মারাকানাজো ও মিনেইরাজো, বেদনার দুই দিগন্ত

২০১৪ সালের আট জুলাই। এই দিনে জার্মানির কাছে ৭-১ গোলের লজ্জ্বায় ডুবেছিলাম! সেই বেলো হরিজন্তে ট্রাজেডি কি মারাকানা ট্রাজেডির চাইতেও বড়!

২০১৪ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে জার্মানির কাছে ৭-১ গোলে হারা ব্রাজিলের ম্যাচ সেলেসাওদের ইতিহাসে লেপ্টে গেছে একদম, যেই কালো দাঁগ কোনদিনই মিশবে না! ফুটবলের সবচেয়ে সফল দল ব্রাজিল, কিন্তু সেই ব্রাজিলিয়ানরাও জানেন এই ইতিহাস আর পাল্টানো যাবে না। যত বার বিশ্বকাপ দরজায় কড়া নাড়বে ততবার ঘুরে ফিরে আসবে ওই গল্প। যত বার জুলাইয়ের আট তারিখ আসবে ততবারই ঘুরে ফিরে আসবে ওই গল্প!

তবে এই মিনেইরোজোর চাইতেও বড় দু:সময় দেখেছে ব্রাজিলবাসী! মারাকানাজোর কুখ্যাত সেই ইতিহাস আজও ভুলতে পারেনি ব্রাজিল; এমনকি পাঁচ পাঁচটা বিশ্বকাপ জেতার পরও না!

১৯৫০ সালের ১৬ জুলাই মারাকানা সাক্ষী ছিল নিজেদের সবচেয়ে বড় ট্রাজেডির! প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ আয়োজনের সুযোগ পায় সাম্বাখ্যাত ল্যাটিন ফুটবল পরাশক্তি ব্রাজিল, ১৩ দলের বিশ্বকাপে রবিন রাউন্ড সিস্টেমে কোনো ফাইনাল ছিল না, সবাই সবার মুখোমুখি হওয়ার পর সর্বোচ্চ পয়েন্ট পাওয়া দলকে চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করা হবে।

শেষ রাউন্ডের ব্রাজিল বনাম উরুগুয়ে ম্যাচটি অলিখিত ফাইনালে রূপ নেয়। শিরোপা জয়ের জন্য উরুগুয়ের ব্রাজিলকে হারানো ছাড়া কোনো বিকল্প ছিল না। অন্যদিকে, শুধুমাত্র হার এড়ালেই প্রথমবারের মতো ঘরের মাঠের দর্শকের সামনে জুলে রিমে ট্রফি উঁচিয়ে ধরতে পারতো ব্রাজিল।

রাউন্ড রবিনের শুরুর দিকেই দুই দিলের পার্থক্যটা টের পাওয়া যায়, এগিয়ে থাকা ব্রাজিল একটু বেশিই উচ্চাভিলাষী ছিল সেই দিন! ম্যাচের আগেই সংবাদমাধ্যমগুলোর ব্রাজিলকে অগ্রিম চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করে বড় বড় শিরোনাম তৈরি, গোল্ড মেডেলগুলোতে ব্রাজিলের খেলোয়াড়দের নাম খোদাই করে রাখা, ফাইনাল শুরু হওয়ার আগের দেওয়া বক্তব্যে রিও ডি জেনেইরোর মেয়রের ব্রাজিলকে ‘চ্যাম্পিয়ন’ সম্বোধন করা কিংবা ম্যাচ শেষে অভিবাদন জানানোর জন্য ‘Brasil os Vencedores’ নামে একটি গান রচনা করা – সবই সেই উচ্চাভিলাষীতার ফল!

মাঠে উপস্থিত সেইদিন প্রায় ২ লাখ দর্শক! রিও ডি জেনেইরোর রাস্তায় সাজ সাজ রব। সাম্বা নাচে তখন উত্তাল পুরো ব্রাজিল।

খেলার দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে গোল পায় ব্রাজিল, ৬৬ মিনিটে তা শোধ করে উরুগুয়ে! ম্যাচ শেষ হওয়ার ১১ মিনিট আগে পুরো ব্রাজিল জুড়ে পিন পতন নিরবতা; ব্রাজিলের জালে বল জড়ান আলসিডেস ঘিগিয়া, ব্রাজিল গোলকিপার বারবোসার পায়ের নিচ দিয়ে নেওয়া লো শটে তিনি এনে দেন উরুগুয়ের বহু আরাধ্য গোলটি।

‘সাইলেন্স ইজ গোল্ডেন’ এর পারফেক্ট উদাহরণ হয়ে জনসমুদ্রের গর্জন তখন ‘ঘিঘিয়া’ ঝড়ের পরে একদম নিস্তব্ধ। সঙ্গে পুরো দেশেও সেই একই অবস্থা। শেষ বাঁশি বাজার পর হার সহ্য করতে না পেরে অনেকেই লাফিয়ে পড়েছিল মারকানার ছাদ থেকে। কেউ কেউ আত্নহত্যাও করে বসে!

