আমার ম্যারাডোনা কিংবা মারাদোনা

আজ ঘুম থেকে জাগতে খানিক দেরিই হলো। ল্যাপটপ অন করতেই আমার নিউজ ফিডে কন্যা নদীর একটা স্ট্যাটাস ভেসে উঠলো। নদী লিখেছে –

I learned the name Maradona from my dad. My earliest memory of football is watching Maradona on TV with my dad and have tea with him as he explained how the game works. That was the beginning of our friendship.

Rest in peace, legend. Thank you for the memories.

অটোয়ায় আমার মধ্যাহ্নটা কেমন বিষণ্ণ হয়ে উঠলো!

আমার ফুটবলপ্রেমী হয়ে ওঠার পেছনে ছিলেন একজনই, তিনি মারাদোনা। দিয়েগো মারাদোনা। ফুটবল ঈশ্বর মারাদোনা।

আমার অনি:শেষ প্রেরণার হিমালয় পর্বত ছিলেন মারাদোনা। ১৯৮৬ সালের পর থেকে শয়নে স্বপনে জাগরণে আমি হতে চেয়েছি ‘ছড়ার মারাদোনা’। তাঁর অনুশীলন, তাঁর সাধনা, তাঁর ম্যাজিক তাঁর সাফল্য আমাকে প্রাণিত করেছে মুহূর্মুহু। সাফল্যের চূড়োয় যেতে হলে যে নিরবচ্ছিন্ন সাধনায় নিজেকে শানিত করতে হয় প্রতিনিয়ত, সেটা আমাকে শিখিয়েছেন মারাদোনা। প্রবল বিরুদ্ধ মাঠে কী করে লড়ে যেতে হয়, নিজেকে টিকিয়ে রাখতে হয় সেই মন্ত্রটা আমি শিখেছি মারাদোনার কাছ থেকেই।

আজ একটু আগে, আমার প্রধানপ্রেরণাসঞ্চারী সেই নায়কের প্রস্থান ঘটেছে পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চ থেকে। অটোয়ার বরফ আচ্ছন্ন ঝাপসা মধ্যাহ্নটা আমার কেমন বিষণ্ণ হয়ে উঠেছে তাই।

অপ্রতিরোদ্ধ মারাদোনার সেই অনন্য গোলটা -মধ্যমাঠ থেকে নিজের পায়ে বলটা নিয়ে একের পর এক ছয়জন খেলোয়াড়কে ডজ দিতে দিতে গোল পোস্টের কাছে পৌঁছে যাওয়া এবং গোলকিপারকে পরাভূত করে বলটা গোলপোস্টে ঢুকিয়ে দেয়ার বিস্ময়কর সেই দৃশ্যটা পৃথিবীর মানুষ কোনোদিন ভুলতে পারবে? পারবে না। আমিও ভুলিনি। শতাব্দীর সেরা গোল ছিলো সেটা।

সেই অবিশ্বাস্য লড়াই, সেই বিস্ময়কর নৈপূণ্য, ফুটবলের ওপর দুই পায়ের সেই অভূতপূর্ব নিয়ন্ত্রণ, এইটুকুন শরীরের সেই অপরূপ গতি আর ছন্দমাধুর্য, সমস্ত প্রতিবন্ধকতাকে পাশ কাটানোর সেই ক্ষিপ্রতা, অপ্রতিরোদ্ধ সেই ম্যাজিক মুগ্ধতায় ভাসিয়ে নিয়েছিলো আমাকে। সেই মুগ্ধতা ছিলো অবিনাশী। যা কখনোই ফুরোবার নয়। হারাবার নয়।

তিনি হয়ে উঠেছিলেন আমার প্রধানপ্রেরণাসঞ্চারী নায়ক।

মারাদোনা আমার সমবয়েসী। আমার ষাট। মারাদোনারও ষাট। বেঁটেখাটো মানুষ আমি। তাঁর শারীরিক উচ্চতার ক্ষেত্রেও মিল রয়েছে আমার। আমাদের দু’জনার উচ্চতাও প্রায় অভিন্ন। তাঁকে লড়তে হয়েছে তাঁর থেকে বেশি উচ্চতা সম্পন্ন খেলোয়াড়দের সঙ্গে।

অপেক্ষাকৃত কম শারীরিক উচ্চতার কারণে খুব গোপন চাপা একটা হীনমন্যতাবোধ আমাকে আক্রান্ত করতো ছেলেবেলায়। তখন আমার গোপন দীর্ঘশ্বাসটি ছিলো এরকম – শারীরিক উচ্চতায় আমি আর মাত্র কয়েক ইঞ্চি লম্বা হলে কী এমন ক্ষতি হতো পৃথিবীর!

আমি তখন পৃথিবীবিখ্যাত সফল কিন্তু শারীরিক উচ্চতায় ছোটখাটো গড়ন এমন সব মানুষের সন্ধান করতাম। আমার দুঃখ মোচনে এগিয়ে আসতেন চার্লি চ্যাপলিন। এগিয়ে আসতেন পাবলো পিকাসো।

এইক্ষেত্রে আমার সর্বশেষ আনন্দময় অবলম্বন ছিলেন দিয়েগো মারাদোনা।

২.

