তাঁর কিছুই নেই! পায়ে জাদু নেই। গুড বয় ইমেজ নেই। এলিয়েন তকমা নেই। এমনকি সবেধন নীলমণি বিশ্বকাপের গোল্ডেন বলও নেই।
তার শুধু একটা জিনিসই আছে। সেই জিনিসটার নাম, অদম্য জেদ! হাল না ছাড়ার এক অজেয় মানসিকতা।
তিনি কিছুই পারেন না!
চান্স ক্রিয়েট করতে পারেন না। কী-পাস দিতে পারেন না। প্রি-এসিস্টও করতে পারেন না। ভুরি ভুরি ড্রিবলিংও করতে পারেন না।
একটা জিনিসই পারেন! সেটার নাম গোল! সেটাই তিনি করে যান। করে যান, করে যান, করেই যান। ও হ্যাঁ, আরেকটা জিনিসও টুকটাক পারেন। সেটার নাম ‘চিয়ারলিডিং’!
ইউরো ফাইনালের বয়স যখন মাত্র ২৪ মিনিট, তখন আঘাত পেয়ে মাঠের বাইরে চলে গেলেন ক্রিস্টিয়ানো। এরপরে কেউই ভাবেনি, বলা ভালো, ভাবতে পারেনি পর্তুগাল ইউরো জিতবে। হয়তো ক্রিস্টিয়ানো নিজেও ভাবেননি। কিন্তু জন্মই যার লড়াই থেকে, তিনি এত সহজেই হাল ছেড়ে দেবেন?
তিনি তাই পায়ে ব্যান্ডেজ নিয়ে ফিরে এলেন মাঠে। খেলোয়াড় হিসেবে নয় অবশ্যই। তাকে তুলে নেয়া হয়েছে মাঠ থেকে, তার বদলে নেমেও গেছেন কোয়ারেজমা। কিন্তু একজন সাবস্টিটিউট খেলোয়াড়ই যে ম্যাচ ঘুরিয়ে দেবেন, তাই বা কে জানত?
হাফটাইমে সতীর্থদের উদ্দেশ্যে বেশ কিছু কথা বলেছিলেন ক্রিস। তার মধ্যে একটা ছিল, আমি নেই। তারপরেও নিজেদের উপরে বিশ্বাস রাখো, এই ম্যাচ আমরাই জিতব। আর ভুলেও লড়াই ছেড়ো না।
খেলার ৭৯ মিনিটে রেনাটো সানচেজের বদলী হিসেবে নামেন এডার লোপেজ। ক্রিসের দেয়া মোটিভেশন হোক, অথবা হোক কোচের ট্যাকটিক্স, তখন পর্যন্ত সমানে লড়ে যাচ্ছে পর্তুগাল। এডার নামার সময়ই ক্রিস তাঁকে বললেন, ‘আমি জানি, এই ম্যাচে তুমি গোল করবে। এই ম্যাচ তুমিই জেতাবে।’
এডারের সেই ম্যাচের আগের ১৩ ম্যাচে গোলসংখ্যা ছিল ০। ক্রিস্টিয়ানো কী ভেবে তাকে এই কথা বলেছিলেন, তা একমাত্র তিনি আর ঈশ্বর জানেন। কিন্তু কীভাবে যেন সেই কথাটাই ফলে গেল ম্যাচের ১০৯ মিনিটে। ডি-বক্সের বাইরে থেকে নেয়া এডারের শট জালে ঢুকে গেল হুগো লরিসকে ফাঁকি দিয়ে!
২০১৩ সালের অক্টোবর মাসে সেপ ব্ল্যাটার বললেন, ‘মাঠে রোনালদো’র আচরণ একজন কমান্ডারের মতো। আর মেসি একজন গুড বয়।’
ফিফার মতো সংস্থার প্রধানের মুখে এরকম কথা ভাবা যায়?
