নন্দন কাননের নন্দিত-নিন্দিত নায়ক

সফলতার দুয়ারে সমালোচনার পাহাড়ের ছাপ যাকে রূদ্ধ করতে পারেনি; নিন্দার গল্পকে পেছনে ফেলে যিনি হয়েছেন নন্দিত; সেরাদের সেরা ভাষ্যে যিনি হয়েছেন সর্বকালের সেরা। তিনি ফুটবলের ছিলেন, নাকি ফুটবল তাঁর ছিল, সে তো পরের কথা। তিনি ছিলেন সময়ের সেরা কিংবদন্তি; ছিলেন অসংখ্য সম্মাননার আঁধার, তিনি ডিয়েগো আর্মান্ডো ম্যারাডোনা ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন কৌশলী খেলোয়াড়। ম্যারাডোনাকে ক্রীড়া জগতের সবচেয়ে বিতর্কিত একজন ব্যক্তিত্ব বলে মনে করা হয়।

আর্জেন্টিনার বুয়েনোস আইরেসের লানুস শহরের একটি দরিদ্র পরিবারে ১৯৬০ সালের ৩০শে অক্টোবর জন্ম নিয়েছেন ম্যারাডোনা। দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া সত্ত্বেও কপালে ফুটবলের রাজটিকা পরে জন্ম নিয়েছিলেন এই কিংবদন্তী। ছিলেন বাবা-মায়ের প্রথম পুত্র সন্তান; এবং তাঁর ছ হুগো (এল তুর্কো) এবং রাউল (লালো) -উভয়েই পেশাদার ফুটবল খেলোয়াড়। ম্যারাডোনা ছিলেন একজন বাম পায়ের খেলোয়াড়। সীমিত জায়গার মধ্যে তিনি নিজেকে কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন।

মাত্র ১০ বছর বয়সে তিনি এস্ত্রেয়া রোজার হয়ে খেলার সময় তাকে খুঁজে বের করেন একজন স্কাউট।এরপর তিনি ‘দ্য লিটল অনিঅনের/ আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্সের যুব দল’-এর খেলোয়াড়ে পরিণত হন। আর্জেন্টিনোস জুনিয়রের হয়ে ১৬ বছর বয়সে পেশাদার ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন তিনি। ফুটবলের জাদুকরি পায়ের ছোঁয়াতে মাতিয়েছেন বহু দল।

 

সময়টা১৯৭৬ সালের ২০ অক্টোবর। ষোলতে পা দিতে যাওয়া ম্যারাডোনার অভিষেক ঘটলো আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্সের হয়ে ; সেখানে তিনি ছিলেন ১৯৮১ সাল পর্যন্ত। সেই দিনগুলোতে তিনি ১৬৭ খেলায় ১১৫টি গোল করেন। এরপর তিনি ১ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে বোকা জুনিয়র্সে পাড়ি জমান। ১৯৮১ মৌসুমের মাঝামাঝি সময় বোকায় যোগ দিয়ে ১৯৮২ সালে তিনি প্রথম লিগ চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেন। মারাদোনাই একমাত্র খেলোয়াড় যিনি দুইবার স্থানান্তর ফি এর ক্ষেত্র বিশ্বরেকর্ড গড়েছেন। প্রথমবার বার্সেলোনায় স্থানান্তরের সময় ৫ মিলিয়ন ইউরো এবং দ্বিতীয়বার নাপোলিতে স্থানান্তরের সময় ৬.৯ মিলিয়ন ইউরো।

এরপর ১৯৮২ বিশ্বকাপ শেষে বার্সেলোনায় যোগ দেন ম্যারাডোনা। ১৯৮৩ সালে, কোচ সিজার লুইস মেনত্তির অধীনে বার্সেলোনা এবং মারাদোনা রিয়াল মাদ্রিদকে হারিয়ে কোপা দেল রে এবং অ্যাথলেটিক বিলবাওকে হারিয়ে স্পেনীয় সুপার কাপ জিতে। বার্সেলোনায় থাকাকালীন ম্যারাডোনা ৫৮ খেলায় ৩৮টি গোল করেন।

ফুটবলে নাপোলির ইতিহাসে যে সময়টিকে সফলতম যুগ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, সেই সময়ের কাণ্ডারি ছিলেন মারাদোনা। তাঁর অধীনে নাপোলি ১৯৮৬–৮৭ ও ১৯৮৯–৯০ মৌসুমে সিরি এ চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে এবং ১৯৮৯–৮৮ ও ১৯৮৮–৮৯ মৌসুমে তারা রানার-আপ হয় ; ১৯৮৭ সালে কোপা ইতালিয়া জিতে একবার রানার-আপ হয় ১৯৮৯ সালে। এরপর তারা ১৯৯০ সালে ইতালীয় সুপার কাপ জিতে। সেই সময়ের হিসেবে (১৯৮৭–৮৮) মৌসুমের সিরি এ-তে মারাদোনা সর্বোচ্চ গোলদাতা ছিলেন।

এরমাঝেই ঘটে ফুটবল ইতিহাসের একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা। ১৯৮৬ ফিফা বিশ্বকাপ ; আর্জেন্টিনা দলের অধিনায়কের দায়িত্ব ছিলেন ম্যারাডোনা। ফাইনালটি ছিল ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। সেই ম্যাচে নিজের ২গোল উপহার দেওয়ার সাথে সাথে ২ গোলেই আর্জেন্টিনার ভাগ্য লিখেন ম্যারাডোনা। দলকে জিতিয়ে দেন ফিফা বিশ্বকাপ এবং নিজে হয়ে যান স্বর্ণগোলকে ভূষিত সেরা খেলোয়াড়। সেই ম্যাচে ম্যারাডোনা প্রায় ৬০ মিটার দূর থেকে ড্রিবলিং করে পাঁচজন ইংরেজ ডিফেন্ডারকে পাশ কাটিয়ে করেন। ২০০২ সালে ফিফা.কমের ভোটাররা গোলটিকে শতাব্দীর সেরা গোল হিসাবে নির্বাচিত করেন।

