লুইস সুয়ারেজ, পাগলাটে এক প্রতিভা

লুইস সুয়ারেজের প্রসঙ্গ এলেই যেন দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ে গোটা বিশ্ববাসী। আফ্রিকা মহাদেশে তাঁর নামটা পর্যন্ত উচ্চারিত হয় ঘৃণায়, অন্যদিকে, লাতিনের দেশ উরুগুয়েতে তিনি দেবতুল্য। একদিকে বর্ণবাদী আচরণ, প্রতিপক্ষকে কামড়ানোর মতো ঘৃণ্য কাজে নাম জড়িয়েছেন। অথচ একজন ফ্যামিলি ম্যান হিসেবে সুখ্যাতি আছে তাঁর। ডক্টর জেকিল এবং মিস্টার হাইডের ফুটবলীর ভার্সইয়,যেন লুইস সুয়ারেজ। 

উরুগুয়ের স্যাল্টোর নিবাসী সুয়ারেজ পরিবারের সুখ্যাতি ছিল ফুটবলীয় নৈপুণ্যের জন্য। স্যান্দ্রা ডিয়াজ এবং রোদোলফো দম্পতির সাত সন্তানের প্রত্যেকেই স্থানীয় ফুটবল টুর্নামেন্টগুলোতে দাপিয়ে খেলে বেড়ায়। এই দম্পতিরই চতুর্থ সন্তান লুইস আলবার্তো সুয়ারেজ দিয়াজ। বড় ভাইদের সাথে শহরের অলিতে গলিতে খেলতে খেলতেই বেড়ে ওঠা সুয়ারেজের।

কিন্তু লাতিনের আর দশটা পরিবারের মত দারিদ্রের মাঝেই বেড়ে উঠছিলেন সুয়ারেজ। কিন্তু নয় বছর বয়সেই আসে আঘাত, আলাদা হয়ে যান সুয়ারেজের বাবা- মা। পরিবারের বাকিদের সাথে উরুগুয়ের রাজধানী মন্টেভিডিওতে চলে আসেন তিনি। ১৫ বছর বয়স অব্দি ফুটবল খেলার পাশাপাশি রাস্তায় সুইপার হিসেবে কাজ করতেন জীবিকা নির্বাহের আশায়। 

১৪ বছর বয়সে স্থানীয় ক্লাব ন্যাসিওনালের যুবদলে যোগ দেন সুয়ারেজ। ছোটবেলা থেকেই যেন বিতর্কে জড়াতে পছন্দ করতেন তিনি। ১৬ বছর বয়সেই একবার স্থানীয় এক খেলায় রেফারিকে মাথা দিয়ে গুঁতো দিয়ে বসেন। কৈশোর পেরোনোর আগেই কোপা লিবার্তাদোরেসে অ্যাটলেটিকো জুনিয়রের বিপক্ষে অভিষেক ঘটে তাঁর। নিজের প্রথম মৌসুমেই ২৭ ম্যাচ ১০ গোল করে ঘরোয়া লিগ জেতান দলকে। 

এমতাবস্থায় ডাচ ক্লাব গ্রনিনজেনের একদল স্কাউটের নজরে আসেন সুয়ারেজ। অন্যদিকে, সুয়ারেজের ছোটবেলার প্রেমিকা এবং বর্তমান স্ত্রী সোফিয়া বালবি ততদিনে বার্সেলোনাতে থাকতে শুরু করেছেন। ফলে সুয়ারেজও চাইছিলেন যত দ্রুত সম্ভব ইউরোপে যেতে। দুইয়ে দুইয়ে চার মিলে যেতে তাই দেরি হয়নি, ২০০৬-০৭ মৌসুমের শুরুতেই নেদারল্যান্ডসে পাড়ি জমান সুয়ারেজ। 

ইউরোপে নিজের শুরুর দিকে বেশ ভুগতে হয়েছে তাঁকে। ডাচ কিংবা ইংরেজি কোনো ভাষাই জানতেন না সুয়ারেজ, ফলে সতীর্থ কিংবা কোচ কারো সাথেই কথা বলতে পারতেন না। কিন্তু হাল ছাড়েননি সুয়ারেজ, ক্রমেই মানিয়ে নেন সবকিছুর সাথে। কিন্তু সে সময়েও ডিসিপ্লিনারি রেকর্ড বাজে ছিল তাঁর। একবার টানা পাঁচ ম্যাচে চার গোল করার পাশাপাশি তিন হলুদ কার্ড এবং এক লাল কার্ড হজম করেন। 

গ্রনিনজেনে এক মৌসুম কাটানোর পরই তাঁকে দলে ভেড়াতে সাড়ে তিন মিলিয়ন ইউরোর অফার দেয় ডাচ জায়ান্ট আয়াক্স। কিন্তু গ্রনিনজেন তাঁতে রাজি না হওয়ায় আদালতের দ্বারস্থ হন সুয়ারেজ। তবে আদালত তাঁর আবেদন খারিজ করলেও সেদিনই আয়াক্সের সাড়ে মিলিয়নের নতুন অফার গ্রহণ করে গ্রনিনজেন। আয়াক্সে ক্যারিয়ারের নতুন এক অধ্যায় শুরু হয় সুয়ারেজের। 

