সানসিরোতে সন্ধ্যা নামে। আরেকটি ম্যাচ শুরু হবে। গ্যালারি ফাঁকা। এ বছর দর্শক নেই কোভিড ১৯-এর জন্য। এখানে আরো অনেক কিছুই নেই। ডিফেন্সে পাওলো মালদিনি নেই,নেই কাফু-আলেসান্দ্রো নেস্তা, গোলবারের নিচে নেই দিদা। মিডফিল্ডে আর দেখা যায় না রিকার্ডো কাকা, গাত্তুসো, আন্দ্রে পিরলো দের। আক্রমনভাগে রবিনহো, রোনালদিনহো,ফিলিপ্পো ইনজাঘি কি আলেসান্দ্রো পাতোরা কেউ-ই নেই।
এতক্ষণ যাঁদের নাম বলা হলো এরা সবাই ছিলো তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী। হ্যাঁ, ঠিক তাই। সে প্রায় ১৫ বছর আগের কথা মিলান শহরে তিনি পা ফেললেন। ইন্টার মিলানের হয়ে খেলতে। এসি মিলান তখন ইউরোপিয়ান ফুটবলে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে। ২০০৩ আর ২০০৭ এ চ্যাম্পিয়ন আর ২০০৫ এ চ্যাম্পিয়ন্স লিগে (সেই মাথা নষ্ট ফাইনাল) রানার্স আপ। ২০০৩-০৪ মৌসুমের এর স্কুডেট্টো!
এসি মিলান! কিছু কিছু নাম আছে ফুটবল রোমান্টিকতার অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর ভেতর একটি নাম এই এসি মিলান! টিভির ভলিউম মিউট করে রাতের আধারে আমরা যখন লুকিয়ে খেলা দেখতাম। সেই ২০০৩ থেকে ২০১০/১২ ওই সময়টাতে, এসি মিলানের দাপট আমরা দেখেছিলাম।
জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচ তখন ইন্টার মিলানে। ২০০৯ এ গেলেন বার্সেলোনায়। সেখান থেকে ২০১০-১১ মৌসুমে ধারে খেলতে মিলানে। সেই বছরই শেষ মেজর কোন ট্রফি জিতলো এসি মিলান। শেষ স্কুদেত্তো। এরপরই নেমে এলো ঘোর অন্ধকার।
অন্ধকার অবশ্য আগেই তাঁর আগমন জানান দিচ্ছিলো। ২০০৭/০৮ এর পর যখন কাকা রিয়ালে পাড়ি জমালেন। অর্থনৈতিক সংকটে আওয়াজ তখন সানসিরোতে। এরপর একে একে নানা ঝামেলা ফ্যাসাদ! তবে ২০১০/১১ এর পর থেকে রোনালদিনহো, থিয়াগো সিলভা, রবিনহো, পাতো সব একে একে মিলান ছাড়তে লাগলেন। ইব্রাও চলে গেলেন। শুরু হলো মিলানের অন্ধকার যুগ! অবস্থা এমন হয়েছিলো একসময়ের হট ফেবারিট এসি মিলান কয়েকবার পৌঁছে গিয়েছিলো একদম রেলিগেশনের প্রান্ত!
নতুন দশকের শুরুতে মিলান আবার জেগে ওঠার ইশারা দিচ্ছে। অভিশাপের দশক হয়তো কেটে গেছে এখন পর্যন্ত তাই মনে হয়। ১৭ ম্যাচ শেষ সিরি ‘এ’র শীর্ষে মিলান। এখনো যদিও বহু রাস্তা বাকি! তবুও বলা যায় ‘ঘুমন্ত দৈত্য’ জাগছে আবার।
আর এই দৈত্য জাগানোর কাজটা করছেন ‘ফুটবলের মান্না দে’ জলাতান ইব্রাহিমোভিচ। ৩৮ বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরলেন মিলানে। বহু দেশ ঘুরে আবার তাঁর ভালবাসার মিলান শহরে। এসে দেখলেন সেই জায়গায় নতুনদের আনাগোনা।
মালদিনির জায়গায় দাঁড়িয়ে আছেন রোমাগনলি, সঙ্গে ফ্রাঙ্ক কেসি-ডেভিড কালাব্রিয়া। মিডফিল্ডে পিরলো-কাকা-গাত্তুসো’র দেখা নেই। সেখানে হাকান কাহানগুলু, স্যান্দ্রো তোনালি, ইসমাইল বেনাখের আর সলমেকার্সদের দৌড়াদৌড়ি। আক্রমণ ভাগে তিনি আশেপাশে তাকিয়ে ইনজাগি-পাতো-রবিনহো দের দেখবেন না। দেখবেন আন্তে রেবিচ, রাফায়েল লিও দের। আর গোলবারের নিচে দেখবেন ইতালিয়ান ফুটবলের নতুন দেয়াল হয়ে ওঠা জিয়ানলুইজি ডোনারমাকে।
বয়স ফুটবলীয় অভিজ্ঞতা সব মিলিয়ে এরা ইব্রাহিমোভিচের সন্তানের মতন। তা তিনি স্বীকার করেছেনও। বলেছেন, ‘আমার ২৭ টি সন্তান! দুইজন সুইডেনে, বাকি ২৫ জন মিলানে।’
এসি মিলানের এই দলটি নিয়ে ফুটবল রোমান্টিকদের স্বপ্ন অনেক। যেন বহুদিন পর হারানো বন্ধু’র দেখা মিলেছে। মিলানের নতুনেরা সেই কিংবদন্তিদের ছুঁতে পারবে কিনা সেই উত্তর সময়ের হাতেই তোলা থাক। আপাতত আমরা দেখছি এক পিতা তাঁর সন্তানদের ‘রূপকথার মতন অতীত’র গল্প শুনিয়ে উদ্বুদ্ধ করছেন।
আর ইব্রাহিমোভিচ হচ্ছেন মিলানের মান্না দে। যিনি গেয়ে যাচ্ছেন – ‘একই সে বাগানে আজ এসেছে নতুন কুঁড়ি, শুধু সেই সেদিনের মালি নেই!’