বর্তমানের জৈব সুরক্ষা বলয়ের বাস্তবতায় মানসিক অবসাদ বিষয়টা নিতান্তই সাধারণ। করোনার প্রকোপে জৈব সুরক্ষা বলয়ের গ্যাড়াকলে অনেক ক্রিকেটারই মানসিক অবসাদে ক্রিকেট থেকে সাময়িক বিরতি নিয়েছেন। ‘মানসিক অবসাদ’ – ব্যাপারটা ভাবলে সবার আগে মনে পড়ে মার্কাস ট্রেসকোথিকের কথা। ক্রিকেট ইতিহাসের টপ তিন আক্ষেপের কথা আসলে নির্দ্বিধায় সবার উপরে থাকবেন এই ইংলিশ ওপেনার। তাঁর সময়ের সেরা ইংলিশ ক্রিকেটার তো বটেই বিশ্ব ক্রিকেটেরও বড় এক নাম ছিলেন তিনি।
কিন্তু মানসিক অবসাদে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে সরে দাঁড়ান নিজের সোনালি সময়ে। ইতিহাসের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে মানসিক অবসাদে ভোগার কারণে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানান তিনি! মার্কাস ট্রেসকোথিকের ব্যাটিং টেকনিক এক বাক্যে বলা চলে – ‘ফিয়ারলেস আর ডমিনেটিং’। আধুনিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের ব্র্যান্ড হতে পারতেন তিনি। ইংলিশ ক্রিকেটের এই রান মেশিন বনে যেতে পারতেন ইতিহাসের সর্বকালের অন্যতম সেরা ব্যাটার হিসেবে। সেই সামর্থ্য তাঁর ছিলো, সম্ভাবনাও দেখিয়েছিলেন। কিন্তু থমকে গেলেন অল্পতেই।
অবশ্য ইংলিশ ক্রিকেটারদের জন্য এই ব্যাপারটা খুবই সাধারণ। কেভিন পিটারসেন, জনাথন ট্রটরাও যে এর জলন্ত উদাহরণ।
সাল ২০০৬। ভারত সফরে তখন ইংলিশরা। ব্যাট হাতে উড়ন্ত ফর্মে ছিলেন মার্কাস। বরোদার হোটেলে লন্ডন থেকে ফোন এলো। ফোন পেয়েই যেন অস্থির হয়ে পড়েন মার্কাস। তাঁর বাড়ি থেকেই ফোন এসেছিলো। কিছুদিন আগে সন্তান জন্ম দেন তাঁর স্ত্রী। মার্কাসও পাশে নেই তাই কিছুটা ডিপ্রেশন তো ছিলই। স্ত্রী হেইলির বাবাও কিছুদিন আগে দূর্ঘটনার শিকার হন। সব মিলিয়ে বাসার অবস্থাও ঠিক ছিলো না। তাই মার্কাসও অনেকটাই অস্থির হয়ে ওঠেন। পরিবার ছেড়ে ছোট থেকেই দূরে থাকতে পারতেন না তিনি।
জিম ট্রেনারের কথাও ঠিকঠাক শুনছিলেন না। মার্কাস বললেন তাঁর কিছুই ভালো লাগছে না! বাড়ি ফিরতে চান। হুট করেই তখন টেস্ট সিরিজের আগ মূহুর্তে মানসিক অবসাদের কারণ দেখিয়ে লন্ডন ফিরে যান মার্কাস। ওই বছরই আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে ইতি টানেন তিনি। ডিপ্রেশন থেকে মুক্তি না মেলায় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে নিজের সেরা সময়ে বিদায় জানান এই ইংলিশ তারকা। তবে ঘরোয়া ক্রিকেট খেলে গেছেন বুড়ো বয়স অবধি! যতই বছর গড়িয়েছে হাজার হাজার রান যোগ করেছেন নিজের নামের পাশে। বনে গেছেন ঘরোয়া ক্রিকেটের কিংবদন্তি!