আয়াক্সের হয়ে প্রথম মৌসুমেই রীতিমতো গোল বন্যায় ভাসান প্রতিপক্ষকে। ৩১ ম্যাচে ২২ গোল করে বনে যান আয়াক্সের সেরা ফুটবলার। পরের মৌসুমে যেন আরো ভয়ংকর তিনি, এবারে ৩৩ ম্যাচে তাঁর গোলসংখ্যা ৩৫। ২০১০-১১ মৌসুমে সুয়ারেজ জড়িয়ে পড়েন বিতর্কে, পিএসভির বিপক্ষে এক ম্যাচে ওট্মান বাক্কালকে কামড়ে দেন তিনি। দুই ম্যাচ ব্যান করার পাশাপাশি জরিমানা করা হয় তাঁকে। ডাচ পত্রিকাগুলো তাঁকে আখ্যায়িত করে ‘আয়াক্সের মানুষ খেকো’ নামে। সুয়ারেজ বুঝে যান আয়াক্স ছাড়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে। 

ইউরোপের বড় বড় ক্লাবগুলো তখন সুয়ারেজে মুগ্ধ। তবে সবাইকে টেক্কা দিয়ে লিভারপুল তাঁকে দলে টানে ২৬ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে। নিজের প্রথম মৌসুমেই ১১ গোল করে সমর্থকদের মন জয় করে নেন এই স্ট্রাইকার। জাতীয় দলেও ছিলেন ফর্মের তুঙ্গে, আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে কোপা আমেরিকা জেতানোর পাশাপাশি টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন তিনি। কিন্তু গোল করা আর বিতর্ক দুটোই সমানতালে এগিয়েছে সুয়ারেজের জন্য।

২০১১ সালের অক্টোবরে তাঁর বিপক্ষে বর্ণবাদী আচরণের অভিযোগ করেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড তারকা প্যাট্রিক এভরা। ডিসেম্বর মাসে এফএ সুয়ারেজকে আট ম্যাচ নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি ৪০ হাজার ইউরো জরিমানা ঘোষণা করে। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে ফিরতি দেখায় এভরার সাথে হাত না মিলিয়ে জন্ম দেন আরেক বিতর্কের। 

পরের মৌসুমে ৩০ গোল করে প্রায় ভুলিয়েই দিয়েছিলেন নিজের জীবনের বিতর্কিত অধ্যায়ের কথা। কিন্তু চেলসির ব্লানিস্লাভ ইভানোভিচকে কামড়ে আবারো সমালোচকদের রোষানলে পড়েন। যদিও রেফারি ম্যাচে তেমন কিছু দেখতে পাননি। কিন্তু ম্যাচ শেষে দশ ম্যাচ ব্যানের সম্মুখীন হন তিনি।

এরপর অবশ্য ফিরে এসেছেন প্রবলভাবে। মেসি – রোনালদোর স্বর্নালী সেই সময়টাতেও সবাইকে পেছনে ফেলে জিতে নেন ইউরোপিয়ান গোল্ডেন বুট। সেই মৌসুমে প্রিমিয়ার লিগে ৩৩ ম্যাচে ৩১ গোল করলেও শিরোপা জেতাতে পারেননি দলকে। এই আক্ষেপটা আজীবন পুড়িয়েছে লিভারপুলকে। অলরেডদের হয়ে তিন বছরে ১১০ ম্যাচে ৬৯ গোল করেন তিনি।  

২০১৪ বিশ্বকাপের শেষে প্রায় ৮০ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে যোগ দেন বার্সেলোনায়। বিশ্বকাপে কিয়েলিনিকে কামড়ানোর অপরাধে ছয় মাস নিষিদ্ধ হলেও তাঁর উপর ভরসা রেখেছিল কাতালান ক্লাবটি। সেই আস্থার প্রতিদানও সুয়ারেজ দিয়েছেন দারুণভাবে।

মেসি এবং নেইমারকে নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর ত্রয়ী। বার্সেলোনাকে ট্রেবল জেতানোর পাশাপাশি চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শিরোপা জিতিয়েছেন দুবার। ২০১৫-১৬ মৌসুমে সব টুর্নামেন্ট মিলিয়ে ৫৯ গোল করে জিতে নেন দ্বিতীয় ইউরোপিয়ান গোল্ডেন বুট। মেসি – রোনালদো জমানায় এই রেকর্ড নেই দ্বিতীয় কারো। বার্সার হয়ে ১৯১ ম্যাচে ১৪৭ গোল করেন এই তারকা। 

২০২০ সালে করোনা মহামারীর কারণে আর্থিক দুরবস্থার শিকার হয়ে সুয়ারেজকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় বার্সেলোনা। যোগ দেন স্পেনেরই আরেক ক্লাব অ্যাতলেটিকো মাদ্রিদে। অ্যাতলেটিকোতে নিজের প্রথম মৌসুমেই ২১ গোল করার পাশাপাশি দলকে জেতান লা লিগার শিরোপা।