পরের কয়েকদিন শহরের প্রতিটি ঘরের জানালা বন্ধ ছিল। রাস্তা দিয়ে হাঁটলে চাপা কান্নার আওয়াজ শোনা যেত। যেন, প্রত্যেক ব্রাজিলিয়ান তাদের সবচেয়ে কাছের মানুষটিকে হারিয়েছে। সব সম্মান ভূলুণ্ঠিত হওয়ার নির্মম বেদনা কেউই সইতে পারেনি। উৎসবের মুখরতা থেকে ব্রাজিলিয়ানদের আশ্চর্য পতন ছুঁয়ে যায় পুরা দেশকে।

সেদিনের গোলরক্ষক ফাইনালের পর থেকে এক রকম নি:গৃহীতই ছিলেন সারাদেশে একদম মৃত্যুর আগ পর্যন্ত! পুরো জাতির এই শোক কাটিয়ে উঠতে অনেক সময় নিয়েছিল ব্রাজিল! কিন্তু ৭০ বছর পরেও সেই দুঃস্মৃতি কাঁদিয়ে বেড়ায় অনেককে!

২০১৪ সালে গুণে গুণে সাত গোল খাওয়া ব্রাজিলের নিকটতম ইতিহাসে একদম দগদগে! জার্মানি, কিংবা বিশ্বকাপ, কিংবা প্রতি ক্যালেন্ডারের জুলাইয়ের আট তারিখ আসলেই নিন্দুকেরা মেতে ওঠেন অদ্ভুত মজা নেওয়ায়, আর ব্রাজিল সেদিনের সেই দগদগে স্মৃতিকে সঙ্গী করেই নিজেদের সফলতার পারদকে আরো অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে নেওয়ার প্রতিজ্ঞায়!

ইতিহাস পরাজিত সৈনিকদের মনে রাখে না, তবে পরাজিত হয়ে আবারো ঘুরে দাঁড়িয়ে যুদ্ধজয়ীদের মনে রাখে আলাদাভাবে। সেই ইতিহাসের সবচেয়ে সেরা ও সমৃদ্ধশালী ফুটবল দলটির নামই তো ব্রাজিল। মারাকানা ট্রাজেডির ৮ বছরের মাথায় ব্রাজিল নিজেদের প্রথম সফলতা অর্জন করে।

৪ বছর পরেই দ্বিতীয়টি, এক টুর্নামেন্ট পরেই জুলে রিমে একদম নিজেদের করে নেওয়া! এরপরে ব্রাজিল আরো ২ বিশ্বকাপ জিতেছে, জিতেছে অসংখ্য ট্রফি! কিন্তু মারাকানাজোর সেই ভয়াবহ অধ্যায় তাদের ইতিহাসের অংশই ছিল সব সময়!

সেলেসাওদের ইতিহাসই তো ঘুরে দাড়ানোর। এবার তো ব্রাজিলের পিঠ একদম দেয়ালে গিয়ে ঠেকে যায়। ঘুরে দাড়াতে হবে। নিজেদের সম্মান কে পুনুরুদ্ধার করতে হবে। সেলসাওদের ইতিহাসই এমন। মেঘ দেখে কেউ করিসনে ভয়, আড়ালে তার সুর্য হাসে। ফুটবলের জন্মলগ্ন থেকেই ব্রাজিল ঘুরে দাড়াতে জানে।

ইতিহাসের সবচেয়ে সফল দলটির সফলতার শুরুই তো খাঁদ থেকে উঠে দাঁড়ানো গল্পে, ভয়ংকর অন্ধকার ঠেলে আলোর দিশারী হয়ে নিজেদেরকে বারেবারে সেরা প্রমাণ করার গল্পে। খেলা হচ্ছে পৃথিবীর আদিম যুদ্ধকলার একটি শৈল্পিক রূপ। এখানে জেতার জন্যই সব আয়োজন। জিতলে সবাই বাহবা দিবে আর হারলে দুয়ো। যুগে যুগে ব্রাজিল এই দুয়ো থেকেই পেয়েছে জেতার প্রেরণা, সামনে এগিয়ে গিয়ে নতুন করে শুরু করার উদ্যমশীল মনোবল।

মিনেইরোজো নামক কালো অধ্যায় ব্রাজিলের ইতিহাসে কালিমা হয়ে থাকবেই, এইটা যেমন সত্য; তেমনই ইতিহাস থেকে প্রেরণা নিয়েই ব্রাজিল সেই কালিমা সঙ্গী করেই নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করবে বারেবারে, চিরকাল!
নিন্দুকেরা তো কত কথাই বলবে, অথচ নিজেদের ইতিহাসের কালো অধ্যায়কে সাথে নিয়েই ফুটবল নামক গোলক ধাঁধার ইতিহাসে সবচেয়ে সফল দলটির নাম ব্রাজিল।

বেল হরিজন্তে ট্রাজেডির সাত বছরের মাথায় আরেক বার সুখের ছোঁয়ায় ভাসাবে কি প্রিয় দল?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link