টিম মিটিংয়ে যখন কোচ ডেভ হোয়াটমোর আর অধিনায়ক হাবিবুল বাশার সুমন বসে ভারত বধের প্ল্যান কষছেন, সেসময়ই মাশরাফির মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসেছিলো কথাটা। কথায় কথায় সেটা যেন তার পরের মুহূর্ত থেকে গোটা টিমের মধ্যেই সংক্রমিত হয়ে গেল, আর হয়ে উঠল টিম স্লোগান।
হবে না ই বা কেন বাংলাদেশ টিম পোর্ট অব স্পেনে পৌঁছে বিশ্বকাপের ভারত – বাংলাদেশ ম্যাচ নিয়ে এক অদ্ভুত হাইপ তৈরী হয়ে গিয়েছিলো। আগের প্রস্তুতি ম্যাচে কিউইদের হারিয়ে এমনিতেই চমকে দিয়েছে বাশারবাহিনী, আর সেই মাচের সেরা পারফরমার ব্যাট ও বল হাতে ছিলেন ডেভ হোয়াটমোরের আদরের ‘পাগলা’ মাশরাফিই, আর এদিকে বছর দুয়েক আগের ঢাকায় একমাত্র ভারত বধের নায়ক ও ছিলেন সেই ‘পাগলা’, তাই খানিকটা তাঁকে ঘিরেই যেন যাবতীয় পরিকল্পনা তৈরীর চিন্তা, এর মধ্যেই যদি মাশরাফি অমন একটা কথা বলে বসেন তাহলে আর দোষ কী!
টিম মিটিংয়ের পরে অধিনায়ক বাশারের কাছে হঠাৎই একটা ফোন, ঢাকা থেকে। ফোনটা ধরে বাশার বেশ কিছুক্ষন বাক্যহারা, ফোন রাখার পরে সম্বিৎ ফিরলো টিমমেট দের ডাকে, কিন্তু চোখের জল ততক্ষনে বাশারের আর বাঁধ মানছে না, কোনোরকমে মুখ দিয়ে শুধু বেরোলো, ‘রানা মারা গেছে।’
মানজারুল ইসলাম রানা – এক প্রতিভাবান স্পিন বোলিং অলরাউন্ডার, দলে এক গুচ্ছ বাঁহাতি স্পিনার থাকায় বিশ্বকাপের দলে যাঁর শিকে ছেঁড়েনি, সড়ক দুর্ঘটনায় সেই রানা আর নেই – এটা শুনে তখন রফিক, আশরাফুলরা আর নিজেদের মধ্যেই যেন আর নেই, কেউ বিশ্বাস ই করতে পারছে না হাসিখুশি রানাকে আর কখনো পাবে না তাঁরা।
সকলে যেন স্বজন হারানোর বেদনায় ভেঙ্গে পড়েছেন ওই ত্রিনিদাদের হিলটন হোটেলে। এর মধ্যেই খোঁজ, খোঁজ ; মাশরাফি কথায় গেল। ম্যাশ ততক্ষনে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে হাউ হাউ করে কাঁদছে। রানা যে তার কাছে শুধু সতীর্থ ছিল না, সেই ছোট্ট বেলাকার বন্ধু, তার কাছে ভাই। হ্যাঁ, ম্যাশের কাছের রানা নিজের মায়ের পেটের ভাই এর থেকে কম কিছু নয়।
এর মধ্যে গোটা বাংলাদেশ শিবিরও শোকস্তব্ধ, আশরাফুল, আফতাব, রাজ্জাকদের শুধু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না বেরোচ্ছে, যেখানে পরের দিনে বিশ্বকাপে ভারত – বাংলাদেশ ম্যাচ তুচ্ছ, ক্রিকেট তুচ্ছ, যাবতীয় পরিকল্পনা তুচ্ছ, মনের মধ্যে শুধুই রানা, মানজারুল ইসলাম রানা।
পরের দিন সকালে ম্যাচ শুরুর আগেই দেখা গেল জ্বরের তাপে পুড়ে যাচ্ছে মাশরাফির শরীর, টিম ডাক্তার দেখে বললেন ১০৩ জ্বর! হাবিবুল মাশরাফিকে খেলতে পারবে কিনা জিজ্ঞেস করায় ম্যাশের উত্তর ‘না পারলেও খেলতি হবে সুমন ভাই, রানার জন্য খেলতি হবে।’
ব্যাস, এই একটা কথাতে যেন আরো তেতে উঠলো বাংলাদেশ ড্রেসিংরুম, একটাই কথা তখন, ‘রানার জন্য জিততেই হবে।’ বিপক্ষে শচীন, সৌরভ, দ্রাবিড়, শেবাগ, যুবরাজ, ধোনি, জাহিরের মতো যতই সব মহাতারকা থাকুন না কেন বাংলাদেশের এক একজনের ভেতরে তখন যেন তীব্র আগুন, দেহে ভর করেছে কোনো এক বিশেষ শক্তি আর মুখে ‘রানার জন্য জিততেই হবে’ স্লোগান।