মুখে কিছু বলে লাভ হতো না। কাজে করে দেখাতে হতো। এরকম পরিস্থিতি অবশ্য তার জন্য নতুন ছিল না। বহুবার বহুজন তাকে বাতিলের খাতায় ফেলে দিয়েছে, সেখান থেকেই তিনি উঠে এসেছেন পুরাণের ফিনিক্স পাখির মতো।
এর কয়েকদিনের মাথায় সেভিয়ার সাথে রিয়ালের হোম ম্যাচ। সেই ম্যাচে ক্রিস করেছিলেন হ্যাট্রিক। কিন্তু পেনাল্টি থেকে প্রথম গোল করার পরে যে স্যালুটটা তিনি দিয়েছিলেন, তা সেপ ব্ল্যাটারের মনে থাকবে অনেকদিন। হয়তো আজীবনই!
সে সময় একটা কার্টুন জনপ্রিয় হয়েছিল। ব্ল্যাটারের নগ্ন নিতম্বে চাবুক মারছেন ক্রিস্টিয়ানো। কার্টুনই। নিতান্তই মজা করে করা। কিন্তু কার্টুনটা ব্ল্যাটার দেখুন অথবা না দেখুন, ক্রিসের স্যালুট যে তাকে চাবুকের চাইতেও বেশি আঘাত করেছিল তা আর না বললেও চলে।
অথবা ২০১৫/১৬ মৌসুমের চ্যাম্পিয়নস লিগ কোয়ার্টার ফাইনাল। উলভসবার্গের মাঠে ২ – ০ ব্যবধানে হেরে এলো রিয়াল। রোনালদোর পারফরম্যান্স খুব একটা ভালো ছিল না সেই ম্যাচে। উলভসবার্গের ডিফেন্ডার দান্তে বলে বসলেন, ‘রোনালদোকে সামলানো আমার বাচ্চার চাইতেও সহজ।’
মানুষ নিজের পায়ে কুড়াল মারে, আর ফুটবলার দান্তে কুড়ালে পা মারলেন। তিনি সম্ভবত দান্তে নামের এক কবির লেখা ‘ইনফার্নো’ নামক মহাকাব্য পড়েননি। পড়েননি হয়তো মেরী শেলীর লেখা ‘ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন’ বইটাও। সেমিতে যেতে হলে রিয়ালকে করতে হতো অসম্ভবকে সম্ভব। তা করার দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিলেন ক্রিস্টিয়ানো ‘ইনফার্নো অথবা ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন’ রোনালদো। প্রথম গোল ‘ট্যাপ ইন’এ, দ্বিতীয় গোল দর্শনীয় এক হেডে। আর তৃতীয় গোল? দুর্দান্ত এক ফ্রি-কিক থেকে। ৩ – ২ ব্যবধানে রিয়াল সেমিতে।
বাই দ্য ওয়ে, ট্যাপইন শব্দটাকে কমার মধ্যে রেখেছি দেখেছেন? হা হা হা। দান্তের হয়তো তখন আফসোসের সীমা ছিল না। কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে ভাবছিলেন, ‘কেন যে ক্রিসকে এই কথা বলতে গেছিলাম!’
কিংবা ধরুন, ২০১৬ সালের কথা। ফেব্রুয়ারি মাসে মালাগার সাথে ড্র করেছিল রিয়াল, টেবিল টপারদের থেকে রিয়াল মাদ্রিদ পিছিয়ে ছিল ১০ পয়েন্টে। ফর্মের সাথে ঝুজছিলেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, তার ছবি ছাপিয়ে কাতালান পত্রিকা ‘স্পোর্টস’ ক্যাপশন দিয়েছিল ‘দ্য এন্ড’। এরপরে রিয়াল মাদ্রিদ ১ পয়েন্টের গ্যাপে সিজন শেষ করে এবং চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতে। পর্তুগালের হয়ে ইউরো জেতেন রোনালদো, এবং নির্বাচিত হন উয়েফা প্লেয়ার অফ দ্য সিজন হিসেবে।
অনেকেই দাবি করে থাকেন, ফুটবলে সর্বকালের সেরা কামব্যাক আসলে প্যারিসের সাথে বার্সার অথবা মিলানের সাথে লিভারপুলের কামব্যাক না। সর্বকালের সেরা কামব্যাক মেসির সাথে ৪ – ১ ব্যবধান থেকে ক্রিসের ৫ – ৫ এ নিয়ে আসা। মাঝে মাঝে খুব হতাশ লাগে। মনে হয়, নিজেকে দিয়ে কিছুই হবে না। তখন আমি রোনালদোর কথা ভাবি। মেসির কাছে টানা ৪ বার পরাজয়ের পরেও কীভাবে ধরে রেখেছিলেন নিজেকে! কীভাবে নিজেকে আরও শাণিত করেছেন, হাল না ছেড়ে প্রতিনিয়ত চালিয়ে গেছেন যুদ্ধ। আচ্ছা, বারবার ব্যর্থতার পরে রোনালদো কি কেঁদেছিলেন? পানি পড়েছিল তার চোখ দিয়ে?