একটা ডকুমেন্টারিতে মারাদোনার প্র্যাকটিস দেখেছিলাম। কী অমানুষিক পরিশ্রমই না করেন তিনি! একটা দৃশ্য মনে আছে -একটা ফুটবলকে মাটির সঙ্গে বাম্প করিয়ে সেই বলটার ওপর দিয়ে হরিণ-ছন্দে লাফিয়ে লাফিয়ে তিনি একবার সামনে যাচ্ছেন একবার পিছিয়ে আসছেন। একবার ডানে যাচ্ছেন একবার বাঁয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার–দুই পায়ের মাঝখানে থাকা বলটা একই গতিতে মাটিতে ড্রপ খেয়ে খেয়ে একই উচ্চতায় উঠছে আবার নামছে। কিন্তু বলটা কখন তাঁর পায়ে টাচ করছে সেটা ঠাহর করা যাচ্ছে না।

কী বিস্ময়কর ক্ষমতা রে বাবা মানুষটার!  কী অবিশ্বাস্য নিয়ন্ত্রণ রে বাবা তাঁর দুই পায়ের!

৩.

এক সময় ইত্তেফাকে, বার্তা সম্পাদক গোলাম সারওয়ার এবং পরবর্তীতে দিলু খোন্দকারের কারণে আমাকে ছড়া লিখতে হতো ইত্তেফাকের বিশেষ ক্রীড়া আয়োজনে। ট্যাবলয়েড ফুল পেজ ছড়াও লিখেছি আমি মারাদোনাসহ বিশ্বকাপ ফুটবলের তখনকার স্টার ফুটবলারদের নিয়ে। খুব অধিকারমাখা কণ্ঠে দিলু ফোন করতো। এমনও হয়েছে ইত্তেফাকের টেবিলে বসেই প্রীতিভাজন দিলুকে লিখে দিয়েছি একাধিক বিশ্বকাপের ছড়া। মারাদোনার ছড়া।

৪.

বাবা-মা’র সাথে ম্যারাডোনা

ম্যারাডোনার পা আর ঈশ্বরের হাত–এই দুইয়ের অলৌকিক সমন্বয়ে ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলের সেই বিস্ময়কর গোলটা নিয়ে এখনও শেষ হয়নি বিতর্ক। স্বয়ং মারাদোনাই বলেছেন গোলটা তাঁর পা থেকে হয়নি। গোলটা Hand of God এর।

এই ম্যাচের দ্বিতীয় গোলটা (মধ্য মাঠ থেকে একে একে ইংল্যাণ্ডের ছয় ছয়জন খেলোয়াড়কে পাশ কাটিয়ে করা গোলটা) ফুটবলের ইতিহাসে  ‘গোল অব দ্য সেঞ্চুরি’ অভিধায় অভিষিক্ত।

পরাজয়ের পর বিশ্বকাপের মাঠে মারাদোনার কান্নার দৃশ্য দেখেছিলাম টেলিভিশনে–দুইবার। একবার জার্মানীর সঙ্গে হেরে যাবার পর। মাঠের বিশাল স্ক্রিনে কান্নার সেই দৃশ্যটা ক্লোজ শটে দেখানো হচ্ছিলো। মারাদোনার সঙ্গে সেদিন কেঁদেছিলো পুরো মাঠ, মাঠের দর্শক এবং মাঠ ছাপিয়ে সারা পৃথিবীর মানুষ। পৃথিবীর সেই মানুষদের একজন ছিলাম আমিও।

৫. 

অপ্রতিরোধ্য মারাদোনাকে ট্যাকলের নামে কতো আক্রমন যে তাঁকে করা হয়েছে মাঠে! একসঙ্গে কয়েকজনের সম্মিলিত আক্রমনে বারবার ভূপাতিত করা হয়েছে মারাদোনাকে। কিন্তু ফের উঠে দাঁড়িয়েছেন অপারাজেয় মারাদোনা। ক্ষিপ্র গতিতে ফের ঢুকে পড়েছেন প্রতিপক্ষের গোলপোস্টে বল সমেত।

প্রতিটা ম্যাচেই মারাদোনার প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়রা অবিরাম ফাউল করেছেন তাঁকে প্রতিহতের নামে। এমনও হয়েছে এক খেলায় তাঁর ওপরে ৩০টা ফাউল করেছে প্রতিপক্ষ। যা ফাউলের ইতিহাসের ক্ষেত্রে বলা যায় বিশ্ব রেকর্ড।

৬.

বেহিসেবি প্রতিভাবানরা নিজের একান্ত ব্যক্তি জীবন সম্পর্কে প্রায়শ: বিধ্বংসী স্বভাবের হয়ে থাকেন। মারাদোনাও ছিলেন সেরকম আত্মবিধ্বংসী। নিজের জীবনটাকে বারবার এলোমেলো করে দিয়েছেন। বিপুল বিক্রমে নিজেকে টেনে নিয়ে গেছেন ধ্বংস আর বিদ্রুপের এর দ্বারপ্রান্তে।

১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপে ডোপ টেস্টের মুখোমুখি হতে হয় মারাদোনাকে। এবং ডোপ টেস্টে ধরা পড়েন তিনি। তাঁর বিরুদ্ধে মাদক গ্রহণের অভিযোগ আনা হয়। এ কারণে কঠিন শাস্তিও পেতে হয় তাঁকে। বাদ পড়েন তিনি বিশ্বকাপ থেকে।

ক্ষ্যাপাটে আচরণের কারণে প্রচুর নিন্দাও কুড়িয়েছেন একজীবনে এই ফুটবল ঈশ্বর।

৭.