টসে জিতে ভারত ব্যাটিং নেওয়ার পরেই তৃতীয় ওভারেই শেবাগের স্ট্যাম্প ছিটকে গেল মাশরাফির হঠাৎ ভেতরে ঢুকে আসা একটা বলে, জ্বর তখন ঘাম দিয়ে যেন পালাতে পারলে বাঁচে, কুইন্স পার্ক ওভালে ব্যাঘ্র গর্জন শুরু হলো বলে। খানিক পরে উথাপ্পা ও আফতাবের হাতে পয়েন্টে ক্যাচ দিয়ে ফিরলেন, বোলার – সেই মাশরাফি।
পাঁচ ওভারের মধ্যে এই দুটো উইকেট পড়ায় ভারতীয় ব্যাটিংয়ে সেই যে ঠকঠকানি আরম্ভ হলো গোটা ইনিংসে ভারতের মহারথীরা সেখান থেকে আর বেরোতে পারলেন না, রফিক আর রাজ্জাক স্লো পিচে মিডল অর্ডারটা পুরো ধসিয়ে দিলেন ভারতের আর শেষ কাজটুকু আবার সারলেন সেই মাশরাফিই।
গোটা ম্যাচে মাশরাফির বোলিং হিসেব ৯.৩ ওভারে ২টো মেডেন সহ ৩৮ রানে ৪ উইকেট। বাংলাদেশী বোলিংয়ের তোপে ভারতের মহাতারকা সমৃদ্ধ ব্যাটিং লাইন আপ শুয়ে পড়লো মাত্র ১৯১ রানে, লড়লেন শুধু মহারাজ আর যুবরাজ। ম্যাচ শুরুর আগে যে মাশরাফির শরীর জ্বরে আর ভাই হারানোর বেদনায় আগুন হয়ে ছিল, সেই আগুনই যেন ওই সাদা বলটা থেকে ঠিকরে বেরিয়ে ভারতীয় ব্যাটিংকে ছাড়খার করে দিলো।
১৯২ তাড়া করতে গিয়ে বাংলাদেশি ব্যাটিংয়ে স্পর্ধার শেষ কথা হয়ে এবার দাঁড়ালেন ১৯ বছরের তামিম। জাহির, মুনাফ, আগারকারদের বাউন্ডারির বাইরে ছুঁড়ে ফেললেন ইচ্ছা মতো, ধৈর্য্যের শেষ কথা হয়ে ম্যাচ শেষ করলেন ১৮ বছরের মুশফিকুর, আর ভবিষ্যতের নায়ক হবার আশা জাগিয়ে মিডল অর্ডারকে ভরসা দিয়ে গেলেন আরেক টিনএজার সাকিব আল হাসানও। ৫ উইকেটে জিতে ভারত বধ সম্পন্ন হলো বাশার ব্রিগেডের।
ক্রিকেটবিশ্ব এবার চিনলো এক নতুন বাংলাদেশকে। আসলে ওই ১৭ মার্চ ২০০৭ ছিল বাংলাদেশ ক্রিকেটের সত্যিই এক পালাবদলের দিন, এক নতুন যুগের সোপান লেখা হয়ে গিয়েছিলো সেদিনের কুইন্স পার্ক ওভালের বাইশ গজেই। যেখান থেকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ব্যাটন সুরক্ষিত রাখার নায়ক সাকিব, তামিম, মুশফিক এই তিনমুর্তির বিশ্বক্রিকেটকে বার্তা দেওয়ারও সূচনা হয়।
তৈরী হয়ে যায় এমন একজন নেতা, যিনি শুধু বছরের পর বছর দেশের বোলিং ব্রিগেড শুধু নয়, গোটা দল শুধু নয়, একটা ক্রিকেট জাতিরই যেন নেতা হিসেবে অবির্ভূত হন, জন্ম হয় এক নতুন মাশরাফি মোর্তাজার। এক সতীর্থ ভাই হারানোর বেদনা বুকে চেপে রেখে, শরীরের জ্বর জ্বালা তুচ্ছ করে ভারতীয় ব্যাটিংকে চুরমার করে দিয়ে এক মহাকাব্যই লিখে যান মাশরাফি, কত শত ইতিহাসের সাক্ষী কুইন্স পার্ক ওভালের বাইশ গজে।
ডেভ হোয়াটমোরের আদরের ‘পাগলা’র পাগলামিতে একশো দশ কোটির মনে যতই বেদনাদায়ক কালোদিন হয়ে থাকুক, ষোলো কোটির কাছে তা চিরকালের জন্য মনের মনিকোঠায় রেখে আনন্দ উদযাপনের খোরাক হয়ে থেকে যায়। আর সেখানে মাশরাফি হয়ে যান এক সমগ্র ক্রিকেট জাতির নায়ক, নতুন যুগের অগ্রদূত।