১৯৭৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর সমারসেটে জন্ম দেন মার্কাস ট্রেসকোথিক। বাবা মার্টিন ট্রেসকোথিকও ছিলেন একজন ক্রিকেটার। সমারসেট কাউন্টি ক্রিকেট ক্লাবের দ্বিতীয় একাদশে খেলেছেন তিনি। এছাড়া রাজ্যভিত্তিক ক্রিকেটে ১৯৬৭ থেকে ১৯৭৬ পর্যন্ত ব্রিস্টলের হয়েও খেলেছেন মার্টিন।
ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেটে মনোনিবেশ করেন মার্কাস। মাত্র ১১ মাস বয়সেই ক্রিকেট ব্যাট গিফট পেয়েছিলেন তিনি। এরপর ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠেন মার্কাস। বাবা ক্রিকেটার হওয়ায় ক্রিকেটের সাথে সখ্যতাও হয় দ্রুতই। অভন স্কুলের অনূর্ধ্ব-১১ দলে খেলার সুযোগ পান তিনি। অভনের হয়েই ক্রিকেট ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরি হাঁকান তিনি।
এর কয়েক সপ্তাহ বাদেই ১৮৩ রানের অসাধারণ এক ইনিংস খেলার পরই ডাবল সেঞ্চুরি থেকে মাত্র ১৭ রান দূরে থাকতে দলের কোচ ইনিংস ঘোষণা করেন! আর কারণ হিসেবে তিনি জানান, ‘যদি আমি মার্কাসকে এই বয়সে ডাবল সেঞ্চুরি করতে দেই তাহলে তাঁর ভবিষ্যতে লক্ষ্য বলতে আর কি থাকবে?’ ব্যাপারটা অবশ্য স্থানীয় গণমাধ্যমেও আসে। এরপর সেখান থেকে গ্লস্টারশায়ার কাউন্টি ক্লাবের অনূর্ধ্ব ১১ দলে তাঁকে ডাকা হয়। সুযোগ পেয়ে দ্বিতীয় ম্যাচেই সমারসেটের বিপক্ষে গড়েন দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরি! এরপর বাবার খেলা পুরোনো ক্লাব সমারসেটে ফিরে যান তিনিও।
এরপর অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফ, পল কলিংউডদের সাথে ইংল্যান্ড অনূর্দ্ধ-১৪ দলে ডাক পান তিনি। তবে দলে বাকিদের তুলনায় বয়সে একটু বড় ছিলেন মার্কাস। যার কারণে ব্যাটিংয়ে হাত খুলে খেলতে অতিরিক্ত সুবিধা পেতেন তিনি। পরবর্তীতে ধারাবাহিক পারফরম্যান্স দেখিয়ে মার্কাস জায়গা করে নেন সমারসেট অনূর্ধ্ব ১৯ দলে।
সমারসেট অনূর্ধ্ব ১৯ দল সহ, কাউন্টির দ্বিতীয় একাদশেও বেশ ভালো পারফর্ম করছিলেন মার্কাস। এরপর ইংল্যান্ড অনূর্ধ্ব-১৯ দলে সুযোগ পান তিনি। সেখানে দুর্দান্ত পারফর্ম করে দায়িত্ব পান অধিনায়কত্বের। ১৯৯৯ সালে গ্ল্যামরগানের কোচ ডানকান ফ্লেচার মার্কাসের ব্যাটিংয়ে মুগ্ধ হয়ে যান। লো-স্কোরিং ম্যাচে ১৬৭ রানের দুর্দান্ত ইনিংস খেলেন মার্কাস। এরপর অল্প সময়ের ব্যবধানে ইংল্যান্ডের কোচ হন ফ্লেচার। ২০০০ সালে ওপেনার নিক নাইটের ইনজুরিতে মার্কাসকে জাতীয় দলে ডাকলেন ফ্লেচার। জিম্বাবুয়ে ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ন্যাটওয়েস্ট সিরিজের দলে ডাক পেলেন তিনি।
৯ জুলাই, ২০০০। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওভালে ওয়ানডে দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক মার্কাসের। অভিষেকেই খেলেন ৭৯ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস। ওই সিরিজে ৪৮ গড়ে ২৮৮ রান করেন তিনি। এরপর ওল্ড ট্রাফোর্ডে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সাদা পোশাকেও অভিষিক্ত হন তিনি। অভিষেকেই খেলেন ৬৬ রানের ইনিংস। ওই সিরিজে প্রায় ৪৮ গড়ে ব্যাটিংয়ের পর, পরের পাকিস্তান ও অস্ট্রেলিয়া সিরিজে অসাধারণ ব্যাটিং নৈপুণ্যে দেখান তিনি।