অবশ্যই কেঁদেছিলেন। পুরুষ মানুষ কাঁদে না, এটা জগতের সবচেয়ে বড় মিথ্যে কথার একটা। আমরা কেউই তার সেই চোখের পানির খোঁজ রাখিনি। রেখেছিলেন হয়তো ইরিনা। অথবা জর্জিনা। কিংবা তার সবচেয়ে বড় বন্ধু, তার মা দোলোরেস!
ঘরে আরও তিনটে সন্তান, সংসার চলে টেনেটুনে। এই অবস্থায় আরও একটা সন্তান গর্ভে। আমরা সবাই-ই এখন জানি, গর্ভপাতের চিন্তা মাথায় এসেছিল দোলোরেসের। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা না করার সিদ্ধান্ত নিলেন। একটা ছেলে হলো তার, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের সাথে মিলিয়ে তার নাম রাখা হলো রোনালদো।
রোনালদো চলে গেছেন রিয়াল ছেড়ে। আমি আজও তাকে খুঁজে ফিরি বার্নাব্যুর ওই সবুজ গালিচায়, পিছনে ‘৭’ সংখ্যাটা নিয়ে মাঠের বাঁ পাশ দিয়ে তীব্রগতিতে ছুটে যাবেন একজন মানুষ। বাতাসে ভেসে আসবে বল, মাধ্যাকর্ষণকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আকাশ ছুঁতে চাইবেন তিনি। হা করে তাকিয়ে থাকবে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়রা। উত্তেজনায় কেঁপে উঠবেন ধারাভাষ্যকাররাও, ‘ইট’স রোনালদো’ বলে চেঁচিয়ে ওঠার অপেক্ষায় থাকবেন তারা।
তারপর… খুঁজে যাওয়াটাই সার হয়। ইতালি থেকে স্পেনে আসেন না আপনি, আর আসবেনও না কখনো। ক্রুস বা মড্রিচের ক্রস এসে পড়ে না আপনার মাথায়, তার বদলে অন্য কেউ মাথা ছোঁয়ায় বলে, কখনো ছোঁয়ায় না। সাদার বদলে এখন আপনাকে দেখি সাদা-কালো’তে। সুখেই আছেন বেশ! শুধুমাত্র আপনার জন্যই ওই দলটার খেলা দেখা হয়। নাহলে জুভেন্টাসের ব্যাপারে আমার তো কখনো কোন আগ্রহই ছিল না। আপনি হচ্ছেন সেই সাবেক প্রেমিকার মতো, সম্পর্ক শেষ হয়ে যায়, কিন্তু স্মৃতিটুকু রয়ে যায়।
‘আমাকে খোঁজো না তুমি বহুদিন – কতদিন আমিও তোমাকে
খুঁজি নাকো; – এক নক্ষত্রের নিচে তবু – একই আলো পৃথিবীর পারে
আমরা দুজনে আছি; পৃথিবীর পুরনো পথের রেখা হয়ে যায় ক্ষয়,
প্রেম ধীরে মুছে যায়, নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়।
প্রিয় রোনালদো, প্রেম কি আসলেই ধীরে মুছে যায়?
জানতে হলে আরেকবারের জন্য বার্নাব্যুতে আসুন। আসবেন? জীবনবাবুকে ভুল প্রমাণ করার সুযোগ কিন্তু বারবার পাবেন না!