দর ও বাঁ-হাতি পেসার নটরাজনের সাথে শিকে ছিড়লো শার্দুলের। এরা সবাই মূল দলের অংশ ছিলেন না, কিন্তু কোভিড ও অন্যান্য কারণে দলের সাথে ছিল, তাতেই মোক্ষলাভ। জীবন এভাবেই ফিরিয়ে দেয়, নতুন ভাবে চেনানোর সুযোগ এনে দেয়।
নাহলে যে চোট তার টেস্ট ক্যারিয়ারকে ধূসর করে দিয়েছিল সেই চোট তার ক্যারিয়ারে নতুন উজ্জ্বলতা এনে দিয়েছে।।সুযোগ পেয়ে চিনিয়েও ছিলেন অসাধারণ ভাবে, ব্যাটে-বলে পারফরম্যান্স দিয়ে। সেই টেস্টে ভারত ইতিহাস রচনা করেছিল, আমরাও তার সাক্ষী থাকতে পেরে গর্বিত। আর এবার ইংল্যান্ড সফরে গিয়ে প্রথম টেস্টেই বলে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে উইকেট তুলেছেন, যদিও আবার চোটের কবলে পড়েছিলেন।
আর ওভালেতো দু’ইনিংসে ব্যাটে অর্ধশতরান, তার মধ্যে প্রথম ইনিংসে দলের খারাপ অবস্থায় উমেশের সাথে আক্রমণাত্মক পার্টনারশিপ। আবার ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় ইনিংসে দুই ওপেনার জমে যাওয়ার পর বার্নসকে ফেরানো কিংবা ভারতের বরাবরের কাঁটা জো রুটের শিকড় উপড়ে ফেলেন। জয়ের অন্যতম কাণ্ডারি হয়ে উঠছেন বারবার।
কিংবদন্তি গারফিল্ড সোবার্স কিংবা রবি শাস্ত্রী যখন প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে এক ওভারে ৬ ছক্কা মারছেন তখনো তাঁর জন্ম হয়নি। কিন্তু, তেমন পরিসর বা ক্ষেত্র না হলেও সেই তালিকাতে এসেছেন ১৫ বছর বয়সে স্বীকৃত স্কুল লিগ খেলবার সময়ে। বোলার হিসেবে পরিচিত পাওয়া শার্দুল চমকে দিয়েছিলেন সবাই ওই ব্যাটিং পারফরম্যান্সে।
তারপর যত দিন গিয়েছে তা আরও ভালো হয়েছে। যার উদাহরণ সেই গ্যাবা টেস্ট কিংবা হালের ওভাল টেস্ট। ঘরোয়া ক্রিকেটে ক্রমাগত ব্যাটে-বলে অসাধারণ করেছেন যা আন্তর্জাতিকেও প্রতিফলিত হচ্ছে। সবেমাত্র চারটি টেস্ট খেলেছেন, তার প্রথমটা বাদ দিলে প্রত্যেকটিতেই ব্যাটে বলে ছাপ রেখেছেন এবং দল বিদেশের মাটিতে জিতেছে,এর থেকে বড়ো ব্যাপার কি হতে পারে, ভবিষ্যত কি হবে তা ভবিষ্যতের ব্যাপার। সোশ্যাল মিডিয়ায় বর্তমানে ট্রেন্ডিং ‘লর্ড শার্দুল সুপ্রিম্যাসি’ কথাটা শুনতে খারাপ লাগছে না।
আসলে নিজের সীমাবদ্ধতা ইনি জানেন এবং সেই হিসেবেই এগিয়ে চলেছেন। তিনি জানেন তাঁর এক্সপ্রেস গতি নেই, নতুন বলে স্যুইং আর পুরানো বলে আঙুল ও বলের গতির হেরফের ভরসা। হয়তো ভারতের মাটিতে টেস্ট হলে আবার মাঠের বাইরে থাকতে হবে, কিন্তু সুযোগ আসবেই, বিদেশের মাটিতে তো প্রবল ভাবেই। আর সীমিত ওভারের ক্রিকেটে বর্তমানে প্রায় নিয়মিত, যা তাঁকে আরও আত্মবিশ্বাসী করবে। আর অসাধারণ টেকনিকের সাথে ভয়ডরহীণ ব্যাটিং অন্যদের থেকে যে বারবার তাকে ভবিষ্যতে এগিয়ে রাখবে একথা এখন বলাই যায়।
কালজয়ী ‘শোলে’ সিনেমার বিখ্যাত ঠাকুরের হাত ছিল না, তাও তাঁর ব্যাক্তিত্ব ও পরাক্রমতা কেমন ছিল আমরা দেখেছি। আমাদের এই ঠাকুরের তো বর্তমানের ‘গোল্ডেন আর্ম’ বর্তমান, তা দিয়েই সুপ্রিম্যাসি বজায় থাকবে এই কামনা করি সবার পক্ষ থেকে।