২০০১ অ্যাশেজে ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান স্কোরার হন তিনি। এরপর নাসের হুসাইনের ইনজুরিতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজে দলকে নেতৃত্ব দেন। ব্যাট হাতে ধারাবাহিক রান পাচ্ছিলেন মার্কাস। পরবর্তী ভারত সফরে ৪৮ গড়ে টেস্টে ও ৫৩ গড়ে ওয়ানডেতে রান করে ইংল্যান্ডের হয়ে ওই সিরিজে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হন তিনি। ততদিনে মার্কাসের ঝুলিতে ৪ ওয়ানডে সেঞ্চুরি! তবে দু:খজনক ব্যাপার হলো এর কোনো ম্যাচেই জয়ের মুখ দেখেনি ইংল্যান্ড। দলের বাকিদের ব্যর্থতার দিনেও ঢাল হয়ে দাঁড়াতো মার্কাসের ব্যাট।
স্পিন বলেও বেশ দুর্দান্ত খেলতেন তিনি। ডেভিড গাওয়ার মার্কাস ট্রেসকোথিকের টেকনিক নিয়ে বলেছিলেন, ‘বলের লাইন ও লেন্থের ব্যাপারে ওর ভাল বোঝাপড়া আছে।’
ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ডের (ইসিবি) কেন্দ্রীয় চুক্তিতে জায়গা পান তিনি। এরপর ব্যাট হাতে কিছুটা খারাপ সময় পার করেন মার্কাস। ২০০২-০৩ অ্যাশেজে মাত্র ২৬ গড়ে রান করেন তিনি। পরের সিরিজেও ১০ ম্যাচে মাত্র ৩২ গড়ে রান করেন। ২০০৩ বিশ্বকাপেও দিতে পারেননি নিজের সেরাটা। মাত্র ২৩ গড়ে ওই টুর্নামেন্টে রান করেন তিনি! ওই বিশ্বকাপে ইংলিশরা বিদায় নেয় গ্রুপ পর্বেই। তবে মার্কাসের ব্যাটে রান খরাটা কেটে যায় দ্রুতই। পরের জিম্বাবুয়ে ও দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজেই দুর্দান্ত পারফর্ম করে ফর্মে ফেরেন তিনি।
জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সেঞ্চুরির পর দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষেও ওয়ানডেতে খেলেন ১১৪ রানের ইনিংস। বিক্রম সোলানকির সাথে প্রথমবার ২০০ রানের জুটি গড়েন তিনি! এবং প্রথম ইংলিশ ওপেনার হিসেবে দু’জনই এক ম্যাচে সেঞ্চুরির কীর্তি গড়েন। টেস্টেও এই ফর্ম ধরে রাখেন তিনি। প্রায় ৬১ গড়ে রানের পথে ওভালে খেলেন ক্যারিয়ার সেরা ২১৯ রানের ইনিংস। পরের বাংলাদেশ সফরেও রানের ধারা বজায় রাখেন তিনি। সেসময় ইংল্যান্ডের সেরা ব্যাটার হিসেবেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন মার্কাস।
মাইকেল ভনের ইনজুরিতে ঘরের মাঠে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজে অধিনায়কের দায়িত্ব পান মার্কাস। এজবাস্টনে দ্বিতীয় টেস্টে অভিষিক্ত অ্যান্ড্রু স্ট্রাউসের সাথে দুই ইনিংসেই দুর্দান্ত জুটির পথে সেঞ্চুরি করেন মার্কাস। প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে এজবাস্টনে দুই ইনিংসেই সেঞ্চুরির কীর্তি গড়েন তিনি। এছাড়া নবম ইংলিশ ব্যাটার হিসেবে এক টেস্টের দুই ইনিংসে সেঞ্চুরি করেন মার্কাস। এরপর ২০০৪ আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে অসাধারণ পারফর্ম করেন তিনি। ৪ ম্যাচে করেন ২৬১ রান। ফাইনালে দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরি করেন মার্কাস।