চোখে আঙুল রেখে যেন দেখিয়ে দেন তাঁকে ছেড়ে দিয়ে বড় ভুল করেছে বার্সা। গোলের ধারা বজায় রাখেন পরের মৌসুমেও ,১৩ গোল করেন মাদ্রিদের ক্লাবটির হয়ে। এরপর শৈশবের ক্লাব ন্যাশিওনালকে শিরোপা জিতিয়ে বর্তমানে ব্রাজিলিয়ান ক্লাব গ্রেমিওতে আছেন এই তারকা। 

জাতীয় দলেও পারফর্ম করার পাশাপাশি বিতর্কে জড়িয়েছেন বারবার। এডিনসন কাভানিকে নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন ভয়ংকর এক জুটি। ২০১০ সালে নিজের প্রথম বিশ্বকাপেই দ্বিতীয় রাউন্ডে দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে জোড়া গোল করে দলকে তোলেন কোয়ার্টার ফাইনালে। সেখানে তাঁদের প্রতিপক্ষ ছিল টিকে থাকা আফ্রিকার একমাত্র দল, আসমোয়াহ জিয়ানের ঘানা।

১-১ গোলে ড্র থাকা ম্যাচ তখন চলছিল অতিরিক্ত সময়ের শেষ মিনিটে। ফ্রি কিক থেকে স্টিফেন আপ্পিয়াহর হেড গোলবার থেকে হাত দিয়ে ফিরিয়ে সুয়ারেজ জন্ম দেন বিতর্কের। লাল কার্ড দেখানোর পাশাপাশি পেনাল্টির সিদ্ধান্ত দেন রেফারি। কাঁদতে কাঁদতে মাঠ ছাড়েন সুয়ারেজ।

কিন্তু, সবাইকে অবাক করে দিয়ে পেনাল্টি মিস করেন জিয়ান, ডাগ আউটে অশ্রুসিক্ত সুয়ারেজ মূহুর্তের মাঝে ফেটে পড়েন বুনো উল্লাসে। পরবর্তীতে টাইব্রেকারে ম্যাচ জিতে সেমিতে যায় উরুগুয়ে। সেই থেকে গোটা আফ্রিকার শত্রু বনে যান সুয়ারেজ। তাতে তাঁর থোড়াই কেয়ার, দলকে জেতানোই তাঁর জীবনের মূল লক্ষ্য। 

২০১৪ বিশ্বকাপেও জন্ম দেন আরেক বিতর্কের। অবশ্য ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত সেই বিশ্বকাপের খেলারই কথা ছিল না তাঁর। বিশ্বকাপের মাত্র মাস খানেক আগে হাঁটুর অপারেশন করান তিনি। সবাই ধরেই নিয়েছিল বিশ্বকাপ খেলা হচ্ছে না তাঁর। কিন্তু জাতীয় দলের প্রতিনিধিত্ব করার অদম্য নেশায় সুয়ারেজ সব অসম্ভবকে সম্ভব করে দলে ফেরেন।

ফিরেই ইতালির বিপক্ষে বাঁচা মরার ম্যাচে কামড় দেন ইতালির ডিফেন্ডার জর্জিও কিয়েলিনিকে। সেই আক্রমণ থেকেই গোল পায় উরুগুয়ে এবং বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নেয় ইতালি। দুই দিন বাদেই বিশ্বকাপ কমিটি জানায় এবারের বিশ্বকাপে আর খেলতে পারবেন না তিনি, ছয় মাসের জন্য নিষেধাজ্ঞা পান তিনি। ২০২২ বিশ্বকাপে অবশ্য গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নেয় সুয়ারেজের উরুগুয়ে। জাতীয় দলের জার্সিতে ১৩৭ ম্যাচে ৬৮ গোল রয়েছে তাঁর। 

কেবলমাত্র গোল করা নয় বরং নিচে নেমে গোলের সুযোগ তৈরি করতে সুয়ারেজের জুড়ি মেলা ভার। লিভারপুলে তো প্রতিপক্ষকে নাট্মেগ করার জন্য দারুণ জনপ্রিয় ছিলেন তিনি। তাঁর সবচেয়ে বড় গুণ হাল না ছাড়া মানসিকতা। দলের জন্য ম্যাচের শেষ মিনিট পর্যন্ত নিজের সেরাটা দিয়ে লড়ে যেতেন তিনি।

তাঁর সতীর্থ জর্ডান হেন্ডারসন তাঁকে ডাকতেন ‘যোদ্ধা’ নামে। মাঠের পারফরম্যান্স দারুণ হওয়া সত্ত্বেও সুয়ারেজ কখনো ব্যালন ডি অর জিততে পারেননি। ধারণা করা হয় মাঠের বাইরে তাঁর নেতিবাচক কর্মকান্ডের জন্য তিনি কখনো সেভাবে আলোচনায় আসেননি পুরষ্কারের জন্য। 

সেনেকা একবার লিখেছিলেন প্রতিটা প্রতিভাবান মানুষের মাঝে বসবাস করে একজন পাগলাটে। সুয়ারেজ সম্ভবত সেই ধারারই শেষ প্রতিনিধি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link