১৯৯৯ সালের ১৬ জানুয়ারি। স্টামফোর্ড ব্রিজে চেলসির মুখোমুখি হয়েছিল আর্সেনাল। উত্তেজনাকর সেই ম্যাচের ৭৫ মিনিট পর্যন্ত ২-০ ব্যবধানে ফলাফল চেলসির পক্ষে ছিল । কিন্তু এরপরই যেন ঝড় ওঠে স্টামফোর্ডে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই পরের আট মিনিটের মাঝে সমতায় চলে আসে গানাররা। ব্লুজ ফ্যানরা তখন হতভম্ব, স্টামফোর্ড তখন নি:স্তব্ধ।
অবিশ্বাস্য সেই চিত্রনাট্য সেখানেই শেষ হয়নি। ম্যাচের একেবারে শেষদিকে আরো একবার বলের ঠিকানা হয় চেলসির জাল। আর্সেনালের এমন নাটকীয় জয়ের পার্শ্বনায়ক অনেকে হতে পারেন, তবে নায়ক একজনই ছিলেন সেদিন। প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় গোল যার পা থেকে এসেছিল, সেই নুয়ানকো কানু ছিলেন সেদিনের নায়ক। তাঁর হ্যাটট্রিকেই সেদিন হৃদয় ভেঙেছিল হাজার হাজার স্বাগতিক দর্শকের।
একজন স্ট্রাইকার হিসেবে নুয়ানকো কানু কখনোই আর্সেনালের ‘মেইন ম্যান’ ছিলেন না। আর্সেনাল অধ্যায়ের শুরুর দিকে নিকোলাস অ্যানেলকা এবং কিছু সময় পর থিয়েরি অঁরির উপস্থিতির কারণে মূল দলে কানুর জায়গা হতো না বললেই চলে।
কিন্তু একবারে চমকপ্রদ এবং দুর্দান্ত দক্ষতার সাথে গোল করতে সক্ষম ছিলেন নুয়ানকো কানু। তিনি ছিলেন একেবারেই ভিন্ন ধরনের ফরোয়ার্ড। এই ফুটবলার এমন একজন প্রতিভা ছিলেন যে প্রচুর পরিমাণে গোল করতে না পারলেও প্রায়শই চোখে লেগে থাকার মত স্মরণীয় গোল করতেন। সমর্থকরা আদর করে ডাকতো ‘পাপিলো’ নামে। পাপিলো অর্থ প্রজাপতি।
আর্সেনালে যোগ দেয়ার কয়েক মাস পরেই হোয়াইট হার্ট লেনে টটেনহ্যামের বিরুদ্ধে লুক ইয়ং-এর মাথার উপর দিয়ে বলকে ফ্লিক করে একটি ডার্বি গোল করে প্রথমবার আর্সেনাল সমর্থকদের মনোযোগ আকর্ষণ করেন নুয়ানকো কানু।
এরপর এমন সব গুরুত্বপূর্ণ আর দারুণ গোল করার ধারা পরবর্তীতেও ধরে রেখেছিলেন এই তারকা। আর তাই গড়পরতা পরিসংখ্যান থাকা সত্ত্বেও আর্সেনালের একজন কিংবদন্তি হিসেবেই কানুর নাম উচ্চারিত হয়।
নুয়ানকো কানু ১৯৭৬ সালের আগস্টের প্রথম দিন জন্মগ্রহণ করেছিলেন। নাইজেরিয়ার ওয়ারি শহরে তাঁর বেড়ে ওঠা। অন্য অনেক আফ্রিকান শিশুর মতই দারিদ্রতাকে সঙ্গী করেই ফুটবল নিয়ে ছুটতে শুরু করেন তিনি। কানুর বড় ভাই ক্রিস্টোফার নিজেও একজন ফুটবলার। ভাইয়ের কাছ থেকে প্রথম ফুটবলের বিদ্যা আয়ত্ত করতে থাকেন তিনি।
নুয়ানকো কানু নাইজেরিয়ান লিগের একটি ক্লাবের হয়ে খেলার মধ্য দিয়ে পেশাদার ফুটবলে আত্মপ্রকাশ করেন। পাশাপাশি নাইজেরিয়া অনূর্ধ্ব-১৭ দলেও সুযোগ পান। অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করা নুয়ানকো নজরে আসেন ডাচ ক্লাব আয়াক্সের। ১৯৯৩ সালে নেদারল্যান্ডসে এসে দলটির হয়ে খেলা শুরু করেন তিনি।
পরবর্তী তিন বছর আয়াক্সের হয়ে মোট ৫৪ ম্যাচ খেলেছিলেন এই ফরোয়ার্ড। দলটির হয়ে করেছিলেন ২৫ গোল। এছাড়া ১৯৯৫ এবং ১৯৯৬ সালের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে আয়াক্সের জার্সিতে মাঠে নেমেছিলেন তিনি।
১৯৯৬ সালেই আনুমানিক পাঁচ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে ইন্টার মিলান নুয়ানকো কানুকে ইতালিতে নিয়ে আসে। সে বছরই মেডিক্যাল টেস্টে কানুর হৃদপিণ্ডে জটিল সমস্যা ধরা পড়ে। ডাক্তাররা ধরেই নিয়েছিল এই নাইজেরিয়ানের ক্যারিয়ার শেষ, কিন্তু সবাইকে অবাক করে পরের বছর আবারো সবুজ ঘাসে বুট পরে নেমে যান এই ফুটবলার।