এরপর দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজে প্রথম টেস্টে স্ট্রাউসের সাথে ১৫২ রানের জুটির পর পরের টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে ২৭৩ রানের জুটি গড়েন মার্কাস। যা ছিলো ডারবানের ইতিহাসে রেকর্ড ওপেনিং জুটি। এমনকি ১৯৯১ সালে মার্ক আথারটন ও গ্রাহাম গুচের পর এটি ছিলো প্রথম ডাবল সেঞ্চুরির জুটি! ওই জুটির পথে ১৩২ রানের অসাধারণ এক ইনিংস খেলেন মার্কাস। এরপর চতুর্থ টেস্টে জোহানেসবার্গে আরো এক সেঞ্চুরি করেন তিনি। খেলেন ১৮০ রানের দুর্দান্ত ইনিংস।
পরে বাংলাদেশের বিপক্ষে সিরিজে দুই টেস্টে ১৯৪ ও ১৫১ রানের ইনিংস খেলেন মার্কাস। নিজের শততম ওয়ানডেতে বাংলাদেশের বিপক্ষে গড়েন দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরি। ওয়ানডে ইতিহাসের ষষ্ঠ ও প্রথম ইংলিশ ব্যাটার হিসেবে শততম ম্যাচে সেঞ্চুরির কীর্তি গড়েন তিনি। একই সাথে ইংল্যান্ডের হয়ে ওয়ানডেতে গ্রাহাম গুচের সর্বোচ্চ সেঞ্চুরির রেকর্ড ভেঙে নিজের নাম লেখান মার্কাস।
২০০৫ অ্যাশেজে তিন ফিফটি পেলেও দেখা পাননি সেঞ্চুরির। তবে ওই সিরিজেই বেশ কিছু কীর্তি গড়েন এই ওপেনার। তৃতীয় টেস্টের সময় দ্রুততম ব্যাটার হিসেবে টেস্টে ৫ হাজার রানের মাইলফলক স্পর্শ করেন মার্কাস। ২০০৩ এবং ২০০৪ এর পর ২০০৫ সালেও টানা তৃতীয় বছরের মতো টেস্টে এক পঞ্জিকাবর্ষে ১ হাজার রানের মাইলফলকেও পা দেন তিনি। অবশ্য ওই সিরিজেই গ্লেন ম্যাগ্রার ৫০০ তম ও শেন ওয়ার্নের ৬০০ তম টেস্ট উইকেট হিসেবে শিকার হন মার্কাস! ওই বছর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে অভিষিক্ত হন তিনি। অভিষেকেই করেন ৩৭ বলে ৪১ রান।
পরের পাকিস্তান সফরে আবারো ভনের ইনজুরিতে অধিনায়ক হন মার্কাস। সেবার পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্টে ১৯৩ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস খেলেন তিনি। তখনি মার্কাসের শশুড় এক দূর্ঘটনায় বেশ আহত হন। কিছুদিনের মধ্যেই মেয়ের বাবাও হন তিনি। এরপর ২০০৬ ভারত সফরে এসে হুট করেই ডিপ্রেশনে সফরের মাঝেই লন্ডন ফেরত যান তিনি। মানসিক অবসাদ বলুন আর ক্যারিয়ারের ইতি মার্কাসের ক্যারিয়ারের শুরুটা এখানেই।
ওই বছরের মে মাসে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্ট দিয়ে আবারো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেরেন তিনি। ফিরেই দেখা পান সেঞ্চুরির! ২০০৬ মৌসুমে সেবার প্রথম ইংলিশ ব্যাটার হিসেবে সেঞ্চুরি করেন মার্কাস। দুই টি-টোয়েন্টিতেই করেন দুর্দান্ত দুই ফিফটি! অবশ্য পরের ৬ টেস্টে দেখা পান মাত্র এক হাফ সেঞ্চুরির!