১৯৯২ সালে ন্যাপোলি ছাড়ার পর তিনি স্পেনীয় ক্লাব সেভিয়াতে যোগ দেন। সেখানে তিনি এক বছর ছিলেন। ১৯৯৩ সালে তিনি লিওয়েলস ওল্ড বয়েজের হয়ে খেলেন এবং ১৯৯৫ সালে তিনি বোকা জুনিয়র্সে ফিরে আসেন। দুই বছর সেখানে খেলার পর ১৯৮৬ বিশ্বকাপের আগে ম্যারাডোনা টটেনহ্যাম হটস্পারের হয়েও মাঠে নামেন ইন্টার মিলানের বিপক্ষে। তিনি গ্লেন হোডেলের সাথে খেলেন, যিনি ম্যারাডোনার জন্য তার ১০ নম্বর জার্সিটি ছেড়ে দিয়েছিলেন।

তাঁর ক্রীড়া জীবনের ক্যারিয়ারে একাধিকবার দলবদলের চক্রে নিয়েছেন নতুন অভিজ্ঞতা, গড়েছেন নতুন নতুন ইতিহাস।

ম্যারাডোনা ১৯৬৮–১৯৬৯ পর্যন্ত এস্ত্রেয়া রোজা; ১৯৭০–১৯৭৪ পর্যন্ত লস কেবোইতাস; ১৯৭৫–১৯৭৬ পর্যন্ত আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্সের হয়ে খেলেছেন। এরপর ১৯৭৬ সালে আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্সে যোগদানের পর তিনি ১৯৭৬–১৯৮১ পর্যন্ত সেখানে নিযুক্ত ছিলেন। ১৯৮১–১৯৮২ মৌসুমে খেলেন বোকা জুনিয়র্স এর হয়ে। এরপরের ইতিহাস বার্সেলোনার। ১৯৮২–১৯৮৪ সাল পর্যন্ত বার্সেলোনার জার্সি গায়ে নিজের দ্যুতি ছড়িয়ে ১৯৮৪তে নাপোলিতে যোগ দেন। নাপোলির ১৯৮৪–১৯৯১ এর ক্যারিয়ার শেষে ১৯৯২–১৯৯৩ মৌসুমে তিনি খেলেন সেভিয়ার হয়ে। এরপর ১৯৯৩–১৯৯৪ মৌসুম কাটান নিওয়েলস ওল্ড বয়েজ-এ। ১৯৯৪–১৯৯৭ বোকা জুনিয়র্সে ছিল তার পায়ের জাদু।

জাতীয় ক্যারিয়ারে ১৯৭৭–১৯৯৪ সাল পর্যন্ত আর্জেন্টিনা জাতীয় দলে ছিল তার পদচারণা।  ১৯৯৪ সালে ম্যান্দিইউ দি করিয়েন্টেস; ১৯৯৫ সালে মন্টেনেগ্রো; ২০০৮–২০১১ পর্যন্ত আর্জেন্টিনা; ২০১১–২০১২ পর্যন্ত আল ওয়াসল ; এই চারটি দলের পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন তিনি।

তাঁর আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে চারটি ফিফা বিশ্বকাপ খেলেছিলেন তিনি।-১৯৮২ সাল, ১৯৮৬ সাল, ১৯৯০সাল এবং ১৯৯৪ সাল। বিশ্বকাপের ২১ টি খেলায় আটটি গোল করেন। ১৬টি খেলায় জাতীয় দলের অধিনায়ক হিসেবে মাঠে নেমেছিলেন তিনি।

২০০৮ সালের নভেম্বরে তাকে আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের কোচের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ২০১০ বিশ্বকাপের পর চুক্তি শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত আঠারো মাস এই দায়িত্বে ছিলেন তিনি।

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আর্জেন্টিনার হয়ে তিনি ৯১ খেলায় ৩৪ গোল করেন ম্যারাডোনা। ১৯৭৬ থেকে ১৯৯৭ পর্যন্ত দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে দলের পালাবদলে মারাদোনা খেলেছিলেন ৪৯২টি ম্যাচ ; যেখানে তাঁর গোলের সংখ্যা ছিল ২৫৮।

দিন শেষে আলো দিতে থাকা সূর্যটাও একসময় অস্তাচলে যায়। ফুটবল বিশ্বে সূর্যের মত কিরণ দিতে থাকা এই কিংবদন্তী মাত্র ৬০ বছর বয়সে (২৫ নভেম্বর ২০২০ সাল) তাঁর অন্তীমতাকে নিয়েছেন বরণ করে। ফুটবলের এই নক্ষত্রকে নিয়ে কম বিতর্ক হয়নি; কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে এসবের উর্ধ্বে উঠে তিনিই হয়েছেন সময়ের সেরা ‘ম্যারাডোনা’।

ম্যারাডোনা মানেই ছিল আলোচনা আর বিতর্ক। সেটা তিনি মাঠে থাকুন কিংবা মাঠের বাইরে থাকুন। এমন একজন মানুষের প্রয়াণে যে আকাশ ভেঙে পড়বে সে তো বলে না দিলেও চলে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link