একজন ক্রিকেটারকে পরখ করার জন্য একটা ম্যাচ কি যথেষ্ট? উত্তরটা অবশ্যই ‘না’। এমন অনেক মহাতারকা আছেন ক্রিকেটে – যাদের ক্যারিয়ারের প্রথম ম্যাচটা ভাল যায়নি। গুটি কয়েক ক্রিকেটার এমনও আছেন, যাদের প্রথম ম্যাচ দারুণ যাওয়ার পরও বড় তারকার তকমা নিয়ে ক্যারিয়ার শেষ করতে পারেননি।
এর মধ্যেও এক দল দুর্ভাগা আছেন, যাদের সংখ্য আসলে খুবই কম। তারা ক্যারিয়ারের প্রথম ম্যাচে সুযোগ পেয়ে পারফর্ম করলেও আর কখনোই সুযোগ পাননি। প্রতিভার খনি পাকিস্তানের ক্রিকেটে তেমনই এক আক্ষেপের নাম মনসুর আমজাদ।
একটা সময় ছিল, যখন লেগ স্পিনে মনসুর আমজাদকে পাকিস্তানের নেক্সট বিগ থিঙ মনে করা হত। ২০০৪ সালে বাংলাদেশের মাটিতে অনূর্ধ্ব -১৯ বিশ্বকাপের শিরোপা জয় করে বাংলাদেশ। সেই দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন লেগস্পিনার মনসুর।
বিশেষ করে, তাঁর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখেছিলেন বব উলমার, পাকিস্তানের এক সময়কার কোচ। প্রয়াত এই প্রোটিয়া কোচের কথা খানিকটা সত্যও হয়েছিল। ২০০৫-০৬ মৌসুমে ইংল্যান্ড একাদশের বিপক্ষে এক প্রস্তুতি ম্যাচে পাঁচ উইকেট নিয়ে আলোচনার জন্ম দিয়েছিলেন মনসুর।
তখনই বোঝা যাচ্ছিল জাতীয় দলে তাঁর খেলাটা স্রেফ সময়ের ব্যাপার। ২০০৮ সালে অপেক্ষার অবসান হল। বাংলাদেশের সেবারের পাকিস্তান সফরে একটাই টি-টোয়েন্টি ম্যাচ ছিল। সেই দলে ডাক পান মনসুর আমজাদ। বয়স তখন ১৯ কি ২০।
স্বপ্নের মত এক অভিষেক। বাংলাদেশের বিপক্ষে সেই ম্যাচে একটু দেরিতেই বোলিংয়ে আসেন তিনি। ১৬ তম ওভারে তাঁর হাতে বল তুলে দেন অধিনায়ক শোয়েব মালিক।
পাকিস্তানের ২০৩ রানের জবাবে বাংলাদেশ তখন ধুঁকছে। সাত উইকেট হাতে নিয়ে বোর্ডে জমা হয়েছে মাত্র ৯৮ রান। ক্যারিয়ারের মাত্র দ্বিতীয় ডেলিভারিতেই ফেরালেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদকে। এগিয়ে এসে খেলতে গিয়ে স্ট্যাম্পিংয়ের ফাঁদে পড়েন রিয়াদ।
শেষ দুই বলে তিনি সাজঘরে পাঠান মাশরাফি বিন মুর্তজা ও শাহাদাত হোসেন রাজিবকে। মাশরাফি ডাউন দ্য ট্র্যাকে এসে খেলতে গিয়ে লং অফে উমর গুলের হাতে ক্যাচ তুলে দেন। পরের বলে বোল্ড হন রাজিব। বাংলাদেশ ১০১ রানে অল আউট। পাকিস্তান জিতে ১০২ রানের বিরাট ব্যবধানে।
কে জানতো, সেই একটা ওভারই মনসুর আমজাদের ক্যারিয়ারের একমাত্র ওভার হয়ে থাকবে। এপ্রিলের সেই টি-টোয়েন্টি ম্যাচে ভাল করার সুবাদে জুন মাসে ঘোষণা করা এশিয়া কাপের দলে ডাক পান তিনি। সেখানে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে একটা ম্যাচ খেলেন। তাতে, আট ওভার বোলিং করে ৪৪ রান দিয়ে নেন একটি উইকেট।
এরপর থেকেই শুরু হয় আমজাদের অপেক্ষার প্রহর। আঙুলের ইনজুরিতে তাকে লম্বা সময়ের জন্য থাকতে হয় মাঠের বাইরে। ইনজুরি কাটিয়ে ২০১০ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তখন এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘সবারই দেশের হয়ে খেলার স্বপ্ন থাকা। আমার সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। আমি টি-টোয়েন্টি অভিষেকে বাংলাদেশের বিপক্ষে একমাত্র ওভারে তিন উইকেট নিয়েছি। ওয়ানডেতে অভিষেকে করাচিতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৪৪ রান দিয়ে এক উইকেট নিয়েছি। আমার যা সামর্থ্য তাতে আমি আবারও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খেলার যোগ্যতা রাখি। আশা করি এপ্রিল-মে মাসে ক্যারিবিয়ানে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপটা খেলতে পারবো।’
তবে, সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি মনসুরের, না সেই বিশ্বকাপে, না আর কোনো বিশ্বকাপে, না আর কোনো ফরম্যাটের কোনো আন্তর্জাতিক ম্যাচে। টি-টোয়েন্টিতে সবচেয়ে কম রানে তিন উইকেট নেওয়ার কীর্তিটা আজও মনসুর আমজাদের দখলে। বোলিং গড় ১.০০, এটাও ইতিহাসে সর্বনিম্ন। এই পারফরম্যান্সই হয়তো তাঁর আক্ষেপটা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
পাকিস্তানের ঘরোয়া ক্রিকেট তিনি খেলেছেন ২০২০ সাল পর্যন্ত। এর মধ্যে লিস্টারশায়ারের হয়ে ইংলিশ কাউন্টি ক্রিকেটও খেলেছেন। লেগ স্পিনার থেকে কালক্রমে বেশ কার্যকর একজন অলরাউন্ডারও বনে যান। প্রায় আড়াইশর মত উইকেট আর পাঁচ হাজারের ওপর রান নিয়ে শেষ করেন প্রথম শ্রেণির ক্যারিয়ার। খেলোয়াড়ি জীবন শেষ করে আক্ষেপ বুকে নিয়ে থিতু হয়েছেন কোচিংয়ে।
পাকিস্তানের ক্রিকেট থেকে মনসুর আমজাদ নামটা হারিয়েই গিয়েছে। হুট করে তাঁর নাম শুনলে তাঁকে মনে না পড়াটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার যেন, তবে একটু এদিক সেদিক হলেই হতে পারত তার উল্টোটা!