ওয়ানডেতে অবশ্য আরো দুই সেঞ্চুরি করেন আয়ারল্যান্ড ও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওই মৌসুমে। এরপরই মানসিক অবসাদের কারণে সেপ্টেম্বরে পাকিস্তান সিরিজের মাঝ পথেই বিরতির ঘোষণা দেন এই ওপেনার। এমনকি আসন্ন আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতেও তাঁকে দলে না রাখার ব্যাপারে বার্তা পাঠান নির্বাচক প্যানেলকে!
ডিপ্রেশনের কারণেই ২০০৬ সালটা ব্যাট হাতে খুব ভালো কাটেনি মার্কাসের। এরপর ২০০৬-০৭ অ্যাশেজ সিরিজে আবারো জাতীয় দলে ফেরেন তিনি। দুইটি প্রস্তুতি ম্যাচ খেলার পরই আবারো মানসিক অসুস্থতার কারণে মাঝপথেই দেশে ফিরে যান তিনি। বার বার দলে আসা যাওয়া, মানসিক বিপর্যস্ততা দেখানো সব মিলিয়ে ক্রিকেট পাড়ায় বেশ সমালোচনার জন্ম দিয়েছিলেন মার্কাস। অবশ্য তিনি জানিয়েছিলেন তিনি আবার ফিরবেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। নির্বাচকরাও সেসময় তাঁর উপর যথেষ্ট আস্থা দেখিয়ে তাঁকে সমর্থন করেন।
এরপর ২০০৭ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে ২৫ জনের প্রাথমিক স্কোয়াডে রাখা হয় তাঁকে। মাঝে দুইবার হার্নিয়ার অপারেশন হওয়ায় পুরোটা সময় ছিলেন মাঠের বাইরে। ২০০৭ এর এপ্রিলে কাউন্টিতে ডাবল সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে ক্রিকেটে ফেরেন মার্কাস। কাউন্টিতে ধারাবাহিক ভাবে রান বন্যায় ভাসাচ্ছিলেন তিনি। তবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেরার মতো ফিটনেস নাকি তখনো আসেনি বলে তিনি জানান!
ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজ থেকেও নিজেকে সরিয়ে নেন। তিনি বলেছিলেন, ‘অবশ্যই আমি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতে মুখিয়ে আছি। আমি ইংল্যান্ডের হয়ে খেলতে চাই। তবে তার আগে নিজেকে যাচাই করতে চাই আমি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার জন্য ফিট কিনা।’ এরপর ২০০৭ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের জন্য ঘোষিত প্রাথমিক স্কোয়াডে রাখা হয় মার্কাস ট্রেসকোথিককে। স্কোয়াড ফাইনাল করার কিছু মূহুর্ত আগে নিজেকে আবার স্কোয়াড থেকে সরিয়ে নেন তিনি!
