‘তাঁকে আমি (শচীন) টেন্ডুলকার) ও (ব্রায়ান) লারার সাথে একই ব্রাকেটে রাখি। তবে, তিনজনের মধ্যে ওর টাইমিং ছিল ওই যুগে সবচেয়ে ভাল। সত্যিকার অর্থেই ও ছিল অবিশ্বাস্য এক টাইমার। যদিও, টেন্ডুলকার-রালার থেকে রানক্ষুধা ওর কম ছিল।’
– ইমরান খান যতটা আদর্শ কায়দায় সাঈদ আনোয়ারকে ব্যাখ্যা করেছেন, সেটা হয়তো আর কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। পাকিস্তান ক্রিকেটের সব কিছুর শেষ কথা এই ইমরান খান।
জাদুকরি টাইমিং আর প্লেসমেন্ট ছিল তাঁর ট্রেডমার্ক। ওপেনিংয়ে নেমে দলকে উড়ন্ত সূচনা এনে দিতে জানতেন তিনি। তবে, সেটা পেশির জোরে নয়, দর্শনীয় স্ট্রোকপ্লে’র সুবাদে। তাঁর প্রতিটা শটেই একটা সুপারম্যানিও ব্যাপার ছিল। দুর্দান্ত স্টাইলিশ আর জমকালো ছিল তাঁর ব্যাটিং। কোনো সন্দেহ ছাড়াই সাঈদ আনোয়ারকে নব্বই দশকের সেরা টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানদের একজন হিসেবে বিবেচনা করা যায়।
ওয়ানডে ক্রিকেটে সেঞ্চুরি সংখ্যায় একটা সময় পর্যন্ত তিনি পাল্লা দিয়ে লড়েছেন শচীন টেন্ডুলকারের সাথে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য পারেননি। ক্যারিয়ার শেষে তাই দু’জনের মধ্যে আকাশ আর পাতালের তফাৎ।
শচীনে যেখানে ওয়ানডেতে ৪৯ টি সেঞ্চুরি করেছেন, সাঈদ আনোয়ার থেমেছেন ২০ টিতে। তবুও আজো তিনি ৫০ ওভারের ক্রিকেটে সর্বোচ্চ সেঞ্চুরি করা পাকিস্তানি ব্যাটসম্যান।
সাঈদ আনোয়ার সেই সময়ের ব্যাটসম্যান যখন ক্রিকেটে আজকের মত প্রায়ই ডাবল সেঞ্চুরির দেখা তো দূরের কথা, নিয়মিত কেউ ১৫০-এর ওপরই করতে পারতেন না। সেই সময়ে আনোয়ার ১৯৪ রানের ইনিংস খেলেছিলেন ১৯৪ রানের এক ইনিংস। ১৯৯৭ সালের সেই ইনিংসটি ১৩ বছর পুরনো ভিভ রিচার্ডসনের রেকর্ড ভেঙে দেয়, ওয়ানডের সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত স্কোর হিসেবে টিকে থাকে আরো ১৩ বছর।
সাঈদ আনোয়ার বড় মঞ্চের পারফরমার ছিলেন। তিনটি বিশ্বকাপ খেলেছেন। তাতে তিন সেঞ্চুরি আর তিন হাফ সেঞ্চুরি-সহ করেছেন ৯১৫ রান। গড় ৫৩.৮২।
শুধু বড় মঞ্চ নয়, বড় ইনিংস খেলাতেও সমান পারদর্শী ছিলেন তিনি। এখানে একটা রেকর্ডের কথা না বললেই নয়।
নব্বই দশকে তিনিই একমাত্র ব্যাটসম্যান, যার তিনটি ‘ড্যাডি হানড্রেড’ ছিল দেশের বাইরে। ড্যাডি হানড্রেড হল দেরশোর্ধ্ব রানের ইনিংস। আনোয়ার বাদে দেশের বাইরে ওই সময় একাধিক ড্যাডি হানড্রেড করতে পেরেছেন কেবল ভারতের রবি শাস্ত্রী। আর এর চেয়েও বড় ব্যাপার হল, সেই তিনটি ম্যাচের প্রতিটিতেই জিতেছে পাকিস্তান।
শচীনের সাথে লড়াইয়ে আনোয়ার ছিটকে গেছেন ২০০১ সালে। সেবার আগস্টে আনোয়ারের ছোট মেয়েটা মারা যায়। শোকে কাতর আনোয়ার টেস্ট ক্রিকেটকে বিদায় জানান সে বছরই বাংলাদেশের বিপক্ষে অনুষ্ঠিত হোম সিরিজ শেষে। শেষ টেস্টেও ছিল তাঁর সেঞ্চুরি।
ওয়ানডে ক্রিকেট থেকে নেন বিরতি। মন দেন ধর্ম-কর্মে। এরপর তিনি আর ক্রিকেটে সেভাবে আসেননি বললেই চলে।
পরে অবশ্য ফিরেছিলেন ওয়ানডেতে। ২০০৩ সালের বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে সেঞ্চুরিও করেছিলেন। তবে, এই দফায় আনোয়ার শো খুব বেশিদিন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ফিল্ডিংয়ে দুর্বলতার পুরনোর সমস্যা তো ছিলই। তাই, সেই বছরই ইতি টানেন আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের। ২০০৩ সালের বিশ্বকাপটাই স্টাইলিশ এই বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যানের শেষ আন্তর্জতিক আসর ছিল।
বাইশ গজের সাথে এরপর নিজেকে খুব কমই জড়িয়েছেন। আসলে তিনি প্রচলিত ঘরানার কোনো সাবেক ক্রিকেটার নন। তিনি টিভিতে কথা বলেন না নিয়মিত, পত্রিকায় তাঁর কলাম ছাপা হয় না। তিনি কোচিং করান না, ধারাভাষ্যকক্ষেও নেই।
আজকালকার পাকিস্তানি সাবেকদের মত ইউটিউব চ্যানেলও খোলেননি। ফলে, পাকিস্তানের অন্য সাবেকদের মত তিনি আলোচনায় থাকেন না। মোট কথা ক্রিকেটের সাথে আর তাঁর বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই বললেই চলে।
তিনি নিভৃত জীবন বেছে নিয়েছেন। এজন্যই হয়তো ঘুরেফিরে তাঁর স্মৃতিই বেশি রোমন্থনের ইচ্ছা জাগে।