ফিদেল কাস্ত্রোর অসম বয়েসী প্রিয় বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন মারাদোনা।

মাদকের কারণে মারাদোনার জীবনে নেমে এসেছিলো ঘোর অমানিশা।

এক সাক্ষাৎকারে মারাদোনা বলেছিলেন -‘আর্জেন্টিনার হাসপাতালগুলো আমার জন্য দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল, ওদের ওখানে আমার মৃত্যু হোক, এই ঝুঁকি ওরা নিতেই চায়নি। সেই সময় ফিদেল ক্যাস্ট্রো কিউবার দরজা খুলে দিয়েছিলেন আমার জন্য।’

কিউবায় ক্যাস্ট্রোর অতিথি হয়ে খুব আদর আর যত্নে ছিলেন মারাদোনা।

মাদকের নীল নেশায় জড়িয়ে নিজেকে প্রায় খুনই করে ফেলেছিলেন মারাদোনা। মারাদোনাকে বাঁচানোর আশা একরকম ছেড়েই দিয়েছিলেন চিকিৎসকেরা। তখন মারাদোনার জীবনে দেবদূত হয়ে এসেছিলেন ফিদেল কাস্ত্রো।

বন্ধু মারাদোনাকে মাদক থেকে সরিয়ে আনতে বিশাল অবদান রেখেছিলেন ক্যাস্ট্রো। মাদকের ভয়াল ছোবলে ভয়াবহ রকম মুটিয়ে যাওয়া মারাদোনাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে একজন স্পেশাল ফিজিক্যাল ইন্সট্রাকটরকে নিয়োগ করেছিলেন ক্যাস্ট্রো। এবং ইনস্ট্রাকটরের কঠিন শাসন আর ঘাম ঝরানো অমানুষিক অনুশীলনের নির্দেশ পালনের পরিশ্রম শেষে শরীর থেকে বাড়তি মেদ আর মাদকের নেশা তিনি ঝরিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছিলেন অনেকটাই।

বলতে গেলে মারাদোনার দ্বিতীয় জন্ম হয়েছিলো ক্যাস্ট্রোর কল্যাণে। আর তাই মারাদোনা কাস্ত্রোকে বলতেন তাঁর ‘দ্বিতীয় জনক’। মারাদোনা ছিলেন একজন বাম পায়ের খেলোয়াড়। ডান পায়ে গোল করার সুযোগ থাকলেও তিনি ব্যবহার করতেন বাম পা। মারাদোনা তাঁর বিখ্যাত বাম পায়ে ফিদেল ক্যাস্ট্রো আর ডান হাতে চে গুয়েভারার ট্যাটুপ্রতিকৃতি বা উল্কি আঁকিয়েছিলেন।

২০১৬ সালের ২৫ নভেম্বর ক্যাস্ত্রোর মৃত্যুতে শোকার্ত মারাদোনা বলেছিলেন, ‘আমার কাছে ক্যাস্ত্রো ছিলেন বাবার মতো। অনন্ত যাত্রায় বন্ধু ফিদেল ক্যাস্ট্রোর প্রয়াণ দিবসটাকেই বেছে নিলেন মারাদোনা! কী অদ্ভুত সংযোগ বন্ধুত্বের!

৮.

নিজের জীবনটাকে তিনি যাপন করে গেছেন রাজার মতো। অফুরান জীবন সুধা উপভোগ করে গেছেন প্রাণ ভরে, পান করে গেছেন শেষ তলানীটুকু পর্যন্ত।

সম্প্রতি তাঁর সর্বশেষ ব্রেইন সার্জারিটাও সমাপ্ত হয়েছিলো সাফল্যের সঙ্গেই। হাসপাতাল থেকে হাসিখুশি মারাদোনা ফিরে গিয়েছিলেন কন্যার কাছে। কিন্তু দু’সপ্তাহ না যেতেই পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষকে স্তম্ভিত করে, তাদের চোখ অশ্রুসজল করে আচমকা ঘুমিয়ে পড়লেন ফুটবল ঈশ্বর।

বিদায় বন্ধু। বিদায় আমার জীবনের প্রধানপ্রেরণাসঞ্চারী বিস্ময়মানব। পৃথিবী তোমাকে মনে রাখবে। বাংলা ছড়ার এই অতি নগন্য কর্মীটিও তোমাকে মনে রাখবে।

কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ের গভীর গোপন কুঠুরিতে তুমি বেঁচে আছো, বেঁচে থাকবে প্রিয় মারাদোনা!

অটোয়া, ২৫ নভেম্বর ২০২০

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link