এবারও তিনি বলেন, ‘আমি এখনো পুরোপুরি সেরে উঠিনি! নিজেকে ফিট মনে করলেই ফিরবো জাতীয় দলে।’
ট্রেসকোথিক অবশ্য বলেছিলেন ইংল্যান্ড দল তার জন্য এতো সময় অপেক্ষা করবে না। ততদিনে টানা দুই বছর কেন্দ্রীয় চুক্তির বাইরে ছিলেন তিনি! ধীরে ধীরে তাঁর ফেরা নিয়ে হচ্ছিলো জলঘোলা। ঘরোয়া ক্রিকেটে রানের ফোয়ারা ছুঁটিয়েও কেনো যেনো নিজেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খেলার জন্য ফিট মনে করছিলেন না তিনি! হয়তো ব্যাপারটা মানসিক প্রশান্তির।
ইনজুরি সহ মানসিক অসুস্থতা সব মিলিয়ে মার্কাস ট্রেসকোথিক মনে করেছেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তাঁর জার্নিটা এখানেই শেষ। এরপর ২০০৮ সালের ২২ মার্চ ৩৩ বছর বয়সে তিনি অফিসিয়ালি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দেন। ওই বছরের পহেলা সেপ্টেম্বর নিজের আত্মজীবনী ‘কামিং ব্যাক টু মি’ প্রকাশ করেন মার্কাস। সেখানে তিনি বলেন, ‘ মাত্র ১০ বছর বয়স থেকে বিভিন্ন বিষয়ে তিনি বিরক্ত থাকতেন। এছাড়া তিনি যেকোনো ক্রিকেটেই পরিবার থেকে তিন ঘন্টাও দূরে থাকতে পারতেন না! ‘ তিনি তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘পরিবারই আমার প্রথম প্রাধান্য।’
অবশ্য মার্কাসের অবসর অনেকেই মেনে নিতে পারেননি। সেসময় ইংল্যান্ড দলের নতুন অধিনায়ক অ্যান্ড্রু স্ট্রাউস মার্কাসকে অনুরোধও করেন অবসর থেকে ফিরে এসে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলতে। তবে মার্কাস আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেরেননি। কিন্তু ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলে গিয়েছেন বছরের পর বছর। সমারসেটের হয়ে তিনি ছিলেন অদম্য। অবসরের পর যেনো ব্যাট হাতে আরো প্রাণবন্ত হয়ে ওঠেন তিনি। ২০১০ সালে সমারসেটের অধিনায়ক হন তিনি। এরপর ২০১৯ সাল পর্যন্ত পেশাদার ক্রিকেট খেলেন এই ইংলিশ ওপেনার। এরপর ৪৪ বছর বয়সে ক্রিকেটকে বিদায় জানান এই কিংবদন্তি কাউন্টি ক্রিকেটার।
ইংল্যান্ডের হয়ে ৭৬ টেস্টে ৪৪ গড়ে ৫৮২৫ রান করেছেন মার্কাস। ২৯ ফিফটির পাশাপাশি আছে ১৪ সেঞ্চুরি। ওয়ানডেতে ১২৩ ম্যাচে ৩৭ গড়ে ৪৩৩৫ রান করেছেন তিনি। ২১ ফিফটি আর ১২ সেঞ্চুরি করেছে এই ফরম্যাটে। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ৩৯১ ম্যাচে ৪১ গড়ে ২৬২৩৪ রানের মালিক তিনি! ১২৭ ফিফটি আর ৬৬ সেঞ্চুরি নিজের নামে করেছেন এই ওপেনার। লিস্ট এ তে ৩৭২ ম্যাচে ৩৭ গড়ে আছে ১২ হাজারেরও বেশি রান। ৬৩ ফিফটি আর ২৮ সেঞ্চুরি করেছে লিস্ট এ তেও! এছাড়া টি-টোয়েন্টিতে ৮৯ ম্যাচে ২৯ গড়ে ২৩০০-এর ওপর রান আছে মার্কাসের নামের পাশে।
ওয়ানডেতে ১২ টি সেঞ্চুরি করেছেন ট্রেসকোথিক। ইংল্যান্ডের হয়ে তৃতীয় সর্বোচ্চ ওয়ানডে সেঞ্চুরি তাঁর দখলে। প্রথম ইংলিশ ব্যাটার হিসেবে তিনি দশ বা তার অধিক সেঞ্চুরি করেছেন। তিনি যে ২৩ টি টেস্ট সিরিজ খেলেছেন তার মধ্যে প্রতি সিরিজেই কমপক্ষে একটি পঞ্চাশোর্ধ ইনিংস খেলেছেন। এই কীর্তি একমাত্র মার্কাসেরই!