অসুস্থতার কারনেই ইন্টার মিলানে থাকার সময়টা মোটেই মনে রাখার মত ছিল না। বারো ম্যাচে মাত্র এক গোল করে ইতালিতে বিদায় বলেন তিনি।
এরপর চলে আসেন ইংল্যান্ডে, গায়ে জড়ান আর্সেনালের সাদা আর লাল জার্সি। অভিষেকের পরের সময়গুলোতে বেঞ্চ থেকে এসে শেফিল্ড, টটেনহ্যাম, অ্যাস্টন ভিলার বিপক্ষে গোল করে সুপার সাব হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেন নুয়ানকো কানু। ১৯৯৯/২০০০ মৌসুমে আর্সেনালের হয়ে পঞ্চাশ ম্যাচে ১৭ গোল করেন তিনি। তবে থিয়েরি অঁরির আগমনের পরে গুরুত্ব হ্রাস পায় কানুর।
সাধারণত সাবস্টিটিউট হিসেবেই তাকে ব্যবহার করতে শুরু করেন তৎকালীন কোচ আর্সেন ওয়েঙ্গার। ২০০৩/০৪ মৌসুমে আর্সেনালের অজেয় স্কোয়াডের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলেন নাইজেরিয়ান তারকা। ২০০৪ সালে চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে আর্সেনাল এর সাথে সম্পর্কের সমাপ্তি হয়।
দলটির হয়ে মোট ১৯৭ ম্যাচ খেলে ৪৪ গোল করেছিলেন এই স্ট্রাইকার, তবে এর মধ্যে অনেক গোল ছিল গুরুত্বপূর্ণ আর চোখ ধাঁধানো।
২০০৪ সালে ওয়েস্ট ব্রুমে আসার পর একাদশে নিয়মিত হয়ে ওঠেন নুয়ানকো কানু। এখানে এসেও নিয়মিত ম্যাচ জয়ী এবং পয়েন্ট জেতানো গোল করতে থাকেন কানু। তাঁর দুর্দান্ত পারফরম্যান্সেই সেবার রেলিগেশন এড়াতে সক্ষম হয় দলটি। শেষপর্যন্ত দুই বছর খেলার ওয়েস্ট ব্রুমকে বিদায় বলে পোর্সমাউথে যোগ দেন নুয়ানকো কানু।
অভিষেক মৌসুমে ১২ গোল করে পোর্সমাউথের সর্বোচ্চ গোলদাতা নির্বাচিত হন এই নাইজেরিয়ান। পরের বছরও একইভাবে দলের প্রয়োজনের মুহূর্তে গোল করে নিজের ধারাবাহিকতা দেখান। তবে এরপর ইনজুরি এবং ফিটনেস ইস্যুর কারনে শেষদিকে ক্লাবের সাথে সম্পর্ক ভাল যায় নি তার। ফলে ২০১২ সালে পোর্সমাউথ থেকে চলে আসেন এবং এর পাশাপাশি নিজের ক্লাব ক্যারিয়ারকেও বিদায় বলে দেন।
নাইজেরিয়া জাতীয় দলে নুয়ানকো কানুর প্রয়োজনীয়তা ছিল অনেক বেশি। ১৯৯৬ সালে দলটিকে অলিম্পিকে গোল্ড মেডেল জিতিয়েছিলেন তিনি। তবে নিয়মিত গোল পাওয়ার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন পিছিয়ে, আর তাই ৮৬ ম্যাচ খেলেও মাত্র ১২ গোল করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
পরিসংখ্যানে আসলে নুয়ানকো কানুকে ফুঁটিয়ে তোলা যায় না ৷ ৬ ফুট ৬ ইঞ্চি শরীরের কানু ছিলেন ক্ষীপ্র আর বুদ্ধিমান। দারুণ ফুটওয়ার্ক আর পজিশনিং সেন্সের কারনে তাঁর গোল করার দক্ষতা ছিল ঈর্ষণীয়। এছাড়া ড্রিবলিং আর ডজের সাহায্যে ডিফেন্ডারদের বোকা বানাতেও তিনি ছিলেন সেরা।
ডাচ লিগ শিরোপা, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, উয়েফা সুপার কাপ, প্রিমিয়ার লিগ সহ সম্ভাব্য প্রায় সব ট্রফি জিতেছেন নুয়ানকো কানু। আফ্রিকান ফুটবলার অব দ্য ইয়ারও হয়েছেন কয়েকবার। এছাড়া আইএফএফএইচএসের নির্বাচিত সর্বকালের সেরা আফ্রিকান একাদশে জায়গা পেয়েছেন এই স্ট্রাইকার।
তবে নুয়ানকো কানুর সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি আর্সেনালের কিংবদন্তি। ২০০৮ গানারদের ইতিহাসের ‘সেরা পঞ্চাশ তারকা’ নির্বাচনে তিনি ১৩ তম হয়েছিলেন। পরিসংখ্যানের পাতায় খুঁজে বেড়ালে সহজে পাওয়া যাবে না নুয়ানকো কানুকে।
কিন্তু দুই আঙুলের ‘গান স্যালুট’-এর কথা ভাবলে ছয় ফুটি এই আফ্রিকানের ছবি যে কারো মনে আসতে বাধ্য হবে। অনেক আর্সেনাল ভক্তের কাছে কানু একজন কাল্ট হিরো। তাদের কাছে কাল্ট হিরো হয়েই স্মরণীয় হয়ে থাকবেন তিনি।