সমারসেটের হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ৫২টি সেঞ্চুরি করেছেন মার্কাস। একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে নিজ ক্লাবের হয়ে পঞ্চাশটি সেঞ্চুরির মালিক তিনি। হ্যারোল্ড গিলব্লেটের ২১১৪২ রানের পর সমারসেটের হয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৯৬৫৪ রানের রেকর্ড তাঁর দখলেই।
২০০৪ আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফির ফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ১০৪ রান করেন তিনি। আইসিসি টুর্নামেন্টের ফাইনালে একমাত্র ইংলিশ ক্রিকেটার হিসেবে সেঞ্চুরি করেন মার্কাস। ক্যারিয়ারে মোট ১২২ টি ওয়ানডে খেলেছেন মার্কাস। যার সবকটি খেলেছেন ওপেনিংয়ে। এর প্রত্যেক ম্যাচেই ইনিংসের প্রথম বল মোকাবেলা করেছেন মার্কাস। ওয়ানডে ইতিহাসে (একশোর বেশি ম্যাচ) আর কোনো ব্যাটারই এই কীর্তি গড়তে পারেননি।
টি-টোয়েন্টিতে মার্কাসে ব্যাটিং স্ট্রাইক রেট ১৫০.৬০। টি-টোয়েন্টি ইতিহাসে ২ হাজার রান করা ক্রিকেটারদের মধ্যে স্ট্রাইক রেটের দিক থেকে তাঁর অবস্থান সাতে। এছাড়া ইংল্যান্ডের হয়ে তিনি একমাত্র ক্রিকেটার যার ১৫০+ স্ট্রাইক রেটে ২ হাজার রান সংগ্রহে আছে। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ৫৩৪ টি ক্যাচ নিয়েছেন মার্কাস। ১৯৯০ এর পর প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক হওয়া যেকোনো ক্রিকেটারের মধ্যে সর্বোচ্চ ক্যাচ তাঁর দখলে।
মার্কাসের ওপেনিংয়ে করা ১০৩২৫ আন্তর্জাতিক রান ইংল্যান্ডের হয়ে ওপেনারদের মধ্যে তৃতীয় সর্বোচ্চ। পেশাদার ক্রিকেটে ৪০৮২৬ রানের মালিক তিনি। ১৯৯৩ বা তার পরে অভিষেক হওয়া ক্রিকেটারদের মধ্যে প্রোফেশনাল ক্রিকেটে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রানের মালিক মার্কাস।
মানসিক অবসাদে নিজের সেরা সময়ে মার্কাসের বিদায়টা সত্যি হতাশার। যেভাবে ধারাবাহিক রান করছিলেন আরো বছর পাঁচেক আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতে পারতেন সহজেই। তিন ফরম্যাটেই নিজেকে রেখে যেতে পারতেন কিংবদন্তিদের কাতারে। ব্যক্তিগত জীবনের জন্য আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় বলেন অল্পতেই। তবু আক্ষেপ নেই মার্কাসের। বেশ কয়েকবার বলেছেন তিনি আরো অনেক উপরে যেতে পারতেন। আফসোস বা আক্ষেপ তেমন কিছু কখনোই প্রকাশ করেননি তিনি। তবে ক্রিকেট ইতিহাসের তিনি যে এক অনন্ত আক্ষেপ!